ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৪ মে ২০২৪, ৩০ বৈশাখ ১৪৩১

তাপপ্রবাহ নিরসনে বৃক্ষরোপণ

কাজী বনফুল

প্রকাশিত: ২১:৫৩, ২৮ এপ্রিল ২০২৪

তাপপ্রবাহ নিরসনে বৃক্ষরোপণ

.

তীব্র দাবদাহে পুড়ছে দেশ সকলে বৃষ্টির জন্য হাহাকার করছে যে যার মতো প্রার্থনায় নিমজ্জিত বৃষ্টি শীতলতার আমরা নিজেদের গলায় ইচ্ছাকৃতভাবে যে ফাঁস লাগিয়েছি সে ফাঁস আমাদের নিশ্বাসকেই চেপে ধরেছে কঠিন অবরুদ্ধতায় এখন নিজেদের ফাঁদে নিজেরাই আটক হয়ে কান্নাকাটি করছি মাঠে ময়দানে অথচ কত বড় বড় বৃক্ষ ছিল আমাদের, সবুজের সমারোহে সমৃদ্ধ ছিলাম আমরা সে সকল প্রাণবন্ধু গাছগুলোকে কেটে উজাড় করেছি নিষ্ঠুর রসিকতায়

যখন কোনো অঞ্চলে তাপকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো শক্তি কমে যায়, ঠিক তখনই সে অঞ্চলে তাপমাত্রার বৃদ্ধি ঘটে বৃক্ষ হচ্ছে তাপকে প্রশমিত করার সেই আদি অস্ত্র যা আমরা ধীরে ধীরে হারাতে বসেছি জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে মানুষ বন-বৃক্ষ উজাড় করে ফেলছে গত ২০ বছরে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে তার অর্ধেকও নতুন করে রোপণ করা হয়নি আর যা রোপণ করা হয়েছে সেটা বড় হতে হতে আরও অনেক বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হবে এই যে বৃক্ষের শূন্যতার সার্কেল, এটা পূরণ করতে আমাদের বহু সময় কেটে যাবে বা প্রায় অসম্ভব অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে গাছ কেটে গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন নতুন ঘর-বাড়ি এবং আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি ইটভাঁটি উত্তপ্ত চুল্লির ভেতর

অথচ খুব বেশি আগের কথা নয় গ্রীষ্মের এমনই উত্তপ্ত দিনে এক সময় দাদার সঙ্গে পিয়াজখালি হাটে যেতাম আমাদের অঞ্চলে পিয়াজখালি হাট ছিল সবচেয়ে বড় হাট হাট শেষে যখন বাড়ির পথে ফিরতাম তখন দেখতাম অনেক হাঁটুরে বড় বড় গাছের নিচে তাদের পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য বিশ্রাম নিচ্ছে আমরাও সেখানে বসে বিশ্রাম নিতাম বড় গাছগুলোকে ভেদ করে সূর্যের তাপিত রশ্মি মাটিকে স্পর্শ করতে পারত না, শীতলতার এক অদৃশ্য চাদরে আচ্ছাদিত থাকত চারপাশ সে সময় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৬-৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ভেতর থাকত গাছগুলো দেখে মনে হতো যেন নিজের মায়ের মতো আঁচল বিছিয়ে সন্তানদের ক্লান্তি দূর করছে কি দারুণ চমৎকার দৃশ্য ছিল সকলে এক সঙ্গে বসে দীর্ঘপথের ক্লান্ত হৃদয়কে গল্পে গল্পে শান্ত শীতল করে বাড়ির পথে যাত্রা করত তখন যে বড় বড় গাছ দেখতাম সে সকল গাছের অধিকাংশই এখন আর নেই গাছগুলোর কিন্তু স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি, গাছগুলোকে হত্যা করা হয়েছে নতুন নতুন বাড়ি উঠেছে সে সকল গাছ কেটে তখন দূর থেকে গাছগুলো দেখলে মনে হতো সবুজের উঁচুনিচু পাহাড়ের ঢেউ, অথচ এখন দূর থেকে সে সকল জায়গা দেখলে মনে হয় কংক্রিটের প্রাচীর আর টিনের চকচকে বাসনের থালা যেন সূর্যের তাপে জ্বলজ্বল করছে আমাদের একান্নবর্তী পরিবারগুলো যখন স্বার্থ এবং অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করল, ঠিক তখন থেকেই আমরা গাছগুলোকে উপড়ে ফেলে গড়তে লাগলাম নতুন নতুন ঘর আমরা একদিকে যেমন একা হতে লাগলাম, তেমনি একইভাবে আমাদের চারপাশের গাছগুলোর পরিমাণও কমতে লাগল এক জন্মজন্মান্তরের সম্পর্কের বিচ্ছেদ আমরা যেন নিজেরাই নিজেদের বিপদকে বরণ করেছি প্রচন্ড আগ্রহ সমেত বৃক্ষহীন পৃথিবী আর নরকের মাঝে খুব বেশি তফাৎ থাকার কথা নয় এই হলো আমার তৎকালীন বর্তমান গ্রামের অবস্থা

