ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৭ মে ২০২৫, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিল সাম্য: এটাই তাঁর অপরাধ?

মাহবুব নাহিদ 

প্রকাশিত: ১৯:৩৮, ১৬ মে ২০২৫

সাম্যের বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিল সাম্য: এটাই তাঁর অপরাধ?

যে রক্তঝরা সংগ্রামের পথে ছাত্রদলের লড়াই শুরু হয়েছিল, সেই পথের শেষ নেই—কারণ সংগ্রাম কখনোই থেমে থাকে না। এটি অবিরাম চলে মিছিলের গর্জনের মতো, যেখানে ছাত্রদলের প্রতিটি সৈনিক বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় দেশের প্রয়োজনে। তারা গুম হয়, জেল খাটে, গুলি খায়, জীবন দেয়—তবু পিছু হটে না। গণতন্ত্র, অধিকার আর মাতৃভূমির প্রতি অঙ্গীকার থেকেই তাদের পথ চলা। এই পথেই পড়ে থাকে শহীদের নাম—কামরুজ্জামান জনি, বাপ্পী, জিসান, ওয়াসিম আকরাম, রাব্বি, পারভেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতা সাম্য। একের পর এক প্রাণ বিসর্জনের এ ইতিহাস ছাত্রদলের রক্ত স্রোত মাড়িয়ে বিজয়ের পথে এগিয়ে যাওয়ার আলেখ্য উপাখ্যান। 

কিন্তু কতটা হৃদয়বিদারক হলে বুঝি, এক ফ্যাসিস্ট শাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যারা জীবন দিয়েছে, আজ সেই ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশেও ছাত্রদলের ছেলেদের প্রাণ দিতে হয়! পারভেজের অপরাধ—নাকি শুধু একটি মেয়ের দিকে তাকানো? সাম্যর অপরাধ—মোটরসাইকেলের সঙ্গে সামান্য ধাক্কা লাগা? না, এগুলো আসল কারণ নয়। কারণ আসলে গভীরে—যেখানে ছাত্রদলের বলিষ্ঠ কণ্ঠরোধ করতে চায় একটি ভয়ংকর অপশক্তি। টার্গেট কিলিংয়ের সুনির্দিষ্ট ছক এখন স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যেন একে একে নিভিয়ে দেওয়া হয় তারুণ্যের দীপ্ত শিখাগুলো।

আমরা শোকের ভার নিয়ে নত হই না—আমরা রক্তের প্রতিশোধ শপথে জাগি। ছাত্রদল কোনো ভঙ্গুর সংগঠন নয়, এটা একটি আদর্শ, একটি সংগ্রাম, একটি সাহসের নাম। সাম্য-জনি-বাপ্পীরা মরে না, তারা ছাত্রদলের পতাকায় বেঁচে থাকে, প্রেরণায় রূপ নেয়। আজকের তরুণরা শপথ নিক—আর কোনো পারভেজকে যেন অকালে মরতে না হয়, আর কোনো সাম্যের লাশ যেন রাজপথে না পড়ে থাকে। এবার হিসেব হবে—রক্তের, প্রতিরোধের, নেতৃত্বের। কারণ ছাত্রদল হার মানে না, মাথা নত করে না—ছাত্রদল শুধু এগিয়ে যায়।


সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অন্ধকার চুপচাপ গিলেছিল আরেকটি তরতাজা প্রাণ। মঙ্গলবার (১৩ মে) রাত ১১টার দিকে ছুরিকাঘাতে আহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহসী ছাত্র ও ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য। রাত ১১:৩০ থেকে ১২টার মধ্যেই বন্ধুরা রক্তাক্ত সাম্যকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। কিন্তু চিকিৎসক জানিয়ে দেন সেই হৃদয়বিদারক সংবাদ—সাম্য আর নেই। সাম্য শুধু একজন শিক্ষার্থী ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাহসী কণ্ঠ, ছিলেন স্যার এ এফ রহমান হল ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক, ছিলেন "জুলাই অভ্যুত্থানের" রাজপথ কাঁপানো স্লোগান মাস্টার, ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে এক নির্ভীক সৈনিক। সিরাজগঞ্জের সন্তান সাম্যর স্বপ্ন ছিল, এ দেশকে একটি সাম্য ও মানবিক মর্যাদার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তর করার।

সাম্যর মতো একজন প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করতে যারা রাতের অন্ধকার বেছে নেয়, তারা জানে না—সাম্যর মৃত্যু শুধু একটি খুন নয়, এটি একটি আদর্শে আঘাত। আজ কিছু মানুষ সাম্যর মৃত্যুতে ‘তদন্ত’ নয়, খোঁজে ব্যাখ্যা। তারা প্রশ্ন তোলে—"এত রাতে সাম্য ওখানে কী করছিল? এছাড়াও আরো নানান নোংরা যুক্তি দিয়ে ঢেকে দিতে চায় মৃত্যুকে! কেন তাকে মারা হলো সেটি বোঝার চেষ্টা করে না! একজন রাজনীতি সচেতন তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে শুধু বিরোধী মতের রাজনীতি করার অপরাধে খুন করে দেওয়া হলে, তার মৃত্যুর ন্যায্যতা খুঁজে বের করা কি এক নির্মম নির্লজ্জতা নয়? একজন সন্তানের লাশ ফিরে এলে কোন মা-বাবা বলবে—"হ্যাঁ, ওর দোষ ছিল, ঠিকই মেরেছে!"—এই প্রশ্নটা যারা তোলে, তারা নিজের স্বজন হারালে পারবে এমন যুক্তি দাঁড় করাতে?

