ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে দিশাহারা কৃষক

প্রকাশিত: ২০:১৮, ১৬ মে ২০২৫

ফসলের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে দিশাহারা কৃষক

একজন কৃষক কান ধরে উঠবস করছেন। না কোনো শাস্তিমূলক অপরাধের জন্য তিনি কান ধরে উঠবস করছেন না। তার একটাই অপরাধ তিনি এদেশের কৃষক। তারা রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রকৃতির রুদ্ররোষ উপেক্ষা করে ফসল ফলান। এটাই তাদের অপরাধ। একজন কৃষক যখন তার ফসলের ন্যায্য মূল্যে থেকে বঞ্চিত হন তখন তিনি এভাবেই কান ধরে উঠবস করে প্রতিজ্ঞা করছেন তিনি আর পেঁয়াজ চাষ করবেন না। তাদের উচ্চমূল্যে সার এবং বীজ কিনতে হয়। শ্রমিকের মজুরি বেশি। আবার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক পর্যন্ত পাওয়া যায় না। আবার  কৃষক কখনো তার নিজের মজুরি ধরেন না। তার মজুরি দেয়া সম্ভব নয়। একজন কৃষক পেঁয়াজের জমিতেই বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন। কারণ-তিনি পেঁয়াজ চাষ করতে খরচ করেছেন ১ লাখ ২৭ হাজার টাকা। সুদের কিস্তির জন্য সে পেঁয়াজ তিনি ধরে রাখতে পারেননি বাজার বাড়তির জন্য। পেঁয়াজের বাজার মূল্যে তখন কম থাকায় তার পুঁজি উঠে এসেছে মাত্র ৫৮ হাজার টাকা। এখন হয়তো বিক্রি করলে তিনি ডাবল পেতেন। কিন্তু সুদের কিস্তি তাকে পেঁয়াজ ধরে রাখতে দেয়নি। মনের জ্বালা দূর করতে জমির জন্য কেনা বিষেই নিজের জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দিয়েছেন। আরেকজন কৃষক তো ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন শেষ করে দিলেন। আগে আমরা পাশের দেশ ভারতের খেটে খাওয়া কৃষকের আত্মহত্যার খবর শুনতাম। এখন তা আমাদের নিজের দেশের কৃষকরাই সে অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে। কৃষকদের মূল সমস্যা হলো- তাদের পুঁজির সংকট। সে পুঁজি তারা সরকারি কৃষি ব্যাংক থেকে সহজেই পান না। ১০ পার্সেন্ট ঘুষ দিয়েও পায়ের জুতার তলি ক্ষয় হয়ে যায়। কিন্তু সহজ কৃষি ঋণ তাদের কপালে আর জোটে না। তারপর তারা কিস্তি গ্রহণ করে থাকেন। সে কিস্তি প্রতি সপ্তাহে সপ্তাহে দিতে হয়। কিস্তি থেকে যে টাকা পাওয়া যায় তা দিয়ে জমি চাষ করতে পারলেও বীজ ও সার কেনা যায় না। আবারও তাদের ঋণ নিতে হয়। এবার তারা কোথায় যাবে? হ্যাঁ। এবার গ্রাম্য মহাজনী ঋণই তাদের একমাত্র ভরসা। শতকরা একশ টাকা সুদ। ৫ হাজার টাকা নিলে অতিরিক্ত আরও ৫ হাজার দিতে হবে। এত সংকটের মধ্য দিয়ে ফসল ফলিয়ে তারা যদি ন্যায্য মূল্যে না পান তাহলে আত্মহত্যা ছাড়া কৃষকের আর কোন গতান্তর থাকে না। সরকারিভাবে কৃষকের জন্য সার বরাদ্দ আসে, বীজ আসে, নগদ অর্থ আসে। সেগুলো তাহলে কোথায় যায়? কারা কৃষকের এগুলো খেয়ে ফেলে। তা এখন দেশের মানুষ জানতে চায়? কৃষকের নামে আধুনিক প্রযুক্তির হার্ভেস্টার মেশিন আসে। তা কৃষি অধিদপ্তরের দুর্নীতিবাজরা খেয়ে হজম কর ফেলে। তাহলে কৃষক এখন যাবে কোথায়? এবার কি কৃষক কোনো ফসলের লাভ ঘরে তুলতে পেরেছেন? শীতকালীন সবজির দর ছিল সর্বনিম্ন। তাতে শ্রমিক খরচও উঠে আসেনি। টমেটো ক্ষেতেই পচিয়েছে অনেক কৃষক। আলু নিয়ে এবার কৃষকের হাহাকার ছিল চোখে পড়ার মতো। তারপর আসে পেঁয়াজ। পেয়াজের নাকালে কৃষক একেবারে সর্বস্বান্ত।
এখন কৃষকের গোলায় ধান। অনেক কৃষক কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে ইতোমধ্যেই পানির দামে ধান বিক্রি করে দিয়েছেন। এবার যদি ধানেও কাক্সিক্ষত দর না মিলে তাহলে তারা যাবে কোথায়? আর কৃষি কাজই কেন বা করবে? আমরা অন্যান্য দেশ থেকে পেঁয়াজ, রসুন, আদা আমদানি করি। সেভাবে আমাদের বাড়তি ফসল অন্য দেশে রপ্তানির ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে করতে হবে। অনেকেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কৃষি পণ্যের মূল্যে কম দেখে আত্মতৃপ্তির বয়ান দেয়। তাতে কৃষকের কলিজায় দাগ পড়ে যায়। কৃষকের চোখের জল ফেলে এবং প্রকৃতির রুদ্ররোষের কবল থেকে ফসল ফলিয়ে এখন তারা দিশেহারা। তাদের জন্য নতুন করে ভাবতে হবে রাষ্ট্রকে। কি করা যায়? বাড়তি ফসল রাষ্ট্র কি করবে তা তাদেরই ভাবতে হবে। সার, বীজ আর নগদ অর্থ সরাসরি কিভাবে কৃষক পেতে পারে তার জন্য নতুন পন্থা অবলম্বন করতে হবে। নইলে কখনই কৃষকের চোখের জল ফুরোবে না।  


অলিউর রহমান ফিরোজ     
রিকাবীবাজার, মুন্সীগঞ্জ

প্যানেল

×