এবার আসি শহরের গল্পে ছোটবেলা থেকেই একটা প্রবাদ অনেকবার শুনেছি, সেই চিরচেনা প্রবাদটি এখানে বেশ কার্যকর বটেঅন্নদামঙ্গলকাব্যে ভারতচন্দ্র রায় গুণাকর বলেছিলেন- নগর পুরিলে দেবালয় কি এড়ায়? আসলেই এড়ায় না আমরা আজ পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি গাছগুলোর নিভৃত অভিশাপের প্রায়শ্চিত্তে এমন স্নিগ্ধ বন্ধুত্বের আশ্রয়কে নিজেরাই গলা টিপে হত্যা করে এখন গরমের প্রচ- দাবদাহে চিৎকার করি একটু শীতল পরশের আশায় দেশের গ্রামাঞ্চলের যদি এমন করুণ অবস্থা হয়, তাহলে শহরের অবস্থা তো আরও বেশি ভয়ানক গ্রাম যদি এভাবে বৃক্ষশূন্য হতে থাকে, তাহলে তার প্রভাব শহরে পড়বে না এটা তো হতে পারে না সে প্রভাব আমরা এখন প্রত্যক্ষ করছি চারপাশে শুধু কংক্রিটের প্রাণহীন আবদ্ধ খাঁচা, সে খাঁচায় তীব্র তাপদহনে ছটফট করছে কোটি কোটি মানুষের ঝাঁক কোথাও তেমন সবুজের রংতুলির আঁচড় নেই কেবলই চারপাশে ইট-পাথরের ঝকঝকে মৃত্যুর আস্বাদন যেখানে সবুজ নেই সেখানে মমতা, প্রণয়, স্নেহ, মানবিকতা থাকবে সেটা কোনোভাবেই বিশ্বাস করি না তাই হয়তো শহর এত বেশি রুক্ষ, শুষ্ক, মরুভূমির মতো দয়াহীন, মমতাহীন শূন্যতার সাগর চারপাশে এত এত মানুষের ঝাঁক অথচ কেউ কারও নয়, কেউ কারও সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না ভাব আদান প্রদানের ঘাটতিতে মানুষ হয়ে উঠেছে মানুষের ভয়ের কারণ কেউ কারও সঙ্গে উপর্যুপরি কথা বললে অপরজন ভাবে নিশ্চিত কোনো খারাপ মতলব আছে অথচ এমন পৃথিবী কী আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমরা কোথায় রেখে যাব কাদের কাছে রেখে যাব এমন শুষ্ক, মমতাহীন মরুভূমির প্রান্তরে

