
শুভ জন্মাষ্টমী
শুভ জন্মাষ্টমী। বছর ঘুরে আবার এসেছে লীলা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শুভ আবির্ভাব তিথি জন্মাষ্টমী মহোৎসব। জাতি, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে জানাই এই মহাতিথির কৃষ্ণপ্রীতি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমী তিথিতে বসুদেবের পুত্ররূপে যদুবংশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি হচ্ছেন পূর্ণ পুরুষোত্তম। সমস্ত অংশ প্রকাশ এবং অবতারেরা সর্বদাই তাঁর মধ্যে বর্তমান থাকেন। দুষ্টের দমন এবং সৃষ্টির পালন নিশ্চিত করে ধর্ম সংস্থাপনের জন্য তিনি দ্বাপর যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা, পালন কর্তা আবার সংহারকও বটে। দ্বাপর যুগে ভগবানের লীলা বিলাসের সময় তিনি গোপ বালক, গোপ সখা, রথের সারথি, দ্বারকার রাজা ইত্যাদি বহু সত্তায় নিজেকে বিকশিত করেছেন। শ্রীমদ্ভাগবতে দশম স্কন্ধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাসের কাহিনী বর্ণিত রয়েছে। কৃষ্ণ নামের অর্থ সর্বাকর্ষক। ভগবান পাপী ও পুণ্যবান সবাইকে কাছে টানেন। তবে ভগবান তাঁর ভক্তদের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত বিধায় তাঁকে বলা হয় ভক্তবৎসল।
লীলা পুরুষোত্তম পরমেশ^র ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর ভক্তদের এতটাই ভালোবাসেন যে, তিনি শুদ্ধ ভক্তদের মাঝে বসবাস করেন। পদ্মপুরাণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নারদকে উদ্দেশ করে বলেছেন– ‘হে নারদ! আমি বৈকুণ্ঠে থাকি না, যোগীদের হৃদয়েও থাকি না। আমার ভক্তগণ যেখানেই আমার লীলাবিলাসের গুণকীর্তন করে, আমি সেখানেই থাকি।’ ভগবান ভক্তের সান্নিধ্য ভালোবাসেন বলেই শুদ্ধভক্তের সঙ্গ বা সংস্পর্শ এত মহিমাময়। আমরা যদি ভগবানকে লাভ করতে চাই, তাহলে শুদ্ধভক্তের সান্নিধ্য আগে লাভ করতে হবে। জানতে হবে, কীভাবে আমরা ভগবানকে লাভ করতে পারি? ভগবানকে লাভ করার পন্থা বা উপায় শুদ্ধভক্তেরা জানেন এবং সেই মতো সাধারণ মানুষকে তাঁরা পথ দেখান।
শুদ্ধভক্তের কাছ থেকে ভগবানকে লাভ করার উপায় জেনে নিয়ে যে কেউ ভগবানের আরাধনায় নিয়োজিত হতে পারেন। শ্রীমদ্ভ গবত গীতায় (১০/১০) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, ‘যাঁরা নিত্য ভক্তিযোগ দ্বারা প্রীতিসহকারে আমার ভজনা করে, আমি তাঁদের শুদ্ধ জ্ঞানজনিত বুদ্ধিযোগ দান করি, যার দ্বারা তাঁরা আমার কাছে ফিরে আসতে পারেন।’ পরমেশ^র ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে লাভ করার সহজ উপায় আর কি হতে পারে? আমরা অনেকেই অজ্ঞানতার অন্ধকারে কিংবা মায়ার প্রভাবে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছি যে, ভগবানকে যথাযথভাবে জানার সুযোগ আমাদের হচ্ছে না। কিংবা ভগবানকে জানার সুযোগ আমরা পাচ্ছি না। এ ধরনের জীবদের উদ্দেশে ভগবান বলেছেন– ‘তাঁদের প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আমি তাঁদের হৃদয়ে অবস্থিত হয়ে, উজ্জ্বল জ্ঞান-প্রদীপের দ্বারা অজ্ঞানজনিত অন্ধকার নাশ করি।’ (গীতা ১০/১১)।
ঐকান্তিকভাবে ভগবানের আরাধনায় নিয়োজিত হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের সকলের হৃদয়ের অজ্ঞতা কিংবা অজ্ঞানজনিত অন্ধকার বা মায়া দূর করে চিন্ময় আলোতে আলোকিত করবেন- এ অঙ্গীকারে তিনি তাঁর সখা অর্জুনের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। সমাজে বসবাসরত সাধারণ মানুষকে দেহরক্ষা অথবা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিধান পালনের জন্য বিভিন্ন কর্ম করতে হয়। এসব কর্ম করতে গিয়ে সংসর্গজনিত দুর্ঘটনায় কখনো কখনো কৃষ্ণভাবনা-পরায়ণ মানুষও এমন কাজ করে বসেন, যা সমাজ-ব্যবস্থা ও রাজনীতির পরিপেক্ষিতে অত্যন্ত গর্হিত বলে মনে হয়। এ ধরনের মানুষকে জনসাধারণ দুরাচারী বলে। আমাদের সমাজে দুরাচারী ব্যক্তিদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়। কেউ তাদের সংস্পর্শে আসতে চায় না।
