ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ডেঙ্গু দমনে কন্টাক্ট ট্রেসিং গুরুত্বপূর্ণ

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার

প্রকাশিত: ২১:০৮, ২ নভেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু দমনে কন্টাক্ট ট্রেসিং গুরুত্বপূর্ণ

বিগত সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর তাণ্ডব

বিগত সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ২০২৩ সালে ডেঙ্গুর তাণ্ডব বাংলাদেশের জনজীবনকে ল-ভ- করে দেয়। তিন লাখ একুশ হাজার মানুষের হাড়ভাঙ্গা যন্ত্রণা দিয়ে সতেরোশ’ পাঁচজনের অতি মূল্যবান জীবন কেড়ে নেয় এই প্রাণঘাতী ডেঙ্গু ভাইরাস। একই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালে আজ ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত প্রায় ষাট হাজার লোকের তীব্র জ্বালাতন সৃষ্টি করে দুইশ’ আশি জনের মূল্যবান প্রাণ ঝরিয়েছে। ডেঙ্গুর তীব্রতা লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে। জুলাই থেকে আগস্টে আক্রান্ত তিনগুণ, আগস্ট হতে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনগুণ।

সেপ্টেম্বরে মোট আক্রান্ত ছিল ১৮,০৯৭ এবং মৃত্যু ৮০ জন। সেখানে অক্টোবরের ২৮ তারিখ পর্যন্ত মোট আক্রান্ত ২৭,১৭০ জন এবং মৃত্যু ১১৭ জনের। বুঝতেই পারছেন অবস্থা কত বেগতিক! এই চরম ভয়াবহতার জন্য যত ফ্যাক্টর আছে, সেগুলোর মধ্যে রোগীর কন্টাক্ট ট্রেসিং অন্যতম। ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে আক্রান্ত কম, কিন্তু মৃত্যু বেশি। আবার উত্তর সিটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি হলেও মৃত্যুর সংখ্যা কম। বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, খুলনা, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, রংপুর ও সিলেটে সিটি করপোরেশনের বাইরে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যু কম। এখন প্রশ্ন হলো, রোগীর প্রকৃত ঠিকানা যদি সঠিকভাবে পাওয়া না যায়, তাহলে রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু বাড়াতেই থাকবে।

মনে করুন, বরিশালে আক্রান্ত একজন রোগী যদি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলো এবং তার ঠিকানা দেওয়া হলো ঢাকা। এখন যে সংক্রমিত মশার কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তির ডেঙ্গু হয়েছে, সেই মশাটি কিন্তু ররিশালে স্বাচ্ছন্দ্যে আরও মানুষকে সংক্রমিত করেই চলেছে। আবার সেই সংক্রমিত মানুষ হতে অসংক্রমিত মশা সংক্রমিত হয়ে নতুন মানুষকে আক্রান্ত করছে। একইভাবে যদি উত্তর সিটি করপোরেশনের মশা দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তি ঢাকা মেডিক্যাল বা মুগদা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং ঠিকানা বিভ্রাটের কারণে আক্রান্ত মশা নিজের আনন্দে তার রক্ত শোষণের কাজ করেই চলে, তাহলে আক্রান্তের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়তেই থাকবে।

এইভাবে সিটি করপোরেশন হতে সিটি করপোরেশনের বাইরে অতিদ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ডেঙ্গু কোনো বাধাবিপত্তি ছাড়াই। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। সে জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ কর্মের মধ্যে পড়ে রোগীর সঠিক ঠিকানা নির্ণয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই ঠিকানার চারপাশে কমপক্ষে ২০০ বাড়ির এলাকা পর্যন্ত পুরোপুরি ক্রাশ প্রোগ্রাম চালানো। সচেতনতা ও জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর জন্য ঐ নির্দিষ্ট এলাকার সকল অংশীজনকে সমন্বয় করা।

আমাদের মনে প্রশ্ন জাগার কথা, এত কার্যক্রম তবু মশার ঘনত্ব কমে না কেন? ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু কমে না কেন? আসল কথা হলো সময়, স্থান ও সুনির্দিষ্টভাবে যদি শত্রুকে চিহ্নিত করা না যায়, তাহলে যতভাবেই ফাঁকা গুলি করা হোক না কেন, লাভের লাভ কিছুই হবে না। পূর্ণাঙ্গ মশাকে যেমন ধরা অতি কঠিন কাজ, তেমনইভাবে ডেঙ্গু ভাইরাসকে খুঁজে বের করা এবং ওষুধ প্রয়োগে নির্মূল করা অত্যন্ত দুরূহ বিষয়। তাই মশার প্রজননস্থল খুঁজে খুঁজে বের করে তা নির্মূল করাই শ্রেয়।