গাছ আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু অথচ গাছগুলোকে আমরা কি অবলীলায় কেটে ফেলছি একটি বৃক্ষ কেটে ফেলা যতটা সহজ তা রোপণ করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা একটা আস্ত মানুষের জীবনের আয়ুকে অতিক্রম করেও সম্ভব হয় না আমাদের অঞ্চলে এমন কিছু গাছ আছে যাদের বয়স দেড়শথেকে দুবছর সে গাছগুলোকে কাটার জন্য অনেকভাবে বৃক্ষ রাক্ষসরা চেষ্টা করেছে কিন্তু গাছকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হওয়া কিছু মিথ, কিছু গল্প গাছগুলোকে এখনো বাঁচিয়ে রেখেছে এই বৃক্ষ রাক্ষসরা চেষ্টা কখনোই ছাড়বে না, নানান কৌশল অবলম্বন করে তারা গাছগুলোকে ভক্ষণ করতে মরিয়া হয়ে আছে এবং হয়তো ভক্ষণ করেও ফেলবে আমরা যদি এখনো গাছের বিষয়ে সচেতন না হই, তাহলে সাহারা মরুভূমির উত্তপ্তের তীব্র আঁচ আমাদের গায়ে লাগতে খুব বেশি সময় লাগবে না, যা ইতোমধ্যে কিছুটা হলেও আমরা অনুভব করছি আমাদের এই অস্তিত্ব সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে হতে আমরা ছাইয়ের স্তূপে পরিণত হয়ে যাব হয়তো খুব দ্রুতই যার জন্য আমাদের যথার্থ পদক্ষেপ এখনই গ্রহণ করার সর্বোত্তম সময় তা না হলে আমাদের এই অপসিদ্ধান্তের খেসারত হিসেবে ভয়ানক পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে হবে

পৃথিবীর সকল অঞ্চলে নতুন নতুন সিস্টেম চালু করে বৃক্ষরোপণসহ সবুজায়নের দিকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে অথচ আমরা আমাদের যে গাছ নামক সবচেয়ে উপকারী বন্ধুটি রয়েছে, তাকে নিধন করতে সর্বদা ব্যস্ত আমাদের এই অপরাধের শাস্তিই হচ্ছে এই তীব্র দাবদাহ এই উচ্চ তাপমাত্রা বৃদ্ধি এখন তাপমাত্রা ৪২-৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস আমরা যদি এখনো সচেতন না হই, তাহলে এই তাপমাত্রা আগামী ১০ বছরে ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগবে না যেটা অনেক বেশি সংকটময় মুহূর্ত হবে আমাদের জন্য যা ভাবতেই শিহরিত হতে হয় আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে গাছ আছে বলেই আমরা আছি, যেদিন তারা আমাদের মাঝ থেকে নিশ্চিহ্ন হবে, সেদিন আমরাও বিলুপ্ত হয়ে যাব এই পৃথিবী থেকে আমাদের টিকে থাকাটা সম্পূর্ণভাবেই তাদের টিকে থাকার ওপর নির্ভর করছে এই উচ্চ তাপমাত্রাকে রুখে দেওয়ার জন্য আমাদের সকলের প্রচুর পরিমাণে গাছ রোপণ করতে হবে

গাছ রোপণ ছাড়া আমাদের টিকে থাকার কোনো বিকল্প নেই একটা মানুষের অক্সিজেনের প্রতিদানের বিপরীতে কমপক্ষে ৫০-১০০টি করে গাছ লাগানো উচিত গাছই হচ্ছে আমাদের পৃথিবীর প্রথম ফুসফুস আমাদের ফুসফুসের জ্বালানি তাই আসুন, আমরা গাছ কাটা থেকে বিরত থাকি এবং যেখানে যতটুকু ফাঁকা জায়গা আছে, সেখানে বৃক্ষরোপণ করি সবুজ মানুষ একে অপরের প্রতিপক্ষ না হয়ে, হয়ে উঠুক একে অপরের প্রাণের বন্ধু, প্রাণের স্বজন

লেখক : কলামিস্ট

×