
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ শুধু একটি খাদ্য উপাদান নয়, এটি একটি ঐতিহ্য, আবেগ ও অর্থনীতির চালিকাশক্তি। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে, এবং এই মাছটি রপ্তানি, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, পদ্মা-মেঘনার ঘাটে ইলিশ ধরা পড়লেও এর বাজারমূল্য, বণ্টনব্যবস্থা এবং সাধারণ মানুষের নাগালের প্রশ্নে নানামুখী সংকট দেখা যাচ্ছে। “ঘাটে ধরে, বাজারে হারায়”—এই কথাটি এখন আর শুধু প্রবাদ নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫.৭ লাখ মেট্রিক টনের বেশি ইলিশ উৎপাদিত হয়েছে, যা বৈশ্বিক ইলিশ উৎপাদনের ৮৫%–এরও বেশি। পদ্মা, মেঘনা ও উপকূলীয় নদীসমূহে কার্যকর জাটকা সংরক্ষণ, নিষেধাজ্ঞা ও বিকল্প জীবিকা সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ করায় এই উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩০%। সরকারের ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা, কোস্টগার্ড ও নৌবাহিনীর অভিযান এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে ইলিশ প্রজননের গতি বেড়েছে, যা নিঃসন্দেহে একটি সফলতা।
কিন্তু ইলিশের এই উৎপাদন বৃদ্ধির সুফল কি জনগণের টেবিলে পৌঁছাচ্ছে? বাস্তবতা হলো, রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে ইলিশের বাজারমূল্য গড়ে প্রতি কেজি ১২০০–২০০০ টাকা, যা সাধারণ নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। অথচ উপকূলীয় ঘাটে জেলেরা অনেক সময় মাত্র ৫০০–৬০০ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই বৈষম্যের পেছনে রয়েছে একাধিক সমস্যা—দ্রব্য মজুদদার, মধ্যস্বত্বভোগীদের আধিপত্য, সরকার নির্ধারিত মূল্যের অভাব এবং বিপণন ব্যবস্থায় সমন্বয়ের ঘাটতি।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইলিশ ধরা থেকে শুরু করে বাজারে পৌঁছানো পর্যন্ত অন্তত ৫–৭টি পর্যায়ে হাতবদল হয়। প্রত্যেকটি স্তরে মুনাফা যোগ হতে হতে চূড়ান্ত মূল্য কয়েক গুণ বেড়ে যায়। অথচ এই সময় জেলেরা পান না ন্যায্য দাম, আর ভোক্তারা পান না স্বস্তি। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন (BFDC)-এর ভূমিকা এখানে আরও সক্রিয় হতে পারত। তারা যদি নির্ধারিত মূল্যে প্যাকেজ করা হিমায়িত ইলিশ বাজারজাত করতো, তবে একদিকে যেমন বাজারে ভারসাম্য আসত, তেমনি ইলিশের ‘ভিআইপি’ ভাবমূর্তিও কিছুটা হলেও কমে আসত।
এদিকে সরকার ইলিশ রপ্তানির ওপর কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে, যাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ হয়। তবু মাঝে মাঝে রপ্তানির অনুমোদন দেওয়া হয়, যা নিয়ন্ত্রণের অভাবে আরও বাজার অস্থির করে তোলে। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্থানীয় চাহিদা, মজুত পরিস্থিতি, এবং উৎপাদন পর্যালোচনা করে নিয়ন্ত্রিত রপ্তানিনীতির প্রয়োজন রয়েছে।
একইসঙ্গে ভাবতে হবে জেলেদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিয়েও। সংরক্ষণকালে সরকার চাল সহায়তা, বিকল্প কর্মসংস্থান প্রকল্প ও নগদ ভাতা প্রদান করে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, প্রকৃত জেলেরা এই সহায়তা থেকে বঞ্চিত হন, অন্যদিকে প্রভাবশালীরা তালিকাভুক্ত হন। তাই ডিজিটাল জেলে নিবন্ধন ও স্মার্ট কার্ড বিতরণের মাধ্যমে সঠিক ব্যক্তি সনাক্ত ও সহায়তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনার জন্য মৎস্য খাতভিত্তিক একটি একক জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি, যেখানে ইলিশ উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিপণন, পরিবহন ও রপ্তানি—সবকিছুর জন্য একটি একীভূত নির্দেশনা থাকবে। বর্তমান ব্যবস্থায় বিভিন্ন সংস্থার দায়িত্বের দ্বৈততা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
জনগণের পক্ষ থেকে ইলিশ নিয়ে আবেগ স্বাভাবিক, তবে বাস্তবতাও কঠিন। কেউ কেউ বলেন, “ইলিশ তো এখন গরুর মাংসের চেয়েও দামী।” তাই বিশ্লেষকরা বলছেন, সচেতন ভোক্তা হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব রয়েছে—যেমন অতিরিক্ত চাহিদা না তৈরি করা, ভেজাল ইলিশ না কেনা, এবং প্রয়োজনে সরকার নির্ধারিত বিক্রয় পয়েন্ট থেকে পণ্য ক্রয় করা। ইলিশ যদি শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের উপভোগ্য পণ্য হয়, তবে তা জাতীয় মাছ হয়ে ওঠে না—এটি হয়ে দাঁড়ায় বিশেষ শ্রেণির প্রতীক।
ইলিশ সংরক্ষণে যেমন আমরা সফল হয়েছি, তেমনি বাজার ও সরবরাহ ব্যবস্থায়ও টেকসই কৌশল গ্রহণ না করলে এই সফলতা খুব বেশিদিন স্থায়ী হবে না। মাছ ধরার নৌকা থেকে শুরু করে ভোক্তার প্লেট পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে স্বচ্ছতা, প্রযুক্তির ব্যবহার, এবং ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দরকার।
উপসংহারে বলা যায়, পদ্মার রূপালি সোনা যেভাবে নদীতে ধরা পড়ে, সেই সোনার শোভা যেন কেবল সংবাদপত্রের শিরোনামে আটকে না থাকে। এটি যেন দেশের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে, প্রতিটি মানুষের খাবারের টেবিলে জায়গা করে নেয়। সংরক্ষণ যদি রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়, তবে বিতরণ ও মূল্যনিয়ন্ত্রণও নাগরিক অধিকার। আর এই দ্বৈত পথেই সত্যিকারের “জাতীয় মাছ” ইলিশ হয়ে উঠবে অর্থনীতির চালিকাশক্তি এবং সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের অন্যতম বাহক।
লেখক: যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক: সার্ক কালচারাল সোসাইটি বাংলাদেশ। E-mail: [email protected]
এম.কে.