ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২১ মে ২০২৪, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

লজ্জিত পাকিস্তান গর্বিত বাংলাদেশ

তাপস হালদার

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ৩০ এপ্রিল ২০২৪

লজ্জিত পাকিস্তান গর্বিত বাংলাদেশ

তাপস হালদার

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকেই পাকিস্তানের চেয়ে কয়েক ধাপ এগিয়ে আছে। বিষয়টি এতদিন সেদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যম ব্যক্তিরা বারবার বললেও রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এমন স্বীকৃতি বিস্ময়ের বৈকি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ভূয়সী প্রশংসা করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে তাকালে আমাদের লজ্জা হয়।

সে সময় পূর্ব পাকিস্তানকে দেশের বোঝা মনে করা হতো। আমি তখন খুবই ছোট ছিলাম- আমাদের বলা হতো যে, এটা আমাদের কাঁধে একটা বোঝা। আজ আপনারা সবাই জানেন সেই বোঝা এখন কোথায় পৌঁছেছে। এখন আমরা যখন তাদের দিকে তাকাই, তখন আমরা লজ্জিত হই।’ 
পাকিস্তানের ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি একথা বলেন। ঠিক একইভাবে বাংলাদেশের প্রশংসা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রীর বড় ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ প্রেসিডেন্ট নওয়াজ শরীফ। তিনি গত অক্টোবরে নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্যকালে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেছিলেন, ‘তখন আমরা বলেছি, এরা শুধু পাট চাষ করে এবং এরা আমাদের বোঝা। আমরা সেই বোঝা তুলে মাটিতে ছুড়ে ফেলেছিলাম। এখন দেখুন,  সেই বাংলাদেশ উন্নয়নে আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। আর আমরা পেছনেই রয়ে গেছি।’
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবসময়ই একটা অস্থিরতা ছিল, এখনো আছে। এটি দেশটির উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা। বাংলাদেশেও একটা দীর্ঘ সময় অস্থিরতা ছিল। তখন উন্নয়নও থমকে গিয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা পনেরো বছর সরকার পরিচালনায় দেশকে স্থিতিশীলতা দিতে পেরেছে বলেই বাংলাদেশ আজকের পরিস্থিতিতে আসতে পেরেছে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগত উন্নয়ন। শিল্পের জন্য প্রয়োজন নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও গ্যাস। বাংলাদেশে সড়ক ও রেলযোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সারাদেশকে যোগাযোগের নেটওয়ার্কে নিয়ে আসা হয়েছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুতের সেবা পাচ্ছে। অন্যদিকে এখনো পাকিস্তানের ২৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সেবা থেকে বঞ্চিত।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৯৪ ডলার। পাকিস্তানে ছিল ১৫০ ডলার। বাংলাদেশের ৫০০ ডলার হতে সময় লাগে ৩১ বছর। অর্থাৎ ২০০৩-০৪ সালে ৫১০ ডলার হয়। ১ হাজার ডলার হতে লাগে আরও দশ বছর। অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে হয় ১ হাজার ৫৪ ডলার। পরের দশ বছরে প্রায় তিনগুণ বেড়ে যায় অর্থাৎ ২৭৬৫ ডলার হয়েছে।

পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এক শতাংশের অনেক কম অর্থাৎ ০.২৯ শতাংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশে এক দশকের বেশি সময় ধরে ছয় শতাংশের বেশি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অন্যদিকে এই সময়কালে পাকিস্তানের প্রবৃদ্ধি তিন-চার শতাংশের মধ্যে ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে এক শতাংশের নিচে নেমে গেছে।
বিগত পনেরো বছরে উন্নয়নের মহাসড়কে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকা-কক্সবাজার রেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, পায়রা বন্দর, মাতারবাড়ি ও পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, বঙ্গবন্ধু রেলসেতু, দেশজুড়ে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ মেগা প্রকল্পগুলো  বাস্তবায়ন করে দেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করেছে। পাকিস্তানের চেয়ে মাথাপিছু আয়, রপ্তানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, গড় আয়ুসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, মাথাপিছু আয়ে অনেক আগেই পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের জিডিপির আকার ৪৬০ ডলার। পাকিস্তানের ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের চেয়ে দ্বিগুণ। বাংলাদেশে ২৭৬৫ ডলার।