সংক্রমিত মশার সংখ্যা যাতে কিছুতেই বাড়তে না পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে অবিরাম। সেই ক্ষেত্রে কীটতাত্ত্বিক সক্ষমতার বিকল্প নেই। একজন কীটতত্ত্ববিদই বলতে পারবেন কখন কিভাবে কোন্ প্রজাতির মশা কোন্ ধরনের প্রজনন ক্ষেত্রে বেশি পরিমাণ বংশবিস্তার করে? কিভাবে একটি মশা ভাইরাস বা প্যাথোজেনিক প্রোটোজোয়া দিয়ে আক্রান্ত হয় এবং রোগ ছড়ায়। 
বাংলাদেশে এই মশাবাহিত রোগ নতুন নয়। বিশে^ ডেঙ্গুজ্বর প্রায় ২৫০ বছরের পুরনো রোগ হলেও আমাদের দেশে এর আবির্ভাব ১৯৬৪ সালে। তারপর ২০০০ সালে। এরপর ২০১৭ সালে আগ পর্যন্ত ঢিলেঢালাভাবে এই রোগটির প্রদুর্ভাব ছিল। ২০১৭ সালে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর মৃত্যু আমাদের আতঙ্কিত করেছে। ডেঙ্গুর প্রভাব বেড়েই চলছে সিটি করপোরেশন হতে বিস্তৃত হয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সিটি করপোরেশনে যে অবকাঠামো এবং জনবল রয়েছে, সে তুলনায় প্রত্যন্ত গ্রামে সেসব সত্যিই অপ্রতুল।

তাই কেন্দ্রীয়ভাবে প্রতিটি বিভাগের জন্য একটি করে এবং প্রতিটি সিটি করপোরেশনের জন্য একটি করে র‌্যাপিড অ্যাকশন টিম সর্বদা প্রস্তুত রাখা অতীব জরুরি। প্রতিটি টিমে অবশ্যই একজন করে কীটতত্ত্ববিদ থাকবেন। ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐ নির্র্দিষ্ট স্থানে ক্রাশ প্রোগ্রাম নিশ্চিত করতে না পারলে কোনোভাবেই ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রোখা সম্ভব হবে না। এর মধ্যে আবার কসমোপলিটান নামক আরেকটা ভেরিয়েন্টের কথা শোনা যাচ্ছে। এই শক্তিশালী ভ্যারিয়েন্টের ওপর গবেষণার মাধ্যমে যেমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, একইভাবে এই ভ্যারিয়েন্ট বহনকারী  মশার কি ধরনের পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তা অবশ্যই গবেষণার আওতায় আনতে হবে। রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে যদি এর বিস্তার হয়ে থাকে, তবে তা কিভাবে রোধ করা যায় তা অবশ্যই গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

বর্তমানে জনস্বাস্থ্যে বিভিন্ন ধরনের সংক্রামক রোগের ইমার্জিং রি-ইমার্জিং ঘটছে। ডেঙ্গু ২৫০ বছরের পুরনো রোগ হলেও ইয়েলো ফিভারও ৪৫০ বছরের পুরনো রোগ। একই বাহক এডিস মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ। কিন্তু এই মশার ঘনত্ব থাকলেও ইয়েলো ফিভারের প্রদুর্ভাব আমাদের দেশে নেই। আবার এ কথাও বলা যাবে না যে, আমরা ইয়েলো ফিভারের ঝুঁকিমুক্ত। কারণ, একই বাহক দ্বারা বাহিত রোগটি যে কোনো সময় ছোবল মারতে পারে। তবে ইয়েলো ফিভার ছড়ানোর জন্য সিলভেটিক সাইকেল, সেমিডোমেসটিক চক্র শেষ করেই আরবান সাইকেল কমপ্লিট করে।

একই বাহক হওয়া সত্ত্বেও ক্রস প্রতিরোধ ও অন্যান্য কারণে রোগটি আমাদের দেশে এখনো প্রতীয়মান হয়নি। এর মধ্যে হয়তোবা জঙ্গলে বা সিলভেটিক সাইকেল বা চক্র সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন এডিস আফ্রিকাস, হেমাগোগাস স্পেসিস, সাবিথেস স্পেসিসের মশা প্রাথমিক চক্র সম্পন্ন করে নন হিউম্যান প্রাইমেটস বা সিম্পাঞ্জির মধ্যে। একই ধারাবাহিকতায় সেমি ডোমেসটিক এডিস প্রজাতি দিয়ে মধ্যবর্তী বা সেমি আরবান চক্র সম্পন্ন করে। তারপর এই মশা জঙ্গলে কাজ করতে যাওয়া মানুষ ও সিম্পাঞ্জির মধ্যে রোগটি ছড়ায়।

সবশেষে এডিস-এজিপ্টি মশা দ্বারা মানুষের মধ্যে ছড়ায় রোগটি। এখন প্রশ্ন হলো, এটাই কি ইয়েলো ফিভারের আমাদের দেশে আবির্ভাব না হওয়ার কারণ। হ্যাঁ, এটা একটি অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে তা অবশ্যই গবেষণার দাবি রাখে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ^ায়নের এই যুগে আফ্রিকাসহ সকল দেশে মানুষ ও বিভিন্ন পশু পাখি ও বন্য পশুর পরিবহন ও যাতায়াতে এই ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া মোটেও অসম্ভব নয়।

তাই নতুন নতুন ভেরিয়েন্ট ও নতুন কোনো রোগের আবির্ভাব ও প্রাদুর্ভাব রোধে রোগের ও রোগীর প্রকৃত ইতিহাস জানা অত্যন্ত জরুরি। এখন সময় এসেছে, এমন দুর্যোগময় পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য রোগীর সঠিক ইতিহাস ও রোগাক্রান্ত হওয়ার সঠিক ইতিহাস জোরালোভাবে জানা এবং সেই মতো ব্যবস্থা গ্রহণ। সকল অংশীজনকে এই বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে।
লেখক : অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ,
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম), মহাখালী

×