জাতি হিসেবে বাঙালির খাদ্য তালিকায় বৈচিত্র্যের যেন কমতি নেই। যুগে যুগে এই ভূখণ্ডে যত জাতির আগমন ঘটেছে, তাদের প্রায় সবারই অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির খাদ্যাভাসে। ঐতিহ্যবাহী সব খাবারের কথা মনে পড়লেই মাথায় চলে আসে পুরাণ ঢাকার নাম। সেখানকার খাবারের স্বাদে রয়েছে এক ভিন্ন আভিজাত্য।
যা অন্য জায়গার খাবারের স্বাদের সঙ্গে সহজেই পার্থক্য টেনে দেয়।পুরান ঢাকার খাবারের নাম শুনলে জিভে জল আসবেই। কত পদের যে সুস্বাদু খাবার, কত যে বাহারি নাম! সেই স্বাদ নিতে নানা জায়গা থেকে ভোজনপ্রেমীরা ভিড় জমান পুরান ঢাকার খাবারের হোটেলগুলোতে।
এই সুনাম অবশ্য অল্পদিনের নয়। দীর্ঘ ৪০০ বছরের অধিক সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকা মানেই সেরা আর বিখ্যাত খাবারের সমারোহ। কাচ্চি বিরিয়ানি, মোরগ পোলাও, পুরি,কাবাব,বাকরখানিসহ অনেক জনপ্রিয় খাবারের ঠিকানাই পুরান ঢাকা।
এবার পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলোর সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাক:
হাজী বিরিয়ানিঃ পুরান ঢাকায় বিরিয়ানি দারুণ জনপ্রিয়। উপরের সারিতেই মোঘল আমলের ঐতিহ্যবাহী হাজী বিরিয়ানি। ১৯৩৯ সালে হাজী মোহাম্মদ হোসেন প্রতিষ্ঠা করেন। বংশপরম্পরায় তার নাতিরা এখন ব্যবসা দেখছেন। খাসির মাংস দিয়ে অপূর্ব রন্ধনশৈলী মানেই হাজী বিরিয়ানি। নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে ৭০ নম্বর দোকানটি হচ্ছে বিখ্যাত হাজী বিরিয়ানি।
নান্নার মোরগ পোলাওঃ হাজী নান্না বিরিয়ানির মোরগ পোলাও ভোজনরসিকদের খুব প্রিয়। পুরান ঢাকার বাবুর্চি হাজী নান্না মিয়া ১৯৬২ সালে শুরু করেন এই ব্যবসা। পরিবারের সদস্যরা এই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। এছাড়া আছে খাসির কাচ্চি বিরিয়ানি। এখানে প্রতি মাসের ৫ তারিখে গোটা মোরগের কাচ্চি বিক্রি হয়। নান্নার মোরগ পোলাও হচ্ছে বেচারাম দেউড়িতে ৪১ নম্বর দোকানটি।
হানিফ বিরিয়ানিঃ বহু বছর ধরে স্বাদ, মান ও ঐতিহ্য ধরে রেখেছে হানিফ বিরিয়ানি। এটি যাত্রা শুরু করে ১৯৭৫ সালে। পুরান ঢাকার বাসিন্দা হাজী মোহাম্মদ হানিফ এটির প্রতিষ্ঠাতা। ২০০৫ সালে তার মৃত্যুর পর ছেলে হাজী মোহাম্মদ ইব্রাহিম রনি ব্যবসার হাল ধরেন। এখানকার প্রধান আকর্ষন খাসির বিরিয়ানি। নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে ৩০ নম্বর দোকানটি হচ্ছে বিখ্যাত হানিফ বিরিয়ানি।
ঝুনুর মোরগ পোলাওঃ দেশি মোরগ দিয়ে রান্না হয় মজাদার ঝুনুর মোরগ পোলাও। এটি পুরান ঢাকার অত্যন্ত জনপ্রিয় পদ। ১৯৭০ সালে নূর মোহাম্মদ তার মেয়ে ঝুনুর নামে দোকানের নাম রাখেন। নারিন্দা রোডের ১১ নম্বরে ঝুনু পোলাও ঘর।
নীরব হোটেলের ভর্তা-ভাজিঃ ভর্তা-ভাজির কথা বললেই জিভে জল আসে। নাজিমউদ্দিন রোডের ১১৪ নম্বরে নীরব হোটেলের তাই আলাদা সুখ্যাতি আছে।
কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর চাপ, কাটলেটঃ সুস্বাদু খাবারের জন্য ৪৪ বছরের পুরনো কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ রসনাবিলাসীদের প্রিয়। ১৯৭৮ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ। পুরান ঢাকার কবি,সাহিত্যিক,শিক্ষকদের আড্ডার জায়গা ছিলো এটি। এখানে পাওয়া যায় চপ, কাটলেট, মোগলাই পরোটা, চিকেন ফ্রাই স্যুপ। গেন্ডারিয়ার কেশব ব্যানার্জি রোডে ৩৪/১ নম্বর দোকানটি হচ্ছে কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁ।
আলাউদ্দিনের মিষ্টিঃ ঐতিহ্যের পরশে জৌলুশ ধরে রেখেছে আলাউদ্দিন সুইটমিট। ভারতের লক্ষ্মৌ থেকে চকবাজারে এসে মিষ্টি ব্যবসায়ী আলাউদ্দিন হালওয়াই ১৮৯৪ সালে গড়ে তোলেন আলাউদ্দিন সুইটমিট। এটি ঢাকায় প্রথম নামকরা মিষ্টির দোকান। ১৫৬ বছরের পুরনো দোকানটিতে জাফরানি মিষ্টি, স্পঞ্জ রসগোল্লা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য মিষ্টান্ন।
বিউটি লাচ্ছিঃ ঐতিহ্যবাহী বিউটি লাচ্ছির যাত্রা শুরু হয়েছিলো ১৯২২ সালে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আবদুল আজিজ। বর্তমানে আজিজের দুই নাতি পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য সুনামের সঙ্গে ধরে রেখেছেন। ৩০/১ জনসন রোডে অবস্থিত বিউটি লাচ্ছি-ফালুদা।
বিসমিল্লাহ কাবাব ঘরঃ ঐতিহ্যবাহী কাবাবের জন্য ভোজনরসিকদের কাছে অনন্য বিসমিল্লাহ কাবাব ঘর। ১৯৮৭ সালে দোকানটি প্রতিষ্ঠা করেন মো.খোরশেদ। তার মৃত্যুর পর ব্যবসার হাল ধরেন বড় ছেলে হাবিবুর রহমান। নাজিরা বাজারের কাজি আলাউদ্দিন রোডে অবস্থিত এই দোকানে আছে গরুর মাংসের চাপ, গরুর বটি কাবাব, মুরগির পায়ের চাপ ও ব্রেস্ট চাপ, খাসির গুর্দা কাবাব, গরু ও খাসির খিরি কাবাব ও মগজ ফ্রাই।
ঐতিহ্যবাহী বাকরখানিঃ মোগল আমলের প্রসিদ্ধ খাবার বাকরখানি। উত্তাপ ছড়ানো জ্বলন্ত কয়লায় ময়দা দিয়ে তৈরি হয় বাকরখানি। জনশ্রুতি আছে, জমিদার আগা বাকের ও তার প্রিয়সী মুর্শিদাবাদের নর্তকি খনি বেগমের নাম মিলিয়ে এর নামকরণ হয়। লালবাগ কেল্লার কাছে প্রথম বাকরখানি বিক্রি হতো। পুরান ঢাকার ছোট-বড় সব গলিতে এসব দোকান চোখে পড়ে। এগুলোতে বিভিন্ন আকৃতি ও স্বাদের বাকরখানি পাওয়া যায়।
নিউ ক্যাফে কর্নারের ক্রামচাপঃ ছয় দশক ধরে চিরচেনা স্বাদ ধরে রেখেছে নিউ ক্যাফে কর্নার। ১৯৬২ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন হরিনারায়ণ ঘোষ। এর বর্তমান স্বত্বাধিকারী হাজী সোলায়মান। রেস্তোরাঁটির জনপ্রিয় পদ ক্রামচাপ ব্রিটিশরা পছন্দ করতো। খাসির মাংসের এই সুস্বাদু খাবারটি পাউরুটির সঙ্গে পরিবেশন করা হয়।
বাঙালির খাবারের ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যতা ফুটিয়ে তুলতে পুরান ঢাকার খাবারগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো বহুবছর ধরে আমাদের ঐতিহ্যের বহনকারী হিসেবে পরিচিত। কিছু কিছু খাবার তার আগের ঐতিহ্য হয়তো হারিয়ে ফেলছে বা ফেলেছে তবে এখনই সময় পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনার।
লেখক : শিক্ষার্থী, দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়