ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ জুন ২০২৫, ৮ আষাঢ় ১৪৩২

সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকতেই হবে

মেহেদী কাউসার

প্রকাশিত: ১৫:৪২, ২২ জুন ২০২৫; আপডেট: ১৫:৪৮, ২২ জুন ২০২৫

সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকতেই হবে

ছ‌বি: প্রতীকী

বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, সংঘাত আর রক্তপাত যেন এখন প্রতিদিনের খবর। গাজার ধ্বংসস্তূপে খেলনা খুঁজছে শিশু, তেহরানের আকাশে উড়ছে যুদ্ধবিমান, ইউক্রেনের শহর ধ্বংস হয়ে গেছে, আর মিয়ানমারের রোহিঙ্গা শিবিরে মানবেতর জীবন চলছে। প্রতিটি জায়গায় একই চিত্র— মানুষ মরছে, ঘর হারাচ্ছে, স্বপ্ন ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু বিশ্বনেতারা শুধু সভা করছেন, ভাষণ দিচ্ছেন। বাস্তব কোনো শান্তির উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

সম্প্রতি ইসরায়েল সরাসরি ইরানে হামলা চালিয়েছে। লক্ষ্য ছিল পারমাণবিক কেন্দ্র, ক্ষেপণাস্ত্র ঘাঁটি এবং আবাসিক এলাকাও। এতে শত শত নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে, আহত হয়েছেন বহু নারী ও শিশু। সবশেষে যুক্তরাষ্ট্রও সরাসরি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো ধ্বংসে হামলা চালিয়েছে।

ইরান-ইসরায়েল এই সংঘাত এখন সরাসরি যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। ইরান পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের হাইফা ও তেল আবিবে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে। গোটা মধ্যপ্রাচ্য এই উত্তেজনায় আতঙ্কিত। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।

দক্ষিণ এশিয়ার চিত্রও স্বস্তিদায়ক নয়। ভারতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা বেড়েই চলেছে। আসাম, গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি— প্রতিটি জায়গায় কোনো না কোনোভাবে একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। নাগরিকত্ব ইস্যু, গুজব, রাজনৈতিক উসকানি সব কিছু মিলিয়ে ভারতীয় সমাজে বিভাজন বাড়ছে। এর প্রভাব পড়ছে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত উত্তেজনাও ঘন ঘন যুদ্ধাবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে।

বাংলাদেশেও রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থির। মতপ্রকাশের সুযোগ সীমিত হয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের মূল্যবোধ প্রশ্নবিদ্ধ। তরুণ সমাজ হতাশ, শিক্ষিতরা দেশ ছাড়ার কথা ভাবছে। সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক বিভক্তির শিকার।

বিশ্লেষকদের মতে, এই বৈশ্বিক অস্থিরতার মূল কারণ হলো মানুষে মানুষে বিভাজন। ধর্ম, জাতি, ভাষা, রাজনীতি কিংবা ইতিহাস— সব কিছুর ভিত্তিতে আমরা একে অপরকে আলাদা করছি। অথচ মানুষই মানুষের মূল পরিচয় হওয়া উচিত।

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন, “সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।” আজ এই পঙ্‌ক্তি শুধুই কবিতা নয়, বরং একটি প্রজন্মের চেতনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে আমাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো নতুন প্রজন্মের জন্য একটি মানবিক সমাজ রেখে যাওয়া। যেখানে মতের ভিন্নতা মানেই শত্রুতা নয়, ধর্মের ভিন্নতা মানেই হুমকি নয়, জাতির ভিন্নতা মানেই অবিশ্বাস নয়। যেখানে মানুষকে মূল্যায়ন করা হবে তার নৈতিকতা, কাজ ও আচরণ দিয়ে, ধর্ম বা গোষ্ঠী দিয়ে নয়।

বিশ্ব রাজনীতি এখন অর্থ আর শক্তির মোহে অন্ধ। যারা শান্তির কথা বলে, তারাই অস্ত্র বিক্রি করছে। যারা মানবাধিকার রক্ষার কথা বলে, তারাই চোখ বুঁজে গণহত্যা এড়িয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিচারিতা বন্ধ করতে হলে, পরিবর্তনের সূচনা করতে হবে ব্যক্তি থেকে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র— সব স্তরে গড়ে তুলতে হবে সাম্যের চর্চা।

যদি আমরা সত্যিই একটি নিরাপদ ভবিষ্যৎ চাই, তবে এখনই ঘৃণার রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। যুদ্ধের বদলে কূটনীতি, দমনের জায়গায় সংলাপ, দখলের পরিবর্তে সহাবস্থান— এই মূল্যবোধকে গ্রহণ করতে হবে।

সব বিভেদের রেখা একদিন মুছে যেতেই হবে। প্রশ্ন হচ্ছে, তা কি আমরা নিজেরা করবো, না কি নতুন প্রজন্মের রক্ত দিয়ে সেটা মুছে যাবে? আমাদের এখনই এ ব্যপারে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

শান্তি কেবল কোনো চুক্তি নয়, এটি একটি মানসিকতা। এটি জন্ম নেয় মানুষের হৃদয় থেকে, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা থেকে। তাই মানবতার স্বার্থে, প্রজন্মের স্বার্থে, ইতিহাসের স্বার্থে এখনই আমাদের সাম্যের পথে হাঁটতে হবে। কথায় নয়, কাজে। প্রতিজ্ঞায় নয়, পদক্ষেপে। তবেই ভবিষ্যতের পৃথিবী হবে মানুষের পৃথিবী।

লেখক: সাংবাদিক

এম.কে.

×