ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১৭ জুন ২০২৪, ৪ আষাঢ় ১৪৩১

মানবতাবাদী নজরুল

​​​​​​​ড. হাফিজ রহমান

প্রকাশিত: ২১:৩৮, ২৪ মে ২০২৪

মানবতাবাদী নজরুল

.

বিদ্রোহীকবিতা মজলুমের পক্ষে অনিন্দ্য, অদ্বিতীয় দুর্বিনীত উচ্চারণ। দুঃশাসক অত্যাচারীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনবদ্য সাহসের ¦লন্ত বারুদবিস্ফোরণ। নির্যাতন, নিপীড়ন, শাসনের নামে শোষণ, দখলতন্ত্রের বিরুদ্ধে মানবতন্ত্রের মানবিকতার সমুজ্জ্বল চেতনার রাজধানী বিদ্রোহী কবিতার প্রতিটি শব্দ। এই কবিতাটির শব্দ চয়ন মার মার কাট কাট হলেও মূলত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সত্য সততার উচ্চারণই এখানে মূল বিষয়। মানুষ মানবতা ছিল নজরুলীয় আদর্শের কেন্দ্র। অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিতরণ তারবিদ্রোহীকবিতার এক অনন্য বৈশিষ্ট্য।শেষের কবিতাউপন্যাস যেমন রবীন্দ্রনাথের সমগ্র সাহিত্য জীবনের সারাংশ, তেমনিবিদ্রোহীকবিতা নজরুল সাহিত্যের সারাংশ। এই কবিতায় নজরুলের বিশ্বাসের সত্ত্বা সৎসাহসে উদ্ভাসিত। বর্তমান বিশ্ব দুই ভাগে বিভক্ত। শাসক শোষিত। সাম্প্রদায়িকতা, অসহিষ্ণুতা, মিথ্যা, কপটতা, ন্ডামি, ফেরেববাজি, অত্যাচার, অনাচার, খুন, গুম, হত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি, সৎ উত্তম মানুষকে একা করে ফেলা, দলগতভাবে অপপ্রচার চালানো, উত্তম চরিত্রের মানুষকে ভিকটিমাইজ করা, কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া এবং সর্বোপরি ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি, এসবই  দুঃশাসকদেরই সৃষ্টি। নজরুলের যুগেও এগুলো ছিল। এখনও বিশ্বব্যাপী ভিন্ন প্রযুক্তিতে বিদ্যমান। নজরুলের জীবদ্দশাতে তারই প্রতিবাদ প্রতিরোধে জুলুমের অবসান হয়।

. ‘বিদ্রোহীকবিতায় নজরুল সত্তা

বিদ্রোহীকবিতায় নজরুল সত্তা মানবতার জয়গানের নামান্তর। এই কবিতায় কবি নজরুল মানুষের মহাত্ম উচ্চারণে নির্ভীক, সততায় আপোসহীন, অন্যায়ের প্রতিবাদে দুঃসাহসী, অবিসংবাদিত অসাম্প্রদায়িক, শাশ^ মানবপ্রেমে সমুজ্জ্বল এবং সত্য প্রতিষ্ঠার চূড়ান্ত অঙ্গীকারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। অপশাসনের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবের শক্তিশালী অভিব্যক্তি বিদ্রোহী কবিতা। যুদ্ধের তেজোদীপ্ত ভাষার অসাধারণ প্রকাশ এই কবিতাটি। শীলিত শব্দের অনন্য প্রয়োগ পরিদৃশ্যমান। মূলত নজরুলের মন মননের, বিশ^াস আস্থার যূথবদ্ধ প্রামাণ্য দলিল এই কবিতার প্রতিটি চরণ, যা নজরুল সত্ত্বার প্রমত্ত পরিচয়জ্ঞাপক। আহমদ রফিকের মতে,

বাস্তবিক পরিশীলিত পরিমার্জিত রাবীন্দ্রিক-বিদ্রোহের সুচারু সূক্ষ্মতায় এবং সার্বিক বিচারে সমকালীন বাংলা সাহিত্যে বিরাজমান পরিমিত গীতধর্মী হার্দ্য উচ্চারণের পটভূমিতে নজরুলই প্রথম সংযোজন ঘটালেন দামামার ক্রুদ্ধ ধ্বনির, তেজোদৃপ্ত আগ্নেয় উচ্চারণের।

