ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

বাংলাদেশ বিনির্মাণে কারিগরি শিক্ষা

ড. মো. মোরশেদুল আলম

প্রকাশিত: ২০:২৯, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

বাংলাদেশ বিনির্মাণে কারিগরি শিক্ষা

.

দেশে গত এক যুগে বহু কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হয়েছে। হাতেকলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাই হলো কারিগরি শিক্ষা। এটি এমন একটি শিক্ষাব্যবস্থা যা একজন মানুষকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জন করে একজন যোগ্য দক্ষ কর্মী হিসেবে গড়ে উঠতে সহযোগিতা করে। বিশ্বে উন্নত দেশগুলোতে কারিগরি শিক্ষার ব্যাপকতা রয়েছে, যার ফলে তাদের দক্ষ জনশক্তির সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক মানোন্নয়ন এবং উন্নত, সমৃদ্ধ, সম্রার্ট বাংলাদেশে রপান্তরিত করতে হলে কারিগরি শিক্ষার মান উন্নয়নের বিকল্প নেই। কোনো জাতির দক্ষ কর্মী তৈরিতে কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

কারিগরি শিক্ষাব্যবস্থা সাধারণত নির্ভর করে কোনো একটি দেশের আর্থ-সামাজিক পরিবেশগত প্রেক্ষাপটের ওপর। আন্তর্জাতিক বিশে^ ব্যবসায়ে, প্রশাসনে, বিজ্ঞানে, প্রকৌশলে, হেলথ সায়েন্সে কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হয়। কারিগরি চাকরির সবচেয়ে বড় বাজার সরকারি ইপিজেড গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। এছাড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, সয়েল টেস্ট ফার্ম, কনস্ট্রাকশন, হাইভোল্টেজ ক্যাবল লাইন, পাওয়ার জেনারেশন প্লান্ট, হাউস ওয়্যারিং, শিল্প-কলকারখানা, বিভিন্ন স্ট্রাকচার ডিজাইন ফার্ম, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, -কম্পিউটার ডিজাইনার, ডাটা এন্ট্রি, মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, টেক্সটাইল মিল, গার্মেন্টস অ্যান্ড ফ্যাশন হাউস, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ডিজাইন সরবরাহকারী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, পল্লী বিদ্যুৎ, ডেসকো, আইডিবি, বিটিসিএল, মেডিকেল ল্যাব, সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ওষুধ কোম্পানিসহ দেশী-বিদেশী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ রয়েছে।

সরকার ২০৩০ সালে দেশের কারিগরি শিক্ষার্থীর হার ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য নিয়েছিল। যদিও লক্ষ্য শিল্পোন্নত দেশের তুলনায় অনেক কম। কারণ, বিশ্বে শিল্পোন্নত দেশগুলোতে দক্ষ অতিদক্ষ জনসংখ্যা প্রায় ৬০ শতাংশের মতো। জার্মানিতে প্রায় ৭৩ শতাংশ জনসংখ্যা দক্ষ। জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫০, মালয়েশিয়ায় প্রায় ৪৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় অধ্যয়ন করেন। বাংলাদেশে স্বল্পদক্ষ দক্ষ জনশক্তি ৩৮ শতাংশ বলা হলেও কারিগরিভাবে দক্ষ, মধ্যমানে দক্ষ কিংবা স্বল্পদক্ষ জনশক্তি মাত্র ১৪ শতাংশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের ২০১৮ সালের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, কারিগরি শিক্ষার্থীদের হার মাত্র ১৪ শতাংশ। ২০২০ সালে হার ২০ শতাংশ এবং ২০৩০ সালে তা ৩০ শতাংশ করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে।

