ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ১২ মে ২০২৫, ২৮ বৈশাখ ১৪৩২

সঞ্চয়পত্র পেনশনের বিকল্প নয়

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩

সঞ্চয়পত্র পেনশনের বিকল্প নয়

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা

যে দেশে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কোনো মানুষের পেনশন সুবিধা নেই এবং যে দেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটি, সেরকম একটি দেশে সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন চালু করা এক কথায় অসাধ্য সাধনের মতো কাজ। তারপরও সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে জনগণের কল্যাণের কথা ভেবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু করে দিয়েছেন। এই উদ্যোগটি সফল করতে আমাদের সকলের উচিত সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। সরকার যেভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে, তাতে এটি যে একটি সর্বোত্তম ব্যবস্থা- এমন দাবি করা যাবে না

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার পর থেকেই একদিকে যেমন প্রশংসা চলছে, অন্যদিকে সমালোচনাও হয়েছে। জনকল্যাণে গৃহীত এরকম যুগান্তকারী একটি পদক্ষেপ সকল মহলে প্রশংসিত হবে এটাই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্তু এই কর্মসূচী নিয়ে সমালোচনা হতে পারে তা ভাবতেও অবাক লাগে। এটি বাংলাদেশেই সম্ভব। সর্বজনীন পেনশন নিয়ে সমালোচনা করেছেন পেশাদার, অপেশাদার সকলেই এবং যে যেভাবে পেরেছেন সেভাবেই কথা বলেছেন। অনেকেই বলেছেন যে, এই পেনশনের কোনো প্রয়োজন নেই। কেননা, সঞ্চয়পত্র, ব্যাংকের ডিপিএস বা ইনস্যুরেন্স কিনলেই এর থেকে ভাল সুবিধা পাওয়া যায়। পেনশন সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা থাকলে কেউ এই ধরনের মন্তব্য করতে পারেন না। পেনশন এমন একটি সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা, যার কোনো বিকল্প নেই। পেনশনের বিকল্প শুধুই পেনশন।
পেনশনের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচীর সমালোচনা করতে গিয়ে যারা ইনস্যুরেন্স বা সঞ্চয়পত্রকে ভালো বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করেছেন, তারা সম্ভবত এই দুটো আর্থিক সেবা এবং পেনশনের মধ্যকার পার্থক্য ভালোভাবে বিবেচনায় নেননি। যদি নিতেন, তাহলে তারা সর্বজনীন পেনশনের সমালোচনা করতে গিয়ে এই দুটো আর্থিক সেবাকে এভাবে সামনে আনতেন না। কেননা, পেনশনের যে উদ্দেশ্য তা কোনো অবস্থাতেই ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে মেটানো সম্ভব নয়। আর সঞ্চয়পত্র হচ্ছে নগদ সম্পদ। তাই সেটিও পেনশনের চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। মানুষ যখন কর্মজীবন থেকে অবসরে যায়, তখন তার জীবনযাপন সীমিত হয়ে আসে। জীবনের হিসাবনিকাশ অনেকটাই মিলে যায়। সেসময় নতুন করে চাওয়া-পাওয়ার তেমন কিছু থাকে না।

তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসম্মান বজায় রেখে খেয়েপড়ে মর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকা। যার জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন মাসিক অর্থ প্রাপ্তির সুযোগ। যার নিশ্চয়তা একমাত্র পেনশন ব্যবস্থার মাধ্যমেই করা যেতে পারে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে মানুষের অবসরজীবন বা বৃদ্ধ বয়স যথেষ্ট দুর্বিষহ এবং অনেকের করুণার ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠে, তার বড় কারণ যথাযথ পেনশন ব্যবস্থা না থাকা। পক্ষান্তরে, উন্নত বিশ্বে নিজের উপার্জন তো বটেই, এমনকি ঋণ করে ভোগবিলাসে জীবনযাপন করার পর হাতে এক পয়সা সঞ্চয় না থাকা সত্ত্বেও মানুষ বৃদ্ধ বয়সে বা অবসরে যাওয়ার পর তেমন কোনো সমস্যা হয় না। সেখানে প্রত্যেক নাগরিক অবসরজীবন বা বৃদ্ধ বয়স সম্মানের সঙ্গেই পার করতে পারে শুধু সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু থাকার করণে।
ইনস্যুরেন্স পেনশনের বিকল্প নয়Ñ আমাদের দেশে ইনস্যুরেন্সের অর্থ বা ক্লেইম আদায় করার যে তিক্ত অভিজ্ঞতা, সে বিষয়টি বাদ দিলেও ইনস্যুরেন্স যে ধরনের আর্থিক সেবাÑ তা কোনো মানদ-েই পেনশনের ধারেকাছে আসে না। তারপরও বিষয়টি সর্বজনীন পেনশনের সমালোচকরা কেন টেনে এনেছেন, তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। ইনস্যুরেন্স হচ্ছে ঝুঁকি পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার একটি ব্যবস্থা। অর্থাৎ কোনো একটি খাতের যে অংশটুকু ঝুঁকিপূর্ণ, ঠিক সেটুকু ঝুঁকি সমগ্র খাতের ওপর বিন্যাস করে তা লাঘব করা। বিষয়টি কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হতে পারে বিধায় একটি অনুমান নির্ভর উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যেতে পারে।