. মানুষের মাহাত্ম্য উচ্চারণে নির্ভীকতা : মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ট জীব। পৃথিবীর জাগতিক কোনো কিছুর কাছে কুর্নিশ করা মানুষের স্বভাব হতে পারে না। মানুষের চিন্তা, চেতনা, বুদ্ধি বিবেক সীমাহীন। তাই সসীমের কাছে আত্মসমর্পণ সম্মানজনক নয়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও মানুষকে দাঁড়াতে হবে মহীরুহের ন্যায়। ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ তমাসাচ্ছন্ন রাত কিংবা জলোচ্ছ্বাসে জাগরিত ভয়ংকর সমুদ্রেও মানুষকে মানুষ হয়েই থাকতে হয় অটল, অবিচল। মানুষ সবার ঊর্ধ্বে। তাই মানুষের পরিচয় দিতে গিয়েবিদ্রোহীকবিতায় নজরুল লিখলেন,

বল বীর-/বল উন্নত মম শির!/শির নেহারিআমারি, নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!

বল বীর-

বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি

চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসনআরশছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!’

. অসাম্প্রদায়িকতায় অনবদ্য : নজরুল বিদ্রোহী কবিতায় হিন্দু পুরাণ, মুসলিম ধর্মীয় বিশ্বাসের উপমা গ্রিক পুরাণ ব্যবহার করে মূলত তার পান্ডিত্য প্রকাশ করেননি; বরং এসব ব্যবহার অত্যন্ত সুচিন্তিত অসাম্প্রদায়িকতার বাস্তব প্রকাশ। তাছাড়াবিদ্রোহীকবিতায় বারবার আমি ব্যবহার করে এক অসাম্প্রদায়িক প্রতিবাদী মানুষের প্রতিচ্ছবি নির্মাণ করেছেন, যে অসাম্প্রদায়িক মানুষ ধর্ম-বর্ণ, দেশ-কালের ঊর্ধ্বে উঠে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত বিশ^ গড়ে তুলবে। মানুষের জয়গানই হবে সেখানে মুখ্য। একটি কল্যাণমূলক বিশ্বে স্বপ্নে বিভোর ছিলেন কবি।বিদ্রোহীকবিতার পরতে পরতে সেই চিন্তারই প্রতিফলন দৃশ্যমান। 

. শাশ্ব প্রেমে সমুজ্জ্বল : বিদ্রোহীকবিতায় নজরুল সত্ত্বার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রেমের প্রকাশ। মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক তিনি স্বল্পশব্দের এক পঙ্ক্তিতে তুলে এনেছেন।মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর এক হাতে রণ-তূর্য;’ এক হাতে বাঁশি। সুরসংগীতের অপার শান্তি। আর হাতে রণতূর্য। অন্যায়ের প্রতিবাদ। জুলুমবাজের সঙ্গে মহাসংগ্রামের প্রতীকী প্রকাশ। অর্থাৎ শুধু সংগীতের নরম সুরেই নির্বিবাদী জীবন কাটাতে চাননি কবি। বরং ভালোবাসা যুদ্ধের এক অসামান্য মেলবন্ধন করেছেন। 

. বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট

বর্তমান বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদীদের অত্যাচারে অস্থির। সাধারণ মানুষের জীবন নিদারুণভাবে বিপন্ন। দখলতন্ত্রের বলি হচ্ছে লক্ষকোটি মানুষ প্রতিদিন পৃথিবীর দেশে দেশে। ফিলিস্তিন, ইউক্রেন, ইরাক, মিসর, সিরিয়া, জর্দান, ইয়েমেন, কাশ্মীর, উইঘুর, আরাকান একেকটা মানুষ নিধন অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। যে শিশুটি পৃথিবীকে বোঝে না, মায়ের পেটে অলস বসে থাকে, সে- নিরাপদ নয় এতটুকু। নারী-শিশু অসহায়ের কান্না এদের শ্রবণ-ইন্দ্রিয়কে ভেদ করতে পারে না। কারণ, আর্থিক স্বার্থ যেখানে মুখ্য, মানব জীবনের মূল্য সেখানে গৌণ।  

সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধবাজের মারণাস্ত্রের শিকার মানুষ : যুদ্ধবাজের নির্মম আক্রমণে মানুষ মানব সভ্যতা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। পারমাণবিক বোমার সুইচে মিলি সেকেন্ডের চাপেই শেষ হয়ে যেতে পারে বিশ^ এক মুহূর্তেই। এক সময় যুদ্ধের লক্ষ্য ছিল মিথ্যা ধ্বংস করে সত্য প্রতিষ্ঠা। অমানবিক সমাজ নিঃশেষ করে মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার। আর এখন যুদ্ধ মানে অসত্য অন্যায় প্রতিষ্ঠা। নিরাপরাদ নিরীহ মানুষ হত্যা। এসব দেখে নজরুল খেপে যান। . মুহম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছেন, ‘নজরুলও দুনিয়ার চারিদিকে জালেমের জোরজুলুমে নর-নারীর আর্তনাদ শুনে ক্ষেপে গিয়েছিলেন।