তাদের সামাজিক মর্যাদা দেয় না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই দুরাচারীদেরও মুক্তির পথ দেখিয়েছেন। গীতায় (৯/৩০) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন– ‘অতি দুরাচারী ব্যক্তিও যদি অনন্য ভক্তিসহকারে আমাকে ভজনা করেন, তাকে সাধু বলে মনে করবে। কারণ তাঁর দৃঢ় সংকল্পে তিনি যথার্থ মার্গে অবস্থিত।’ দুরাচারীদের শুধু সামাজিক কিংবা আধ্যাত্মিক মর্যাদাই ভগবান দেননি, বরং ভগবানের শ্রীপাদ পদ্মে আত্মসমর্পিত ব্যক্তিকে ধর্মাত্মা বলে পরিচিতি দিয়েছেন এবং কোনো অবস্থাতেই তার বিনাশ হবে নাÑ এই মর্মে ভগবান ঘোষণা করে গীতায় (৯/৩১) বলেছেন– ‘তিনি শীঘ্রই ধর্মাত্মায় পরিণত হন এবং শান্তি লাভ করেন। হে কৌন্তেয়, তুমি দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা কর যে, আমার ভক্ত কখনো বিনষ্ট হন না।’
কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে, ভগবান ভক্তদের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতী। সাধারণ মানুষ বা অভক্তদের প্রতি তিনি তাঁর করুণাধারা বিগলিত করেন না। এ প্রসঙ্গে (গীতা ৯/২৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন– ‘আমি সকলের প্রতি সমভাবাপন্ন। কেউই আমার বিদ্বেষ ভাবাপন্ন নয় এবং প্রিয়ও নয়। কিন্তু যাঁরা ভক্তিপূর্বক আমার ভজনা করেন, তাঁরা আমাতে অবস্থান করেন এবং আমি তাঁদের মধ্যে বাস করি।’ আসলে এই জড় জগতে কোনো মানুষ মহাদানী হতে পারে, তবু সে তার নিজের সন্তানদের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত। ভগবান দাবি করেছেন যে, প্রতিটি জীবই তাঁর সন্তান, তা সে যে যোনিতেই জন্ম গ্রহণ করুক। তাই তিনি সমস্ত প্রাণীর জীবনের সব রকম প্রয়োজন উদারভাবে পূর্ণ করেন।
পাষাণ, স্থল ও জলে কোনোরকম ভেদবুদ্ধি না করে মেঘ যেমন সর্বত্রই সমানভাবে বর্ষণ করে, ভগবানের করুণাও তেমনই সকলের ওপর সমভাবে বর্ষিত হয়। কিন্তু তাঁর ভক্তের ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ মনোযোগ প্রদান করেন। এই ভক্তের কথা এখানে বর্ণনা করা হয়েছে- তাঁরা কৃষ্ণভাবনায় নিয়তই মগ্ন, তাই তাঁরা সর্বদাই কৃষ্ণের মধ্যে অপ্রাকৃত স্তরে স্থিত থাকেন। ‘কৃষ্ণভাবনা’ এই শব্দটির অভিব্যক্তি এই যে, এই প্রকার চেতনাসম্পন্ন মানুষ শ্রীভগবানের মধ্যে স্থিত জীবন্মুক্ত যোগী। ভগবান এখানে তাদের সম্পর্কে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তারা আমাতে স্থিত। স্বভাবতই ভগবানও তাঁদের মধ্যে স্থিত থাকেন। ভগবান ও ভক্তের এই সম্পর্ক পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত।
এই ভাবকে অন্যত্র ভগবান বলেছেন– ‘আমার প্রতি শরণাগতির মাত্রা অনুসারে আমি তাঁর তত্ত্বাবধান করি।’ ভগবান ও ভক্তের মধ্যে এই অপ্রাকৃত বিনিময় বর্তমান। কারণ, ভগবান ও শুদ্ধভক্ত উভয়েই চৈতন্যময়। জীব ভগবৎ সেবায় উন্মুখ হলে ভক্ত ও ভগবানের মধ্যে এই অপ্রাকৃত বিনিময় চলতে থাকে। এটি ভক্তদের প্রতি ভগবানের বিশেষ কৃপার অভিব্যক্তি। তবে ভক্ত ও ভগবানের এই ভাব বিনিময়কে কর্মফলের অধীন বলে মনে করা উচিত নয়।
লেখক : সিনিয়র শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরী হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজ,
প্রাক্তন সভাপতি. শ্রীচৈতন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতি সংঘ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়