
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ফরিদপুরে প্রথম এসেছিলেন আজ থেকে ঠিক একশ বছর আগে, আজকের দিনে। অর্থাৎ ১৯২৫ সালের ১ মে তারিখে। বঙ্গীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগ দিতে। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন মহাত্মা গান্ধী, সরোজিনী নাইডু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সহ বহু নেতা। দুই অধিবেশনেই সভাপতিত্ব করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। তবে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন ২ রা মে '১৯২৫। অনেক স্বেচ্ছাসেবকদের মধ্যে সেই সমাবেশে অন্যতম ছিলেন কবি জসীম উদদীন।
অধিবেশনে বিখ্যাত ব্যক্তিদের তালিকায় ফরিদপুরের বিপ্লবী নেতা পূর্ণচন্দ্র দাস (১৮৮৯-১৯৫৬) এবং দক্ষিণপন্থি নেতা যদুনাথ পাল (১৮৮২-১৯৮৭) উপস্থিত ছিলেন। পূর্ণচন্দ্র দাস ১৯১০ সালে মাদারীপুর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতা বঙ্গবাসী কলেজে পড়ার সময় বিপ্লবী কাজে জড়িয়ে পড়েন। মাদারীপুরে একটা বিপ্লবী দল (শান্তি সেনাদল) গঠন এবং একসময়ে বাঘা যতীনের সহযোগী হন। যদুনাথ পালের কোনো তথ্য কমরেড মুজাফফর আহমদ ও আবদুল আজিজ আল আমানের বইতেও পাওয়া যায়নি।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে ফরিদপুরে সভা-সমিতি, সংবর্ধনা, রাজনৈতিক সভা ও নিজ নির্বাচনী কাজে মোট আটবার ফরিদপুর এসেছেন। তাঁর স্মৃতি জড়িত রাজেন্দ্র কলেজ মাঠ, টাউন হল যা পরবর্তীতে অম্বিকা হল ময়দান, মৃণাল সেনের বাড়ি, হুমায়ুন কবিরের বাড়ি , কবি জসীম উদদীন এর বাড়ি, মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী লাল মিয়া সাহেবদের' ময়েজ মঞ্জিলের পুকুর ঘাটলা (বকুল তলা) সহ অনেক জায়গা থাকলেও নজরুলের নামে কোনো স্মৃতি ফলক বা একটা সাইনবোর্ডও নেই ফরিদপুরে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট এরশাদ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন রাজেন্দ্র কলেজের মাঠে এক জনসভায় মাঠ সংলগ্ন জায়গায় শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। পরবর্তীতে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আর্থিক অনুদানে এই মিলনায়তনটি তৈরি হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এ হলের নাম করণ করা হয় 'কাজী নজরুল ইসলাম হল'। এসময়ে ফরিদপুর শিল্পকলা একাডেমীর সেক্রেটারি ছিলেন অধ্যাপক এবিএম সাত্তার। এরপরে ২০০০ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সম্পাদক মফিজ ইমাম মিলন (আমি) । তৎকালীন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক জালাল আহমেদ ২০০৩ সালে কিছু অর্থ সংগ্রহ করে উপকমিটির মাধ্যমে সংস্কার করে সরকারি কর্মাশিয়াল কলেজকে ভাড়া দিয়ে আয়ের উৎস করে দেয়।
ইতোমধ্যে হলটি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে যায়। '২৪- এর ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়া কিছু ছাত্র তৎকালীন সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষের পরামর্শে রাতারাতি নতুন দেওয়াল গেঁথে কলেজের নিজস্ব সীমানায় হলটা নিয়ে নেয়।
জানা গেছে, হল সংস্কারে ইতোমধ্যে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দও দেয়া হয়েছে এবং হলের নাম পরিবর্তন করে ছাত্র-ছাত্রী সংসদ হল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
তাহলে কাজী নজরুল ইসলাম হল কি বিলুপ্ত হয়ে যাবে ফরিদপুর থেকে? অন্য রকম রাজনীতির পট পরিবর্তন ঘটলে তো কলেজ প্রতিষ্ঠাতা অম্বিকাচরণ মজুমদারের নামের পরিবর্তন করার কেউ প্রস্তাব করতেও পারে। যেমনটা করেছিলেন সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই এলাহী চৌধুরী অম্বিকাপুর রেলস্টেশনের নাম পরিবর্তন করে জসীম উদদীন এর নামে করবার। সেসময়ে আমিই প্রথম ফেসবুকে প্রতিবাদ জানিয়ে ছিলাম। কিন্তু এখন কে এগিয়ে আসবে নজরুলের নাম টিকিয়ে রাখতে? বেশ কয়েক বছর যাবত শিল্পকলা একাডেমির এডহক কমিটিতে থাকা (নাম না বলি) দাপটে কর্তারা গেটে তালা লাগিয়ে পরিত্যক্ত ঘোষণা দিয়ে বসেছিলো। জেলা কালচারাল অফিসার সেও কোনো দিন জেলা প্রশাসকের কাছে বিষয়টা উপস্থাপন করেননি। তখন তো জুলাই অভ্যুত্থান হয়নি। নজরুলের নামে বেশ কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে শহরে। তারা কমিটির সভাপতি সম্পাদক বা প্রতিষ্ঠাতা বলে গর্ব অনুভব করেন। তারা-ও কেউ কোনো দিন পরিত্যক্ত এ হল নিয়ে কথা তোলেননি!! শিল্পকলার সম্পত্তি বেহাত হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বর্তমান সচিব ফরিদপুরের কাজী নজরুল ইসলাম হল সংক্রান্ত কোনো চিঠি উদ্ধার করতে পারেননি। তা হলে কি শিল্পকলার সম্পত্তি নজরুল ইসলাম হল হারিয়ে যাবে?
যে-সকল ছাত্ররা হল দখলে নিয়ে ভোগ করতে চাচ্ছো তোমরা কি একবার ভেবেছ নজরুলের নাম বাদ দিলে কে অপমান হবে?
"আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু"-- নজরুল।
নজরুলের ফরিদপুর সফরের একশ বছর পূর্তিতে ছাত্র-ছাত্রী, সমাজের কাছে আবেদন নজরুলের নামে হলটা যেন চালু রাখা হয়। হল না থাকলেও নজরুলের কিছু আসে যাবেনা। ফরিদপুরবাসী ছোটো হয়ে যাবে দেশের মানুষের কাছে।
আসুন আমরা সকল দলবাজি বাদ দিয়ে জাতীয় কবি নজরুলের সাথে নিজেদের সম্মান রক্ষা করি।
রবিউল হাসান