ক্ষমতার মধু ও সম্পর্কের মৌমাছি!
যে ফুলে মধু থাকে না মৌমাছি সে ফুলের সীমানায় ভেড়ে না। ক্ষমতা হারিয়ে যেতেই জনতা মুখ ফিরিয়ে নেয়। যারা স্লোগানেস্লোগানে মুখর রাখতো, ভাই ভাই বলে হাঁক চিক মারতো তারা নেতার থেকে মধু ফুরিয়ে গেলে হারিয়ে যায়। কর্মে নিযুক্ত থাকার সময়ে যারা বছর বছর জন্মদিনে উইশ করতো, সকাল-বিকাল ভালোমন্দের খোঁজ খবর নিতো কিংবা শুভাকাঙ্খী সেজে ফোন-মেসেজে বিরক্ত করে ছাড়ত তারাই ফোন পর্যন্ত রিসিভ করবে না।
চেয়ার থেকে নেমে অবসরে ডুবে দেখুন, অনেকেই খোঁজ রাখে না। যতদিন স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছেন, আব্দারমিটিয়ে চলেছেন ততদিন আপনাকে কুর্নিশ করা যেতো। আত্মীয়-স্বজনদের চাওয়া পূরণ করেছেন, বছরে বছরে সাহায্য-উপহার দিয়েছেন- আপনার সুনামে গ্রাম রাষ্ট্র করে ফেলতো। যতদিন কথা শুনেছেন, তাদের স্বার্থ দেখেছেন ততদিন আপনি বড় ভালোলোক ছিলেন।
ক্ষমতা চলে গেছে, চাকুরিতে এসেছে দুর্দিন কিংবা এখন অবসরে- এবার মুখোশে ঢাকা মানুষের মুখটা দেখবেন। মানুষ যে কত জঘন্য হতে পারে তা আপনাকে চরিত্র উদঘাটন করে দেখাবে। এতোদিন যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রশংসা করতো তারাই এখন নিন্দার ঝড় তুলবে। আপনি যে বেজায় খারাপ লোক তা পাড়া পড়শিদের জানিয়ে ছাড়বে।
ক্ষমতায় নাই কিংবা চাকুরি চলে গেছে- কেউ আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবে না। আপনার প্রমোশন, আপনার পদায়ন নিয়ে যারা ফেসবুকে লেখালেখি করতো, আপনি জীবনে বহু উন্নতি করবেন বলে যারা আপনাকে শুভেচ্ছা জানাতো, আপনার ছবি-লেখা শেয়ার করতো তারা এখন আপনাকে বিলকুল ভুলে গেছে। ভাবছেন, এত দ্রুত তো ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়! তবে কী করে ভুললো? যারা আপনাকে ব্যবহার করে স্বার্থ আদায় করেছে তারা আজীবন আপনাকে মনেই রাখেনি! তারা ভালোবেসেছিল আপনার চেয়ার, শ্রদ্ধা-সম্মান জানিয়েছিল আপনার ক্ষমতাকে। কুর্নিশ করতো আপনার বৈষয়িক সক্ষমতাকে! সেসব যেহেতু এখন আর আপনার দখলে নাই সেহেতু আপনিও আর তাদের মনে নাই। বাস্তবতাকে মেনে নিন প্রিয়।
যতদিন ক্ষমতার অংশীদার ছিলেন ততদিন মানুষ মাছির মত চারপাশে ভনভন করতো। আপনার বাহবায় পঞ্চমুখ থাকতো। আপনি কোন ভুল করলেও তা মানবপূজার প্রাসাদ হতো! আপনার বিরুদ্ধে কেউ বললে তার কণ্ঠনালী ছিঁড়ে নেওয়ার তেজ দেখাতো। কিন্তু যেদিন নির্বাচনে জয়ী হননি, ক্ষমতার চেয়ার হারিয়েছেন সেদিন মানুষের যে চেহারা দেখবেন তাতে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করবে। ঘৃণায় আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। হতাশায় চারপাশে অন্ধকার নেমে আসবে।