নজরুলবিদ্রোহীকবিতায় লেখেন, ‘আমি উপাড়িফেলিব অধীন বিশ্ব অবহেলে নব-সৃষ্টির মহানন্দে।অধীন বিশ্ব বলতে তিনি পৃথিবীর জিম্মি অবস্থাকে নির্দেশ করেছেন। বিশ্ব মোড়লেরা বিশ্বকে নিজেদের পিতৃসম্পত্তি মনে করেন। মানবতাবিরোধী মোড়লদের হাত থেকে তিনি বিশশ্বকে মুক্ত করার সুতীব্র আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। ক্ষমতা সাংঘাতিক নেশা সৃষ্টি করে। ক্ষমতাসক্তরা কখনও ন্যায় বিচার করেন না। বস্তুত ন্যায় বিচার করার সৎ সাহসও তাদের থাকে না। অবৈধভাবে দেশ বিশ্বকে শাসন শোষণ করার জন্যই স্বৈরাচারেরা অস্ত্রের আঘাত হানে নিরীহ জনপদে। বিশ্ব সন্ত্রাসের মাধ্যমে প্রতিবাদী মানুষকে জিম্মি করে রাখে। কাজী নজরুল এসবের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করতেইবিদ্রোহীকবিতা লেখেন।  

. অন্যায় নিরসনের উপায়

পৃথিবীর এই যুদ্ধ বিগ্রহ বন্ধ করার জন্য প্রয়োজন শান্তি আন্দোলন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নজরুলীয় বিদ্রোহ ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন সমগ্র বিশ্বে; যে বিদ্রোহে মানুষ পাবে তার ন্যায্য অধিকার। ধনী-গরিব, চাষি-তাঁতি, কুলি-মজুর, সাদা-কালো, মালিক-শ্রমিক সবাই একই শান্তির পতাকা তলে খুঁজে পাবে জীবনের সত্যিকার বোধ। একটি অসাম্প্রদায়িক শাসন ব্যবস্থাই একটি অসাম্প্রদায়িক পৃথিবী উপহার দিতে পারে। একটি সাম্রাজ্যবাদমুক্ত সমাজই সত্যিকার মানবিক সমাজ। এর বাইরের সমাজের নাম কপট-সমাজ। যেখানে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে কপটতার জয়জয়কার। এই ধরনের কপট-সমাজের নেতারা মুখে মুখে যতই শান্তির বাণী প্রচার করুক না কেন, অন্তরে তাদের এটম বোমার বসবাস।

এসব কপটতা থেকে বাঁচতে হলে নজরুলচর্চা বাড়াতে হবে। কারণ নজরুলেরবিদ্রোহশুধু ব্যক্তিবিরোধের বিদ্রোহ নয়। বরং তাঁর বিদ্রোহ ব্যাপক বিস্তৃত। সমগ্র বিশ্বে কুশাসনের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। সমগ্র বিশে^ নিপীড়িত পরাধীন জাতির মুক্তির জন্য তাঁর বিদ্রোহ। এই বিষয়ে প্রয়াত সাহিত্যিক কবীর চৌধুরীর মত- প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘পরাধীনতার ¦ালা নিঃসন্দেহে নজরুলের বিদ্রোহ-বহ্নি বহুলাংশে প্রজ¦লিত করেছে, কিন্তু শুধু দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভের তাঁর বিদ্রোহী-চিত্তের তৃপ্তি হত না। তাঁর বিদ্রোহের রূপ ছিল আরো ব্যাপক।নজরুলের বিদ্রোহ তাই দেশ কালের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্রোহ। সর্বজনীন এই দ্রোহের মাধ্যমে মানবাধিকার অনুপুঙ্খভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে এটাই ছিল তাঁর পরম প্রত্যাশা। তাই সোজা কথায় তিনিবিদ্রোহীকবিতায় লিখলেন, ‘আমি পরশুরামের কঠোর কুঠার, নিঃক্ষত্রিয় করিব বিশ্ব, আনিব শান্তি শান্ত উদার!’

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপটে নজরুলেরবিদ্রোহীকবিতার উপযোগিতা সীমাহীন। নজরুলের অসাম্প্রদায়িক সত্ত্বার শান্তিযুদ্ধের প্রবল প্রয়োজন; যে যুদ্ধে সৃষ্টি হবে একটি মানবিক বিশ্ব মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারবে।

লেখক : নজরুল গবেষক

 

×