ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১

সীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনা

-

প্রকাশিত: ২০:৩৬, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সীতাকুণ্ডে দুর্ঘটনা

সম্পাদকীয়

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এসএন করপোরেশন নামের একটি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে পুরনো জাহাজ কাটার সময় আবারও ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে গত শনিবার। গ্যাস দিয়ে জাহাজের ধাতব পাত কাটার সময় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ গিয়ে পড়ে ফুয়েল ট্যাঙ্কে। আর তাতেই ঘটেছে ভয়াবহ হন্তারক বিস্ফোরণ। ১২ জন আহতের মধ্যে ৮ শ্রমিকের অবস্থা গুরুতর।

তাদের মধ্যে একজন শ্রমিক আহমেদউল্লাহ মারা গেছেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে। যে শিপইয়ার্ডে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি গ্রীন শিপইয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত। বর্তমানে সীতাকু-ে মাত্র ৪টি গ্রীন শিপইয়ার্ড রয়েছে। যেগুলো দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়াতে অনেক নিয়মকানুন মেনে চলে। এর বাইরেও রয়েছে আরও ৩০-৩২টি জাহাজ ভাঙার কারখানা, যেগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই। সে অবস্থায় গ্রীন শিপইয়ার্ডেই যদি এরকম ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকা- ঘটে, তাহলে অন্যগুলোর দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়।

আরও যেটি উদ্বেগজনক তা হলো, গত ১৫ বছরে কারখানাটিতে ১৩ দুর্ঘটনায় মারা গেছেন অন্তত ১২ জন শ্রমিক। আর অন্য সব কারখানা মিলিয়ে গত ৯ বছরে নিহত হয়েছেন ১২৪ জন শ্রমিক। এবারের বিস্ফোরণের ঘটনায় এসএন করপোরেশন ও এমটি স্বরাজ্য স্ক্র্যাপ জাহাজের পরিবেশগত ছাড়পত্র স্থগিত করেছে বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম কেন স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হবে না- সে বিষয়ে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে কারণ দর্শাতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে গঠন করা হয়েছে ৮ সদস্যের কমিটি।
উল্লেখ্য, জাহাজ ভাঙার শিল্প সমূহ ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশ এদিক থেকে বিশে^ প্রায় শীর্ষ স্থান দখল করে আছে। অথচ শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে কর্মরত শ্রমিকদের জন্য আদৌ কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকে না বললেই চলে। এমনকি আহতদের যথোপযুক্ত চিকিৎসাসহ নিহত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও প্রায় নেই। তবু শ্রমজীবী অসহায় মানুষ নিতান্ত পেটের দায়ে এসব কারখানায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। এ নিয়ে অতীতে বহু লেখালেখিসহ বিস্তর সমালোচনা হয়েছে।

তবু বন্ধ করা যায়নি জাহাজ ভাঙা শিল্পের এ অমানবিক কার্যক্রম। এ নিয়ে এবারে প্রশ্ন তুলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন- জাহাজ ভাঙা শিল্পের প্রয়োজন আদৌ আছে কিনা তা নির্ধারণের জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এটি মানুষের জন্য মৃত্যুঝুঁকি ছাড়াও পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী। এটি সাগরকেও দূষিত করছে সমুদ্রের পানিতে তেল ছড়িয়ে দিয়ে। ফলে, মারা যাচ্ছে সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ ও উদ্ভিদ। সব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এ শিল্প সম্পর্কে সুচিন্তিত একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় এসেছে। 
জাহাজ ভাঙা শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও জাহাজ ভাঙা শিল্পের অবদান রয়েছে। এই শিল্প দ্রুত বিকাশের পেছনে কারণ হিসেবে শ্রমিকের সহজলভ্যতা, কাঁচামালের জোগান ইত্যাদির কথা বলা যায়। জাহাজ ভাঙা শিল্প যে অঞ্চলে গড়ে উঠেছে, সে অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস এই শিল্প। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে আড়াই লাখের বেশি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

জাহাজ ভাঙা শিল্পের এই বিশাল অগ্রগতি স্বীকার করলেও এর পরিবেশগত দিক নিয়ে রয়েছে বিস্তর সমালোচনা। এর সঙ্গে জড়িত শ্রমিক ও তাদের স্বাস্থ্যগত দিকের নিরাপত্তা বিধান করতে হবে সবার আগে। যথাযথ প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে হবে। পরিবেশগত ঝুঁকির দিকগুলো চিহ্নিত করে সেসব দূর করার মাধ্যমে এই বিকাশমান শিল্পকে এগিয়ে নেওয়া যায় কিনা, সেটা খতিয়ে দেখা জরুরি।

×