বাস্তবে আন্তর্জাতিক কারিগরি শিক্ষার সংজ্ঞা এবং বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, হার মূলত .৪৪ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানের স্বল্পতা, দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাব, মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার অভাব, ল্যাব সুবিধার অপর্যাপ্ততার কারণে কারিগরি শিক্ষায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে রয়েছি। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করতে হলে কারিগরি শিক্ষার মানসম্মত প্রসারে বহুবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। একটি মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থায়ই পারে সভ্যতার পরিবর্তন ঘটাতে। সময়ের চাহিদা পূরণে সরকার দক্ষ যোগ্য নাগরিক তৈরি করতে চায়। নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থীদের স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে নিয়ে যাবে। নতুন শিক্ষাক্রমে অভিজ্ঞতালব্ধ শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পৃথিবীর উন্নত শিক্ষামাধ্যমগুলো কারিগরি শিক্ষায় বেশি জোর দিয়েছে। ফলে তারা প্রযুক্তিগতভাবে সাফল্য অর্জন করেছে। দক্ষ মানসম্মত কারিগরি শিক্ষাই ঠিক করে দেবে কর্মসংস্থান এবং শিক্ষায় সাফল্য। সরকার তাই কারিগরি শিক্ষাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক শ্রমবাজার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা ছাড়া জনশক্তিকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করা সম্ভব নয়। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশ বলতে বোঝায় স্বনির্ভর অর্থনীতি, যেখানে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য অভ্যন্তরীণ খাতে উপযুক্ত প্রযুক্তি সংবলিত টেকসই উন্নয়ন। এর প্রধান মাধ্যম হচ্ছে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা। উন্নত বিশে^ সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নিজেদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে এবং দেশকে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী করতে হলে কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া ছাড়া সম্ভব নয়। জন্য কারগিরি শিক্ষার মান উন্নয়নে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জনসম্পদে পরিণত করতে পারলেই তারা হবে দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি। দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কারিগরি শিক্ষাই হচ্ছে প্রধান মাধ্যম। কারিগরি শিক্ষার বাস্তব প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সার্বিকভাবে শিক্ষা খাতে বিশেষ করে কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কার প্রয়োজন। সংস্কার এমন হতে হবে যাতে, চতুর্থ শিল্পবিপ্লব উপযোগী মানবসম্পদ উৎপাদনে নেতৃত্ব দিতে পারবে। এই সুদীর্ঘ যাত্রায় নেতৃত্ব, সরকার, প্রশাসন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান সবার সৎ, দায়িত্বশীল, জ্ঞান প্রজ্ঞাবোধে তাড়িত হয়ে সঠিক কার্যকর ভূমিকা রাখা দরকার। এজন্য প্রয়োজন একটি ভবিষ্যৎমুখী কার্যকর স্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি কৌশল কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ এবং এর যথাযথ বাস্তবায়ন। বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের বহু স্বল্পমেয়াদি কারিগরি কোর্স খাতে আসবে। তবে কোর্সে কনটেন্ট, শিক্ষাদান পদ্ধতি, হাতে কলমে প্রশিক্ষণের উপকরণ, শিক্ষকের মান প্রভৃতি নিশ্চিত করতে হবে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাজেটে কারিগরি শিক্ষার কারিকুলাম এগিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণের বিষয়ে বলা হয়েছিল। ন্যানো প্রযুক্তি, ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স, ইন্টারনেট অব থিংস, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ব্লকচেইন প্রযুক্তিসহ আধুনিক বিষয়ের ওপর জোর দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে রোবটিকস মেইনটেনেন্স, কন্ট্রোল সিস্টেম মেইনটেনেন্স সাপোর্ট, ওয়েস্ট রি-সাইক্লিং, সোলার এনার্জি রিনিউয়েবল এনার্জির মতো নতুন বিষয়গুলো শুরু করতে হবে।

বাংলাদেশে বিশ্বে লেদার, প্লাস্টিক, মোবাইল ফোন, ইলেকট্রনিক্স, অটোমোবাইল, এয়ারলাইনস, নার্সিং এসবের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসনের অভাবে খাতগুলোতে কারিগরিভাবে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি হচ্ছে না। ফলে বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে দক্ষ শ্রমিক জোগান দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এতে করে এসব দক্ষ শ্রমবাজার ধরতে আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। ফলে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় একই পরিমাণ রেমিট্যান্স আনায় বাংলাদেশ সমর্থ হচ্ছে না।

পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নে দেশে বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজের সমন্বয় না হওয়ায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ শেষে সনদ প্রদান করা হয় না। এতে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ কমে যায়। আবার দেশে সনদপ্রাপ্ত শিক্ষিত মানুষের অভাব নেই। কিন্তু পেশাগত জ্ঞানের অভাবে তাদের বেকারত্ব বরণ করতে হচ্ছে। এখান থেকে বের হতে মানসম্মত কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেল পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকারি বাজেট সুনির্দিষ্ট হতে হবে। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনবল সৃষ্টিতে আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। শ্রমিকদের পর্যাপ্ত মজুরি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে কাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষায় শিল্পকারখানার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ শিক্ষানীতি প্রয়োজন। শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব মডেলের আওতায় প্রশিক্ষণ প্রদানের পর সনদ প্রদান করতে হবে।

মেধা ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা সংস্কার কর্মসংস্থান পরিকল্পনায় ব্যাপক সংখ্যক প্রকৃত মেধাবী দেশপ্রেমিক, প্রজ্ঞাবান বুদ্ধিজীবী সাবজেক্ট ম্যাটার এক্সপার্টদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে কারিগরি শিক্ষার। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগানো, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে, বিপুল সম্ভাবনা তৈরি, ঝুঁকি দূর করা, অদক্ষ-স্বল্পদক্ষ জনশক্তিকে ক্রমাগতভাবে বাজার চাহিদাকেন্দ্রিক দক্ষতায় রূপান্তর করতে শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন। দেশের প্রকৃত মেধাবীদের দিয়ে তৈরি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন শিক্ষা সংস্কার পরিকল্পনা প্রণয়ন বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আমরা চাই মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং কর্মসংস্থান বাস্তবায়নের একটি কার্যকর মাস্টারপ্ল্যান। এমতাবস্থায় কর্মসংস্থান শিক্ষা সংস্কার প্রস্তুতির পাশাপাশি একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ভবিষ্যৎ তৈরি করার জন্য সরকার, প্রশাসন, স্কুল-কলেজ-বিশ^বিদ্যালয়, শিক্ষা শিল্প গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করে যেতে হবে। বাংলাদেশের চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্রসর হোক। অবকাঠামোগত, কর্মসংস্থান পরিবেশগতভাবে উন্নত হোক। বাংলাদেশ দূরদর্শী টেকসইভাবে উন্নতির স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করবে একদিন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : শিক্ষাবিদ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×