ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

মূল্যস্ফীতির কারণ ও প্রতিকার

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

প্রকাশিত: ২০:৪১, ৭ অক্টোবর ২০২৩

মূল্যস্ফীতির কারণ ও প্রতিকার

ড. এস এম জাহাঙ্গীর আলম

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির চারটি কারণ চিহ্নিত করেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলেছে, অভ্যন্তরীণ জ্বালানির মূল্য বেড়ে যাওয়া, দুর্বল মুদ্রানীতি, টাকার অবমূল্যায়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা কমে যাওয়ায় আমদানি কমে যাচ্ছে। এই চার কারণেই বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ছে বলে জানায় সংস্থাটি। ৩ অক্টোবর সংস্থাটির ঢাকা অফিস ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ ও ভুটানে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে সেক বিস্তারিত তুলে ধরেন। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছর বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কিছুটা কমিয়ে এনেছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটির নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এই অর্থবছর জিডিপি হতে পারে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। 
বৈশ্বিক মন্দার প্রভাবে বিদায়ী অর্থবছরে সরকারের আয় কমেছে, এর বিপরীতে ব্যয় বেড়েছে। বাড়তি ব্যয় মেটাতে সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ মানেই হচ্ছে ছাপানো টাকা। বিদায়ী অর্থবছরে অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছে। আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকার ঋণ নিয়েছিল ৩১ হাজার ৩২৪ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে তিনগুণের বেশি ঋণ নিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাড়তি ঋণ গ্রহণের কারণে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়ে গেছে। যে হারে টাকার প্রবাহ বাড়ছে, সেই হারে উৎপাদন বাড়ছে না।

ফলে, পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি ঘটাচ্ছে। ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ার অন্যতম কুফল হচ্ছে চড়া মূল্যস্ফীতি। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। মানুষের আয়ও কমে যাচ্ছে। এতে মানুষ জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে চাহিদা কমাতে বাধ্য হচ্ছে। যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন, তারা দারিদ্র্যসীমার মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। এতে দারিদ্র্য বাড়ছে। এ অবস্থা বেশি দিন চললে মানুষের শেণিগত কাঠামোতে পরিবর্তন চলে আসবে। মধ্যবিত্তের আয় কমে তারা চলে যাবে নিম্ন মধ্যবিত্তে। নিম্নবিত্ত যাবে আরও নিচের স্তরে। অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রতি দেশী ও বৈশ্বিকভাবে আস্থার ঘাটতি দেখা দেবে। যার নেতিবাচক প্রভাব ইতোমধ্যেই পড়তে শুরু করেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদা অনুযায়ী গাজীপুরে অবস্থিত দ্য সিকিউরিটিজ প্রিন্টিং করপোরেশন (বাংলাদেশ) লিমিটেড বছরজুড়েই টাকা ছাপানোর কাজটি করে থাকে। ছাপানো টাকা প্রথমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে (টাকা জমা রাখার সুরক্ষিত স্থান) জমা রাখা হয়। ভল্টে থাকা অবস্থায় একে বলে ‘জড়বস্তু বা নন লাইভ’ টাকা। চাহিদা বাড়লে ছাপানো টাকা থেকে বাজারে ছাড়া হয়। ছাপানো টাকা বাজারে এলেই একে বলা হয় ‘লাইভ বা জীবন্ত’। অর্থাৎ, ছাপানো টাকা ভল্টে থাকলে মূল্যহীন কাগজ এবং বাজারে এলে মূল্যমান মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন উপায়ে বাজারে টাকার জোগান দেয়।

এর মধ্যে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে অর্থের জোগান দিয়ে বিশেষ তহবিল গঠন করে এবং বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিশেষ প্রয়োজনে তারল্যের জোগান দিয়ে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে যেসব টাকা বাজারে ছাড়া হয়, এর সবই ছাপানো নোট আকারে নয়। বেশির ভাগই থাকে ইলেকট্রনিক আকারে। অর্থাৎ মুদ্রা সরবরাহের আদলে। মুদ্রা সরবরাহ বাড়ানো হলে তখন নগদ টাকার জোগানও বাড়াতে হয়। তখনই কেবল ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়া হয়। 
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ অর্থকে বলা হয় হাইপাওয়ার্ড মানি বা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাকা। এগুলো বাজারে এসে টাকার প্রবাহ বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি হয়। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। বাড়িয়ে দেয় জনভোগান্তির মাত্রা। টাকা ছাপানোর সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি প্রায় নেই। সরকার আর্থিক ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং উৎপাদন কর্মকা- উৎসাহিত করতে চাহিদা অনুযায়ী টাকার জোগান বাড়ায়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের বিভিন্ন সম্পদের বিপরীতে ছাপানো টাকা বাজারে ছাড়ে।
বৈশ্বিক সংকটের কারণে বর্তমানে দেশে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। অর্থাৎ স্থানীয় টাকার মান কমছে আর ডলারের দাম বাড়ছে। ডলার নিয়ে এমন সংকট আগে দেখা যায়নি দেশে। ফলে, ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হারে অস্থিরতা চলছে। বিনিময় হার বাজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়া দরকার। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে হলে বিনিময় হার স্থিতিশীল করা আবশ্যক। বর্তমান পরিস্থিতিতে সংকট মোকাবিলায় প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ প্রায় সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘নীতি সুদ’ হার বাড়িয়ে মুদ্রা সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক চুপ করে বসে আছে কেন, সে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই।

মূল্যস্ফীতি সহনীয় করার আরেকটি উপায় হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘নীতি সুদ’ হার বাড়ানো। বেসরকারি বিনিয়োগে খরার কারণে ব্যাংক খাতে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য রয়েছে। ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেওয়ার পরও পরিস্থিতির উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। সরকার যে উদ্দেশ্যে ব্যাংক খাতে ঋণ ও আমানতের সুদহার ৬ থেকে ৯ বেঁধে দিয়েছে, তা সফল হয়নি। তাই ঋণের সুদ হার ‘বাজার ভিত্তিক’ করার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ নয়। এখন যে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, তা বৈশ্বিক কারণে। তবে আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশ্ববাজারে কিছু স্বস্তির আভাস। জ্বালানি তেলের দাম কমছে। খাদ্যশস্যের দামও কমতে শুরু করেছে। এ ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আশা করা যায়, আগামী দুই মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। নীতি সুদহার বাড়ালে টাকা আরও দামি হবে। অতিসম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার কিছু বাড়িয়েছে। তখন ডলারের চাহিদা কমে আসবে। সেই সঙ্গে কমে আসবে মূল্যস্ফীতিও।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাবেক কর কমিশনার ও পরিচালক- বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কো. লি.

×