ধরা যাক, ঢাকার রাস্তায় যত প্রাইভেট কার চলাচল করে, তার মধ্যে পাঁচ শতাংশ দুর্ঘটনার শিকার হয়। এখন বছরে যদি দশ লাখ প্রাইভেট কার ঢাকা শহরের রাস্তায় চলাচল করে, তাহলে বছরে ঢাকায় পঞ্চাশ হাজার গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। এই পঞ্চাশ হাজার গাড়ির যে ক্ষতি, সেটাই প্রিমিয়াম আকারে দশ লাখ গাড়ি থেকে আদায় করা হয়। ইনস্যুরেন্স কোম্পানির পক্ষে সমস্ত দশ লাখ গাড়ির ঝুঁকি নেওয়া সম্ভব নয়। একারণেই ইনস্যুরেন্সে নজিরবিহীন ক্ষতি বা ক্যাটাসট্রফিক লস পূরণ করার সুযোগ রাখা হয়নি। পক্ষান্তরে, পেনশন দিতে হয় দেশের প্রত্যেক নাগরিককে, যা কোনোভাবেই ইনস্যুরেন্সের মাধ্যমে সম্ভব নয়। ইতোপূর্বে সঞ্চয় সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে আমাদের দেশে কিছু ইনস্যুরেন্স কোম্পানি মাসিক অর্থ জমা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে এককালীন বা কিছুদিন মাসিক অর্থ প্রদানের মতো ব্যবস্থা চালু করেছিল। কিন্তু সেটি মোটেও পেনশনের কাছাকাছি কোনো আর্থিক সেবা নয়।

সঞ্চয়পত্রও পেনশনের বিকল্প নয়Ñ ইনস্যুরেন্সের  মতো সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংকের স্থায়ী আমানত পেনশনের বিকল্প হতে পারে না। সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানত হচ্ছে এককালীন নিরাপদ বিনিয়োগ ব্যবস্থা, যেখান থেকে হয়তো মাসিক কিছু অর্থ আসতে পারে। কিন্তু সঞ্চয়পত্র যে জরুরি প্রয়োজনে ভাঙিয়ে খরচ করে ফেলা হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। জীবনের বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। মাঝেমধ্যে এমন প্রয়োজন এসে হাজির হয় যে, সবকিছুর বিনিময়ে হলেও সেই প্রয়োজন মেটানোই তখন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়। ছেলেমেয়েদের বিদেশে পাঠানো, মেয়ের বিবাহ বা জটিল রোগের চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে জীবনের শেষ সম্বল সঞ্চয়পত্র ভেঙে নিঃস্ব হওয়ার নজির আমাদের চারপাশে প্রচুর আছে।

সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তারা এক সময় পেনশন সারেন্ডারের সুযোগ নিয়ে মাসিক পেনশনের পরিবর্তে এককালীন অর্থ উত্তোলন করে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছিলেন। অথচ অনেকেই এরকম বাস্তবতার শিকার হয়ে সেসব সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে জীবনের শেষ সম্বল হাতছাড়া করে অবর্ণনীয় দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্তই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সে সকল অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা, যারা অবসরের পনেরো বছর অতিবাহিত করেছেন, তারা সেই মাসিক পেনশন ফিরে পাওয়ায় সম্মানের সঙ্গে অবসর জীবন কাটাতে পারছেন। অথচ সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় সে সুযোগ নেই। জীবনের যত জরুরি প্রয়োজনই আসুক না কেন, তা অন্যভাবে মেটাতে হবে এবং অবসর জীবনে অন্তত মাসিক অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তাটা থাকবে। এখানেই সর্বজনীন পেনশনের বিশেষ সুবিধা যা সঞ্চয়পত্র বা ব্যাংক আমানতের মাধ্যমে কখনই পূরণ করা সম্ভব নয়। 
সঞ্চয়পত্রের সুযোগ সীমিত হতে বাধ্যÑ সঞ্চয়পত্র অতি মাত্রার সুদ হারের একটি সরকারি বিনিয়োগ মাধ্যম। সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে সরকার তার বাজেট ঘাটতির অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এজন্য সরকারকে সঞ্চয়পত্রের সুদ বাবদ বিশাল অংকের অর্থ ব্যয় করতে হয়। চাইলে সরকার অন্যান্য উৎস থেকে অল্পসুদে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে এবং সুদ বাবদ খরচ উল্লেখযোগ্য হ্রাস করতে পারে। কিন্তু সরকার সেটি না করে সঞ্চয়পত্র অব্যাহত রেখেছে। কারণ, এতে সামাজিক সুরক্ষার একটা ব্যবস্থা আছে। যেমনÑঅনেক গরিব মানুষ, আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত ব্যক্তি, বেসরকারি চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিসহ অনেকেই সঞ্চয়পত্রে অর্থ বিনিয়োগ করেন। সেখান থেকে যা আয় হয়, তা দিয়ে জীবনযাত্রার খরচ মিটিয়ে থাকেন। সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করে দিলে এই শ্রেণির মানুষের জীবনযাত্রা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বিধায় সরকার আর্থিক ক্ষতি সত্ত্বেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি অব্যাহত রেখেছে।

তবে এই ব্যবস্থা যে বেশিদিন চালু রাখা যাবে না, তা বোঝাই যাচ্ছে। অর্থনীতির সূত্র অনুযায়ী- দেশ যত উন্নতি করবে, দেশে সুদের হার তত কমতে থাকবে। তাছাড়া একসময় দেশে বন্ড মার্কেটও চালু করতে হবে। ফলে, সুদের হার যখন উল্লেখযোগ্য হ্রাস পাবে এবং যখন দেশে বন্ড মার্কেট চালু হবে, তখন সরকার নিরুপায় হয়েই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হবে। যার লক্ষণ ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। কেননা, সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির ওপর নানারকম শর্ত আরোপ করে সঞ্চয়পত্র বিক্রি সীমিত করে ফেলেছে। একারণেই সঞ্চয়পত্র যে কখনই পেনশনের বিকল্প হবে না, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়। অধিকন্তু, যারা সঞ্চয়পত্রে অর্থ বিনিয়োগ করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, তাদের উচিত হবে এখন থেকেই সঞ্চয়পত্রের বিকল্প কিছু ভাবা।
যে দেশে সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা ছাড়া অন্য কোনো মানুষের পেনশন সুবিধা নেই এবং যে দেশের জনসংখ্যা সতেরো কোটি, সেরকম একটি দেশে সকল মানুষের জন্য সর্বজনীন পেনশন চালু করা এককথায় অসাধ্য সাধনের মতো কাজ। তারপরও সরকার, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্যক্তিগতভাবে জনগণের কল্যাণের কথা ভেবে এই বিশাল কর্মযজ্ঞটি শুরু করে দিয়েছেন। এই উদ্যোগটি সফল করতে আমাদের সকলের উচিত সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। সরকার যেভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা চালু করে দিয়েছে, তাতে এটি যে একটি সর্বোত্তম ব্যবস্থাÑ এমন দাবি করা যাবে না। এমনকি সরকারও সেরকম দাবি করছে না।

তবে এই ব্যবস্থাকে আরও উন্নত এবং সকলের জন্য আরও সহায়ক ও গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য নিশ্চয়ই অনেক কিছু করার আছে। যেমন- পেনশনে অংশগ্রহণ সকল নাগরিকের জন্য বাধ্যতামূলক করা, সরকারি-বেসরকারি সকলকে একই পেনশন ছাতার নিচে নিয়ে আসা, পেনশন ফান্ডে জমানো অর্থের বিপরীতে ঋণ নেওয়ার সুযোগ পুনর্বিবেচনা করা প্রভৃতি।  এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতেই পারে। কিন্তু নিছক সমালোচনার জন্য নেতিবাচক সমালোচনা করে ইনস্যুরেন্সে বা সঞ্চয়পত্রের মতো আর্থিক সেবাকে পেনশনের বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করে সরকারের জনকল্যাণমূলক উদ্যোগ, সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অসহযোগিতা করার কোনো অর্থ হয় না। 

লেখক : ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা [email protected]

×