আরও মর্মান্তিক হয়ে ওঠে এই পরিস্থিতি, যখন আমরা দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই আট মাসের ব্যবধানে ঘটেছে দুটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এর আগে একজনকে চোর সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছিল, আর এবার সামান্য ধাক্কা লাগার ‘অপরাধে’ প্রাণ হারাতে হলো একজন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে! এটা কি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের চরম ব্যর্থতা নয়? উপাচার্য কি সাম্যর মৃত্যুর রাতে হাসপাতালে ছুটে যেতে পারতেন না? বলতে পারতেন না—"সাম্য তো আমার ছাত্র, চলো আমি মামলা করি, আমি পরিবারকে সান্ত্বনা দিই"? বরং সেই রাতে উপাচার্যের ভূমিকা ছিল নিস্তরঙ্গ ও নির্বিকার, তেড়ে এলেন ছাত্রদের সঙ্গে। একদিন পরে তথাকথিত "আধাবেলা শোক" ঘোষণা করে দায় সারলেন, এমনকি সাম্যর জানাজায়ও দেখা গেল না বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসককে। এ কেমন নির্মম প্রশাসন?

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের একনিষ্ঠ কর্মী সাম্যর এই নির্মম হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই খাটো করে দেখা যায় না। তার রক্ত ছাত্রসমাজের রক্ত। তার মৃত্যুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন শোকে ফেটে পড়েছে, যখন তারা প্রশাসনের ব্যর্থতার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে, তখন তাদের দাবি—ভিসি ও প্রক্টরের পদত্যাগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে প্রশাসন, ছাত্রদলের এমন দাবির সাথে তাঁরা আরো দাবি করছে হল পর্যায়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সদস্যরা এখনো বিদ্যমান। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরে এখনো ফ্যাসিবাদের দোসরদের অবস্থান রয়েছে। খুন তো খুনই—তা দলীয় পরিচয়ে নয়, মানুষের পরিচয়ে বিচার করতে হয়। আর যদি বিচার না হয়, যদি ন্যায়ের প্রতিফলন না হয়, তাহলে এই দেশের শিক্ষাঙ্গনগুলোও বিবিধ পরিণত হবে নীরব কবরস্থানে, যেখানে ছাত্রদের স্বপ্ন নয়, বরং লাশ শুয়ে থাকবে!


এই যে বিচারহীনতার দীর্ঘস্থায়ী সংস্কৃতি—এটাই আজ আমাদের সমাজকে ক্রমেই অপরাধপ্রবণ করে তুলছে। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটছে, কিন্তু বিচার নেই, দায় নেই, জবাবদিহিতা নেই। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি, প্রকাশ্য রাজপথে ছাত্রলীগ কর্তৃক নির্মমভাবে খুন হওয়া বিশ্বজিতের বিচারও হয়নি, এমন হাজারো ঘটনা আমরা দেখেছি—এই অনিচ্ছাকৃত ন্যায়বিচারই অপরাধীদের আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। কেউ জানে, কোনো কিছুই হবে না, ক্ষমতার ছায়া পেয়ে সব চাপা পড়ে যাবে। সাম্যর জানাজার সময় হাজারো মানুষ ক্যাম্পাসের মসজিদ প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে কেঁদেছে—বন্ধু, সহপাঠী, শিক্ষক, প্রিয়জন সবাই। আর সেই কান্নার সাথে যেন মিশে গিয়েছিল আকাশের অশ্রুও—সাম্য যখন প্রিয় ক্যাম্পাস থেকে বিদায় নিলেন তখন আকাশের অবারিত বর্ষাও যেন ঝড়লো অশ্রু হয়ে। একটি আদর্শের, একটি স্বপ্নের, একটি সম্ভাবনার মৃত্যু হয়েছিল সেদিন।

আর এই যে ছাত্রদলের পারভেজ, যে খুন হলো অকাট্য অন্যায়ভাবে, কিংবা সাম্য—যাদের রক্তে রাজপথ স্নান করে; এই সংগঠনই তো বছরের পর বছর গুম-খুন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে বুক পেতে দিয়েছে, গণতন্ত্রের দীপ্ত শিখা জ্বেলে রেখেছে। বিশেষ করে বিগত জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রদলের ত্যাগ ছিল সবচেয়ে স্পষ্ট—জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাসকের চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে তারা। একক সংগঠন হিসেবে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। আজ যখন এই সংগঠনের তরুণদের এভাবে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, তখন আড়ালে বসে ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোই হেসে ওঠে। তাই সময় এসেছে শক্ত হাতে রুখে দাঁড়ানোর। ছাত্রদলের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। আমাদের প্রত্যেককেই হয়ে উঠতে হবে সাম্যের কণ্ঠস্বর, পারভেজের প্রতিবাদ, তাদের অসমাপ্ত লড়াইয়ের ধারক। আমরা থামবো না, নত হবো না—আমরাই প্রতিরোধ গড়বো।

 

লেখক: মাহবুব নাহিদ 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

রিফাত

×