পাকিস্তানে ১৩৯৯ ডলার। রপ্তানি আয় পাকিস্তানের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি। বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫৫৫৬ কোটি ডলার। পাকিস্তানে ২৮০০ কোটি ডলার। মুদ্রাস্ফীতি তিন গুণের কমÑ বাংলাদেশে ৯.৪৯ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৯.২০ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ছয় গুণ বেশিÑ বাংলাদেশে ২৯১৬ কোটি ডলার, পাকিস্তানে ৫১৫ কোটি ডলার। এক ডলারের দাম বাংলাদেশে ১১০ টাকা, পাকিস্তানে ২৮৩ রুপি।
নারীর ক্ষমতায়নে রোলমডেল বাংলাদেশ। অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো গার্মেন্টস সেক্টর। এই সেক্টরের ৮০ শতাংশই নারী কর্মী। সেখানে পাকিস্তানে মাত্র ১০ শতাংশ নারী গার্মেন্টসে কাজ করে। এজন্যই পাকিস্তান তুলা উৎপাদনকারী দেশ হওয়া সত্ত্বেও পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে। চীনের পরই বাংলাদেশ দ্বিতীয় পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। সেখানে পাকিস্তান শীর্ষ দশের তালিকায়ও নেই। বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণের কারণে এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তানে ঘরের বাইরে কাজ করা নারীর সংখ্যা মাত্র ১৪ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশে প্রায় ৪০ শতাংশ।
উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশকে বলা হয় ‘এশিয়ান এমার্জিং টাইগার’। অন্যদিকে পাকিস্তানকে বলা হয় ‘সন্ত্রাসীদের কেন্দ্রস্থল কিংবা অভয়ারণ্য।’ সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদকে সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে লালন-পালন করা হয়। ওসাবা বিন লাদেন কিংবা দাউদ ইব্রাহিমসহ জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের  নিরাপদ আশ্রয়স্থল পাকিস্তান। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর যে গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল, সে গ্রেনেডের উৎস ও জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিল পাকিস্তান। এখনো সে সময়কার পলাতক জঙ্গিরা পাকিস্তানে আশ্রিত আছে। বাংলাদেশ, ভারত, আফগানিস্তানসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে জঙ্গি হামলার ক্ষেত্রে আল-কায়দা ও তালেবানদের অর্থায়নে দেশটির সরকার দীর্ঘদিন ধরে সম্পৃক্ত। সেখানে রাষ্ট্রীয় মদতে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া হয়।  
বাংলাদেশের বিস্ময়কর উত্থানের রূপকার বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনা। তাঁর গতিশীল ও দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের কারণেই এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে। বিশ্বখ্যাত প-িত ব্যক্তিরা সংকট বিমোচনে শেখ হাসিনার নীতিকে অনুসরণ করার পরামর্শ দেন। ২০২২ সালের ২ আগস্ট পাকিস্তানের পত্রিকা দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউনে ‘টেক অ্যাওয়ে ফ্রম বাংলাদেশ লিডারশিপ’ নামে  একটি নিবন্ধ লেখেন সাহেবজাদা রিয়াজ নূর (কেমব্রিজ পড়ুয়া মি. নূর খাইবার পাখতুন প্রদেশের মুখ্য সচিব ছিলেন)।

তিনি লেখেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দূরদর্শী ও দৃঢ় প্রত্যয় ধারণ করেন। তিনি মনে করেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায়। গত ১৫ বছরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন। পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। তবে প্রধান পদক্ষেপটি হওয়া উচিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারের বিষয়টি অনুসরণ করা, যা প্রতিরক্ষা এবং গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।’
অর্থনৈতিক সূচকে শুধু পাকিস্তানই নয়, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরেই বাংলাদেশের  অবস্থান। খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের কাছে বাংলাদেশ এখন বিস্ময়কর উপাখ্যান। বিশ্বের স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে রোলমডেল। পাকিস্তানে জোর দাবি উঠেছে, তারা এখন ‘বাংলাদেশ মডেল’ হতে চায়। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত গর্বের বিষয়। 

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা
সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

haldertapas80@gmail

×