
টরন্টোর চিঠি, ড. শামীম আহমদে
খুব কাছাকাছি সময়ে বাংলাদেশ ঘুরে গেলেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। আবার আমাদের প্রধানমন্ত্রীও ব্রিকস ও জি-২০ সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে ঘুরে এসেছেন। এই প্রতিটি ঘটনা তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও জি-২০ সম্মেলনে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাকসহ বিশ্বের নানা বরেণ্য নেতারা যেভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, তাতে করে বিরোধী শিবিরের যে অমূলক দাবি, অর্থাৎ সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ভাল নয়, সেটি মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
সরকার প্রধান হিসেবে যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পূর্ণ আস্থা না থাকত, তবে তারা এমন আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে স্বাগত জানাতেন না। গত বছর থেকেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর শক্তিশালী অবস্থানের কারণে তিনি রাশিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারতের সমীহ পেয়ে আসছেন। এদিকে এই যুদ্ধে ন্যাটোর পক্ষের শক্তিরাও যে তাঁকে সমানভাবে গুরুত্ব দেয়, সেটিও খুব পরিষ্কারভাবে নির্ধারিত হয়ে গেছে। ন্যাটোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্স ইউরোপীয় ইউনিয়নে একটি স্বাতন্ত্র্য অবস্থান বজায় রাখে নিজেদের অর্থনৈতিক ও সামরিক শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখার জন্য।
এমনকি এই যুদ্ধের মধ্যেও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের মধ্যে একাধিকবার সাক্ষাৎ হয়েছে নানা বিষয় নিয়ে। কানাডা বা যুক্তরাজ্যের মতো ফ্রান্স অন্ধভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে অনুসরণ করে না। তাদের নিজস্ব পররাষ্ট্রনীতি অত্যন্ত শক্তিশালী। সেই বিবেচনায় ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের এই সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে এটিই সম্ভবত রাশিয়ার কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর, অন্তত গত কয়েকযুগে আমরা এত প্রভাবশালী রাশিয়ান সরকারের প্রতিনিধিকে বাংলাদেশে ভ্রমণ করতে দেখিনি। সার্বিকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ কূটনৈতিক অঙ্গনে গত কয়েক মাসে তার শক্তিশালী উপস্থিতির সাক্ষ্য-প্রমাণ রেখেছেন।
গত মাসের শেষের দিকে সীতাকু-ে পুলিশের নিহত হওয়ার খবরে উল্লাস প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পুলিশ মারা গেছে, তার খবরে উল্লাস প্রকাশ করে স্ট্যাটাস দেয়ায় মোটেও অবাক হচ্ছি না। কিছুদিন আগে লিখেছিলাম জাতি হিসেবে আমাদের সামগ্রিক আচরণ খুব একটা যে প্রশংসনীয় তা নয়। কেবল মাত্র মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে আমরা একটি জাতি হিসেবে গর্ব করার মতো মাত্রায় একত্রিত হয়েছিলাম, এছাড়া স্বাধীন হওয়ার পর নানা সময়ে নিজের জাতির পিতাকে খুন করাসহ নানা কারণেই আমাদের একতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। পরশ্রীকাতরতা নিয়ে কয়েক বছর আগে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। লেখক হয় বাংলাদেশ বা ভারতের বাঙালি, ঠিক মনে নেই। তিনি লিখেছেন, পরশ্রীকাতরতার কোনো বিদেশী শব্দ নেই। কারণ, এই জিনিসটা বাঙালিদের নিজস্ব। তিনি গবেষণাপত্রে ইংরেজি বানানে পরশ্রীকাতরতা শব্দটি লিখে তারপর নানাভাবে সেটি ব্যাখ্যা করেছেন।
থ্রি ইডিয়টস মুভিটার কথা মনে আছে? তালিকায় সর্বনিম্ন নিজেদের নামের পাশে আমির খানের নাম না দেখে দুই বন্ধু মুষড়ে পড়ে এই ভেবে যে, আমির খান বোধহয় ফেল করেছে। পরে যখন দেখে আমির খান ফার্স্ট হয়েছে, তাই তার নাম তালিকার সর্বাগ্রে, তখন তাদের মন আরও খারাপ হয়। এই যে অন্যের ভাল দেখলে মন খারাপ হওয়া এটা আমাদের বাঙালিদের নিজস্ব কৃষ্টি। বাঙালিসহ পুরো উপমহাদেশেরই বটে। তবে যেহেতু আমি তাদের প্রতিনিধিত্ব করি না, তাই অন্যান্য জাতির কথা উল্লেখ করলাম না। পুলিশের মৃত্যুতে খুশি হয়ে স্ট্যাটাস দেওয়াতে অবাক হওয়ার কী আছে? আমাদের দেশে হাজার হাজার মানুষ নিজের বাবা, মা, ভাই, বোন, আত্মীয়-স্বজনের মৃত্যু চায় প্রতিনিয়ত।
শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যু চায় বোধহয় লাখ লাখ মানুষ। স্বামী স্ত্রী একে অপরের মৃত্যু চায় এমন মানুষও নির্ঘাত কম নয়।
সেখানে পুলিশের মৃত্যু চাওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, পুলিশ, বিসিএস, শিক্ষক কে কার মৃত্যু চায় না এই দেশে? কিছু চাওয়া অত্যাচারিত নিপীড়িত হওয়া থেকে আসে, আর বাকি চাওয়া আসে স্রেফ অন্যের ভাল দেখে। ভারতের চাঁদে যাওয়া নিয়ে মধ্যেখানে বাংলাদেশীরা ব্যাপক রাগ দেখাল বিসিএস কর্মকর্তাদের ওপর। বাংলাদেশে পড়ালেখা করে সবাই বিসিএস দিতে চায়, কেউ রকেট ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় না বলে আমরা এখনও চাঁদে গেলাম না - তাদের দাবি অনেকটা এমনই। কথা শুনলে মনে হয়, ভারতে কেউ পাবলিক সার্ভিস কমিশনে চাকরি করে না। ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের (ওঈঝ) চাহিদা বাংলাদেশের বিসিএসের চাইতে কয়েকশ’ গুণ বেশি।
ভারতে এই ICS এবং Indian Institutes of Technology (IIT) তে ঢোকার জন্য লাখ লাখ ছেলেমেয়ে ক্লাস ৮ থেকে কোচিং শুরু করে। ওওঞ থেকে পাশ করা ছেলেমেয়ে কেবল ভারত নয়, সারা দুনিয়ার সেরা আইটি কোম্পানিগুলোতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আর ওঈঝ ড়ভভরপবৎ রা পুরো ভারত কাঁপাচ্ছে। একেক জন ওঈঝ ড়ভভরপবৎ এর সঙ্গে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য ভারতে বাবা-মা’রা কয়েক কোটি টাকা বাজেট রাখে, এটিও নানা সময়ে পত্রিকায় দেখা যায়। তো ভারতে এত এত যোগ্য ওঈঝ তৈরি হওয়াতে তো তাদের চাঁদে যাওয়ায় কোনো বাধা পড়েনি। বাংলাদেশে বিসিএসে কেউ গেলে কেন বাঙালির এত আপত্তি? মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর বিসিএস কর্মকর্তাদের সুযোগ সুবিধা বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছেন। তারা ভাল আছেন। তাদের সুখ অন্যদের সহ্য করতে কষ্ট হয়। বিসিএসে চান্স পাওয়াও সহজ নয়।
তাই হয়তো অনেকেই নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে সফল কর্মকর্তাদের পছন্দ করেন না, দেশের সব দায় তাদের ওপর চাপাতে থাকেন। বলছিলাম পুলিশের মৃত্যুতে মানুষের আনন্দের কথা। পুলিশের কিছু সদস্য মানুষের ওপর নানা অত্যাচার করে, সেটা ভিন্ন কথা; কিন্তু এদেশে কজনইবা কার ভাল দেখতে পারে। অনেকেই অন্যের ব্যর্থতায় খুশি হয়, সাফল্যে বেজার হয়। প্রশংসা জিনিসটা আমাদের মুখ দিয়ে খুব কম বের হয় কেউ ভালো করলে, সাফল্য অর্জন করলে, দুটো ভালো কথা মুখ দিয়ে বের হতে শত শত ব্যারিকেড পার করে আসতে হয়। বহু কষ্টে প্রশংসা করলেও তার সঙ্গে লেজুড় হিসেবে থাকে আরও ১০টা কথা।
- চাইলে আমিও পারতাম
- এ আর এমন কী
- ওই রকম সারাদিন টেবিলে বসে থাকলে সবাই পারে!
- ওর মতো স্বার্থপর আমরা হতে পারি নাই বলে এসব করা হয় নাই।
একদম নির্ভেজাল মন খুলে প্রশংসা করা অনেক বড় বিষয়। কানাডায় এসে এদেশের মানুষের মধ্যে এই বিষয়টা দেখেছি। ওরা যখন প্রশংসা করে, মন খুলে করে। আপনি ভাল করলে ওদের মন খারাপ হয় না। ওরা নিজের উন্নতির চেষ্টা করে যায় ক্রমাগত; একই পথে অন্য কেউ ভাল করলে খুশি হয়। আমাদের পরশ্রীকাতরতা আমাদের কুরে কুরে খাচ্ছে। আমরা সাকিব আল হাসানকে দেখতে পারি না, রিয়াদকে না, মুশফিককে না, লিটন দাসকে না, তামিমকে না, মাশরাফিকে না। শাকিবকে না, জায়েদ খানকে না, হিরো আলমকে না।
আমাদের মনের মধ্যে কেবল ও কী খেলে? ও কী গায়? ও কী বলে? ও কী পারে? আমাদের একেকজনকে অপছন্দ করার, একেকজনকে ঘৃণা করার, একেকজনের সাফল্যে বেজার হওয়ার একেক অজুহাত। তাই পুলিশের মৃত্যুতে খুশি হওয়া আমাকে মোটেও অবাক করে না। যেমনটা করে না সম্পূর্ণ সংবিধান বহির্ভূতভাবে ঘৃণা করা লোকটাকে গ্রেপ্তার করার ঘটনাও। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের মৃত্যুতে আনন্দিত হলে সেটি তার নৈতিক ও মানসিক পরাজয়; কিন্তু অন্যের মৃত্যুতে আনন্দিত হওয়া, কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে জাতিগত, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও সাংবিধানিক পরাজয়। এ দেশে কোনোভাবেই কাউকে আনন্দ পেতে দেওয়া যাবে না!
কূটনৈতিক অঙ্গনে সফলতার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরে জাতি হিসেবে আমাদের একত্রিত করা জরুরি মনে করছি। এ বিষয়ে সরকার আরও সচেতন হবে, এ কামনা করি।
টরন্টো, কানাডা
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