মানুষ সকাল-বিকালে এমন কী করে বদলায়? যেদিন আর হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সামর্থ্য থাকবে না কিংবা সাহায্যের পথ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিবেন সেদিন জানবেন, মানুষ কী বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করতে পারে। এতোদিন যাদের কাছে রামের ভূমিকায় ছিলেন এখন তারাই আপনাকে রাবণ বানিয়ে ফেলবে। আপনার দুর্দিনে রক্তের মাত্র কয়েকজন মানুষ ছাড়া আর কেউ কাছে থাকবে না। এই বাস্তবতাযতদিনেবুঝবেনততদিন জীবনের জন্য বড্ড দেরীর সময়।
আপনি বস থাকার সময়ে, আপনি সহকর্মী থাকার সময়ে অফিসের সবার থেকে যে আদর-কদর পাবেন, অবসরে সেই অফিসে ফিরলে সেবা ও সম্মানের খুব অল্পই আপনার জন্য থাকবে। যারা আপনার সামনে সম্মান দেখাতে বসতো না পর্যন্ত, আপনার ফোন পেয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলতো, যারা আপনার মুখের কথা বেদবাক্য মনে করতো তারা তাদের দিনে আপনাকে বসতে বলবে কিনা সন্দেহ। আপনার ক্ষমতার দাপটে যে অফিসের দরজা-জানালা কাঁপতো পর্যন্ত সে অফিস আপনাকে চিনবে কিনা সেটাতেও সংশয়।
সুদিন ফুরিয়ে গেলে সুজন পালিয়ে যায়। খুব কম মানুষ তাঁর স্বার্থের বাইরে চিন্তা করতে পারে। স্বার্থেহীনভাবে অন্যকে ভালোবাসতে পারে- এমন মানুষের সংখ্যা আরও কম। এই যে ব্যক্তিপূজা কিংবা দলান্ধতা এসব স্বার্থ পূরণের জন্য। স্বার্থ শুধু অর্থ-সম্পদ কামাইয়ের জন্য নয় বরং ক্ষমতার কাছাাকাছি থাকা, প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখানো কিংবা ভীতি প্রদর্শনও স্বার্থের অংশ।
মানুষ আপনার সাথে কেমন আচরণ করলো তা কোনভাবেই মূখ্য বিবেচ্য নয়। ক্ষমতার মসনদে কাটানোর হালে, গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন কালে কিংবা আপনার সুদিনে মানুষ ছিলেন কিনা সেটা নিশ্চিত করবেন। কে কতটুকু সম্মান দিয়েছে, কে প্রশংসা করেছে আর কে নিন্দা করেছে সেসবের হিসাবনিকাশের চেয়েও জরুরি আপনি আপনার ওপরে সমর্পিত দায়িত্ব সৎভাবে পালন করেছেন কিনা । নাকি যারা মেকি সেলিব্রেশন করেছে, মিথ্যা প্রশংসায় ভাসিয়েছে, স্বার্থ আদায়ের জন্য ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছে- তাদের ভাগে অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন। ক্ষমতা-দায়িত্ব কারোরই চিরকালের নয়। ক্ষণস্থায়ী জীবনে ক্ষমতা-চেয়ারও আর ক্ষণস্থায়ী।
একদিন থামতে হবে। হয় মানুষ নয়তো সময় থামাবেই। বয়সের ফ্রেমে সেভাবেই ভাগ্য এবং আয়ু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই একজীবনে মানুষ চেনা জরুরি। কে ভালোবেসে কাছে আসে আর কে ব্যবহার করে যায়- সে শিক্ষা শিক্ষিতজনের হওয়া উচিত। মিথ্যা প্রশংসায় ভাসলে ডুবতে সময় লাগবে না। যারা ডুবেছে তারা ভুল মানুষকে বিশ্বাস করার বোকামি করেছিল। সমালোচকদের ভেবেছিল শত্রু।
রাজু আহমেদ