
এ কথা আমরা প্রায়ই শুনে থাকি যে, বয়স একটা সংখ্যা মাত্র। মনের দিক থেকে যদি তরুণ থাকা যায় তাহলে বয়স কোনো ফেক্টর নয়! কথাটি অনেকাংশে ঠিক। আবার চাইলেও আমরা সব সময় আমাদের বুড়িয়ে যাওয়া ঠেকাতে পারি না। কালের পরিক্রমায় বয়স বাড়ে, পরিবর্তন হয় আশপাশের। টগবগে তরুণও একসময় প্রবীণ হন। আমাদের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী ৬০ বছরের ওপর যাদের বয়স, তারাই প্রবীণ হিসেবে অভিহিত হন। কিন্তু কেউ কেউ আরও বেশি দিন পর্যন্ত মনের তারুণ্য ধরে রাখতে পারেন। মনের তারুণ্য যখন একটু একটু করে ক্ষয় হতে থাকে, তখনই দেখা দেয় বার্ধক্য, কমে আসতে থাকে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা। মস্তিষ্কে তথ্য ধারণ করে রাখার প্রক্রিয়া কিংবা মস্তিষ্কে ধারণকৃত তথ্যকে স্মৃতি বলে। এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে তথ্য আহরণ করে মস্তিষ্কে জমা করা হয় এবং দরকার অনুযায়ী ধারণকৃত সেই তথ্য ভাণ্ডার থেকে খুঁজে আনা হয়। জমাকৃত তথ্য হারিয়ে গেলে কিংবা সময়মতো খুঁজে পাওয়া না গেলে তা দুর্বল স্মৃতিশক্তির লক্ষণ। এজন্যই স্মৃতিশক্তি মানুষের জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ। দৈনন্দিন কাজ থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্মৃতিশক্তির প্রয়োজন হয়। সাধারণত মধ্য বয়সের পর থেকে মানুষের স্মৃতিশক্তি কমতে শুরু করে।
আমরা কী কাজের চাপে প্রায়ই এটা-সেটা ভুলে যাচ্ছি? আমাদের স্মৃতিশক্তি কী দুর্বল হয়ে পড়ছে? আমরা কেন ভুলে যাচ্ছি বা ভুলে যাওয়ার কারণই বা কী- এরকম প্রশ্ন নানা সময় মাথায় উঁকি দেয়। ভুলে যাওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। ভুলে যাওয়াও কিন্তু একটি রোগ, যাকে বিজ্ঞানীদের ভাষায় বলে ডিমেনশিয়া। ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত রোগ। এ রোগে মানুষের ভেতরে চিন্তার ক্ষমতা, আচরণ, ব্যক্তিত্ব এবং ভুলে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়। প্রফেসর ড. পল রেবর মনে করেন সাম্প্রতিক জীবনের স্ট্রেস এ রোগের একটি অন্যতম কারণ।
রাস্তাঘাটে খুব পরিচিত কিংবা আত্মীয়স্বজন কারও সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ খেয়াল হলো যার সঙ্গে কথা বলছি তার নামটাই তো মনে নেই! বাজারের ফর্দ বা সংসারের খরচ এমন কি সহজ হিসেবও কেমন যেন মাঝে মধ্যেই গুলিয়ে যাচ্ছে। কথাবার্তায় দেখা দিচ্ছে অসংলগ্নতা। অথচ বহু বছর আগের কোনো ঘটনা নিখুঁতভাবে মনে পড়ছে। সকালে কী খেলাম তা মনে পড়ছে না। প্রিয় কারও জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী এসব কিন্তু মনে পড়ছে সেসব দিন পেরিয়ে যাওয়ার অনেক পরে। এটাই হলো ডিমেনশিয়া। ভুলে যাওয়াটা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। মানুষ মাত্রই ভুলে যাবে। তবে ভুলে যাওয়াটা যেন অস্বাভাবিক না হয়।
কয়েকটি বাস্তব ঘটনা
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এক সহকর্মী একদিন তার কাছে টেলিফোন নম্বরটা চাইলেন। আইনস্টাইন কিছুক্ষণ ভাবলেন। নিজের নম্বরটা কিছুতেই মনে করতে পারছিলেন না। তখন ভেতর থেকে নিয়ে এলেন একটি টেলিফোন ডাইরেক্টরি। তারপর বসে বসে নম্বর খুঁজতে শুরু করলেন। সহকর্মী বললেন, আমি তো আপনার নম্বরটা চেয়েছি। আইনস্টাইন বললেন, সেটাই তো খুঁজছি। সহকর্মী তো ভীষণ অবাক, নিজের টেলিফোন নম্বরটাও মনে নেই।
নিজেও মানুষের নাম এবং টেলিফোন নম্বর এ দুটো জিনিস মনে রাখতে পারি না। এজন্য আমাকে প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। দেখা গেল কোনো একজন মানুষের সঙ্গে আমার খুব সখ্য গড়ে উঠল। তারপর কিছুদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই। পরে যখন হঠাৎ করে কোথাও দেখা হলে তখন মনে হলো, আরে তাকে তো চিনি! কিন্তু কিছুতেই নাম মনে করতে পারছি না কোথায় দেখেছি। পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না। বুঝতেও দিচ্ছি না যে তার নাম ভুলে গেছি। অথচ কথা চালিয়ে যাচ্ছি। কি যে একটা অবস্থা! মাঝে মাঝে ভান করছি যে হ্যা, হ্যা আপনাকে তো চিনি, নামও জানি। আসলে তো কিছুই মনে করতে পারছি না। তখন বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করি, ভাই আপনার পুরো নামটা যেন কী? ভাবখানা এমন যেন ডাকনামটা মনে আছে এখন পুরো নামটা জানতে চাচ্ছি। চালাক লোকেরা আবার ব্যাপারটা ধরে ফেলে। তখন লজ্জায় লাল হয়ে বলি, সরি ব্রাদার অনেক দিন পরে দেখা হলো তো তাই অতটা খেয়াল নেই। সত্যি কথা বলতে কী আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। মনে রাখতে পারি না এটিও তার মধ্যে একটি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে দেশটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার রেকর্ড গড়েন জো বাইডেন। ২০২০ সালে যখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তখন তার বয়স ছিল ৭৭ বছর। তিনি যখন দ্বিতীয়বার দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রার্থিতার আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন তার বয়স দাঁড়ায় ৮১ বছর। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী, তিনি দ্বিতীয় মেয়াদে প্রার্থিতা করার আইনগত এখতিয়ার রাখেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিরোধী দল রিপাবলিকান পার্টির পাশাপাশি বাইডেনের নিজের দল ডেমোক্রেটিক পার্টির একাংশ দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করে আসছিলেন যে, বয়সজনিত কারণে বাইডেন স্মৃতিভ্রংশ সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে আসন্ন নির্বাচনে তার প্রার্থিতা করা উচিত হবে না। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ তার বয়স নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন।
উল্লেখ্য, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দুই মেয়াদের সময়জুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জো বাইডেন। তার বড় ছেলে ও আইনজীবী বিউ বাইডেনের যখন মৃত্যু হয়, সে সময়ও যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্টের পদে ছিলেন তিনি। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০১৫ সালে মারা যান বিউ। বয়সজনিত কারণে বাইডেনের স্মৃতিশক্তি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে তিনি কবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং কোন বছর তার বড় ছেলে মারা গেছে, তার সঠিক উত্তর দিতে পারেননি। এসব কারণেই তিনি দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট প্রার্থির পদ থেকে সরে দাঁড়ান। আর তখনই ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার যুক্তরাষ্ট্রের প্রসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হন।
আগে ধারণা ছিল, বৃদ্ধ বয়সেই সাধারণত এই রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। তবে আধুনিক গবেষণা এর বিপরীতটাই বলছে। বায়ুদূষণের কারণে কম বয়সেও মানুষ শিকার হচ্ছে ডিমেনশিয়ার। বায়ুদূষণে ধুঁকতে থাকা শহরের বাতাস ফুসফুসের পাশাপাশি ক্ষতি করছে মস্তিষ্কের। ধোঁয়ার কনাগুলো খুব সূক্ষ্ম হওয়ায় তা আমাদের শ্বাসনালি দিয়ে সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে ফুসফুসে। সারা বিশ্বেই মানুষের গড় আয়ু কমিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে বায়ুদূষণ। বায়ুদূষণের সূচকে দিল্লি, কলকাতা ও ঢাকা এই তিনটি শহর বিশ্বের অন্যান্য শহর থেকে সব সময়ই এগিয়ে রয়েছে। এর ফলে স্নায়ুর নিউরোনগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কখনো কখনো স্নায়ু এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যে তথ্য আদান-প্রদানে আর অংশই নিতে পারছে না। ফুসফুসকে যেমন শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এই দূষণ, তেমনই নিউরোনের কার্যকারিতাও কমিয়ে দেয়। এছাড়া যানবাহনের ধোঁয়া সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মির সঙ্গে বিক্রিয়া করে তা আমাদের শ্বাসনালি দিয়ে সরাসরি ফুসফুসে পৌঁছে যাচ্ছে। এটাই জমতে জমতে একসময় ভয়ংকর ক্রনিক ডিজিজ ডেকে আনছে। শুধু বাইরের ধোঁয়াই নয়, ঘরের বাতাসও নষ্ট হয় লাগামছাড়া কীটনাশক ধূপ, স্প্রে, রুম ফ্রেশনার ইত্যাদি থেকে। রান্নার ধোঁয়া, ফোড়নের ঝাঁঝ- এসবের কারণেও ঘরের বাতাস দূষিত হয়।
শরীরচর্চা স্নায়ুর কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে বলে ডিমেনশিয়ায় আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় ব্যায়ামের পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা এবং সেই সঙ্গে তেল-মসলা এড়িয়ে শাকসবজি খাওয়ার ওপর জোর দেন। ডিমেনশিয়া দূরে রাখতে শুধু শরীরচর্চা ও ডায়েটে পরিবর্তন আনলেই হবে না; বায়ুদূষণের কারণগুলোর হাত থেকেও বাঁচতে হবে। বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় স্মৃতিশক্তিকে মজবুত রাখার জন্য পর্যাপ্ত ঘুম খুবই জরুরি। ঘুম না হলে মস্তিষ্ক আরও বেশি বুড়িয়ে যেতে পারে। ডিমেনশিয়ার জন্য কিছু ওষুধ রয়েছে, লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন আছে, মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি আছে। এগুলোর মাধ্যমে ডিমেনশিয়ার গতিকে কমানো যায়, কিন্তু রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হয় না।
লেখক : গবেষক ও প্রাবন্ধিক
প্যানেল