ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

জোয়ারে স্বপ্ন, ভাটায় জীবন: কলাপাড়ার জেলেদের সংগ্রামের গল্প

তানজিল জামান জয়, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কলাপাড়া, পটুয়াখালী

প্রকাশিত: ১০:৫৭, ২২ জুন ২০২৫

জোয়ারে স্বপ্ন, ভাটায় জীবন: কলাপাড়ার জেলেদের সংগ্রামের গল্প

ছবি: দৈনিক জনকণ্ঠ।

ভোরবেলা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতের পাশ ঘেঁষে থাকা জেলেপল্লীতে হালকা কুয়াশা। দূরে সমুদ্র থেকে ফিরছে মাছভর্তি কাঠের ট্রলার। ডাঙ্গায় পা রাখতেই চোখে পড়ে ফারুক হাওলাদার  নামের এক মাঝির মুখে বিজয়ের হাসি। আজ সাগর তাকে খালি ফেরায়নি—পোয়া, চিংড়ি, ইলিশে ভরে গেছে জাল।

কলাপাড়া উপজেলার কুয়াকাটা, মহিপুর, লতাচাপলি, চাকামইয়া ও আলীপুরসহ একাধিক ইউনিয়নে গড়ে উঠেছে শত শত জেলে পরিবার। এদের জীবনের প্রতিটি ধাপ সমুদ্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। জোয়ারে যেমন স্বপ্ন বাঁচে, তেমনি ভাটার স্রোতে হেলে পড়ে অনেক জীবন।

“জেলেরা শুধু মাছ ধরেন না, জীবনটা দিয়ে দেন সমুদ্রে। আমরা রোজকার বাঁচা-মরার লড়াই করি,” — বলেন ৬২ বছর বয়সী জেলে কালাম ফকির।
জীবন যেখানে সমুদ্রনির্ভর

কলাপাড়ার উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিদিন ভোরেই সাগরে নামে শত শত মাছ ধরার ট্রলার। তাদের প্রত্যাবর্তন কখনো আনন্দের, কখনো শোকের। বহু জেলে সমুদ্রে হারিয়ে যান, ফিরতে পারেন না আপনজনের কাছে। মাঝেমধ্যে সাগরে  ইঞ্জিন বিকল কিংবা দুর্যোগের কবলে পড়ে একাধিক ট্রলার নিখোঁজ হয়।

মহিপুর ও আলীপুর ফিশারী ঘাটে এমন বহু পরিবারের দেখা মেলে, যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরে পাড়ি জমিয়ে মাছ ধরে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখে, অথচ তারাই সবচেয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি। 

কলাপাড়ার উপকূল ঘূর্ণিঝড় প্রবণ এলাকা হওয়ায় এখানকার জেলেদের জীবনে ঝুঁকি যেন নিত্যদিনের সাথী। ‘সিডর’, ‘আইলা’, ‘আম্পান’, কিংবা সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় ‘রেমাল’—প্রতিটি দুর্যোগেই তারা হারিয়েছে ঘর-বাড়ি, প্রিয়জন, জীবিকা।

কলাপাড়ার একাধিক আশ্রয়কেন্দ্রে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় আসার আগেই জেলে পরিবারগুলো তড়িঘড়ি করে আশ্রয়ে ছুটে যায়। শিশু-কিশোরদের মুখে তখনও একটাই প্রশ্ন—“বাবা কি এবার ফিরবে?”

তবুও জীবন থেমে থাকে না। রুহুল আমিনের মতো হাজারো জেলে প্রতিদিন নতুন আশায় জাল ফেলেন। তার স্ত্রী হাসিনা বেগম বলেন, “ উনি সাগরে যায়, আমি ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাই। ওরা যেন লেখাপড়া করে জাল নয়, কলম ধরে—এই আশাতেই বাঁচি।”

কলাপাড়ার বিভিন্ন এলাকায় এখন কিছু স্বনির্ভর নারীদল মাছ শুকানো, পিঠা বানানো বা সেলাইয়ের কাজ করে সংসারে আলোর মুখ দেখছে। তরুণেরা গড়ে তুলেছে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ, বরফকল এবং রপ্তানিমুখী উদ্যোগ।

জেলেপল্লীর জীবন নিছক পেশার গল্প নয়—এ এক জীবন-সংগ্রামের মহাকাব্য। কলাপাড়ার জেলেরা জোয়ারের সঙ্গে বয়ে আনে রুটি, ভাটার সঙ্গে লড়েন বেঁচে থাকার জন্য।

এই উপকূলের প্রতিটি ঢেউ যেন সাক্ষী—কত শত জীবন প্রতিদিন সাহসে গড়ে উঠে, আবার ঢলে পড়ে। তবুও ভাটায় নামা জীবনও আশায় জেগে থাকে। কারণ, আবার আসবে জোয়ার। আবার ভাসবে স্বপ্ন।

মিরাজ খান

×