ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ছয় দফা ॥ শহীদের রক্তে লেখা

তোফায়েল আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:১৩, ৬ জুন ২০২৩

ছয় দফা ॥ শহীদের রক্তে লেখা

প্রতিবছর ঐতিহাসিক সাতই জুন তথা ‘ছয় দফা দিবস’ আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করি

কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপোস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়Ñ এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।

প্রতিবছর ঐতিহাসিক সাতই জুন তথা ‘ছয় দফা দিবস’ আমরা যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করি। এ বছর সাতই জুন তথা ছয় দফা দিবসের ৫৭তম বার্ষিকী। বঙ্গবন্ধুর নিঃশর্ত মুক্তি ও ছয় দফা দাবির বাস্তবায়নে ১৯৬৬-এর সাতই জুনের কর্মসূচি পালনে মনু মিয়া, মুজিবুল্লাহসহ অসংখ্য শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ছয় দফা। ছয় দফা ও সাতই জুন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে বিধায় জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। পরবর্তীতে ’৬৯-এর গণআন্দোলনের সূচনালগ্নে এই ছয় দফা দাবি দাড়ি-কমা- সেমিকোলনসমেত এগারো দফা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে প্রবল গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তথাকথিত ‘সংখ্যা-সাম্য’ বাতিল করে ‘এক মাথা এক ভোট’ দাবি ও জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের হিস্যা আদায় করে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ’৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচনে জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমে রাজনৈতিক বৈধতা নিয়ে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা এক দফা তথা স্বাধীনতা অর্জন করেছি।

বঙ্গবন্ধু বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তাঁর হৃদয়ের গভীরে সততই প্রবহমান ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতা ছাড়া ভিন্ন কোনো চিন্তা তাঁর ছিল না। জেল-জুলম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে পরাধীনতার নাগপাশ থেকে বাংলাদেশকে তিনি স্বাধীন করেছেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রবক্তা। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের অভিপ্রায় থেকেই তিনি জাতির উদ্দেশে ছয় দফা কর্মসূচি প্রদান করেছিলেন। যে কারণে ছয় দফাকে বলা হয় ‘জাতির মুক্তি সনদ’।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান এদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করে সংখ্যাগুরু বাঙালি জাতিকে গোলামির শৃঙ্খলে শৃঙ্খলিত করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল। এর বিপরীতে, বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ’৬৬-এর ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহ আহূত কনভেনশনে সাবজেক্ট কমিটির সভায় ‘ছয় দফা’ উত্থাপন করে তা বিষয়সূচিতে অন্তর্ভুক্তের প্রস্তাব করেন। কিন্তু সভার সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ‘ছয় দফা দাবি ‘অন্তর্ভুক্ত করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে ১১ ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে ঢাকা বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ও ২০ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে।

‘ছয় দফা’ দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর জনমত সংগঠিত করতে বঙ্গবন্ধু তাঁর সফর সঙ্গীসহ ’৬৬-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানের জনসভায় ‘ছয় দফা’কে ‘নূতন দিগন্তের নূতন মুক্তিসনদ’ হিসেবে উল্লেখ করে চট্টগ্রামবাসীর উদ্দেশে বলেন, ‘একদিন সমগ্র পাক-ভারতের মধ্যে ব্রিটিশ সরকারের জবরদস্ত শাসনব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে এই চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়েই বীর চট্টলের বীর সন্তানরা স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেছিলেন। আমি চাই যে, পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত মানুষের জন্য দাবি আদায়ে সংগ্রামী পতাকাও চট্টগ্রামবাসীরা চট্টগ্রামেই প্রথম উড্ডীন করুন।’ চট্টগ্রামের জনসভার পর দলের আসন্ন কাউন্সিল সামনে রেখে ‘ছয় দফা’র যৌক্তিকতা তুলে ধরতে তিনি একের পর এক জনসভা করেন। এরই অংশ হিসেবে ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীর মাইজদি, ওইদিনই বেগমগঞ্জ, ১০ মার্চ ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, ১১ মার্চ ময়মনসিংহ সদর ও ১৪ মার্চ সিলেটে অনুষ্ঠিত জনসভায় জনতার দরবারে তাঁর বক্তব্য পেশ করেন।
‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্যবিশিষ্ট ‘উপ কমিটি’ গঠন এবং তাঁরই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। একই বছরের ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ ছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন। এদিন কাউন্সিল সভায় পুস্তিকাটি বিলি করা হয়। দলের সিনিয়র সহসভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গীত হয়। সেদিনের কাউন্সিল সভায় আগত ১৪৪৩ জন কাউন্সিলর বঙ্গবন্ধুকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও মিজানুর রহমান চৌধুরীকে সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত করে।

‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে সংশোধিত দলীয় গঠনতন্ত্রের একটি খসড়াও অনুমোদন করা হয়। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে ‘ছয় দফা’র ভিত্তিতে দলীয় গঠনতন্ত্র এবং নেতৃত্ব নির্বাচনে যে পরিবর্তন সাধিত হয়, তা পরবর্তীকালে ‘ছয় দফা’র চূড়ান্ত পরিণতি এক দফা তথা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের ইঙ্গিতবাহী ছিল। ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি দলীয় কর্মীদের মধ্যে বিশেষ করে আমাদের মতো অপেক্ষাকৃত তরুণ ছাত্রলীগ নেতৃত্বের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে ‘ছয় দফা’ এতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যে, বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে এই পুস্তিকা সযতেœ রক্ষিত হয়। ‘ছয় দফা’ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘সাঁকো দিলাম, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতায় উন্নীত হওয়ার জন্য।’ বস্তুত, ‘ছয় দফা’ ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজমন্ত্র তথা অঙ্কুর।

কাউন্সিল অধিবেশনের শেষদিন অর্থাৎ ২০ মার্চ চরম প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় দলীয় নেতা-কর্মী ও দেশবাসীর উদ্দেশে উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘চরম ত্যাগ স্বীকারের এই বাণী লয়ে আপনারা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়–ন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানিয়ে দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জেনে-শুনেই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্ব পণ করে নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য এগিয়ে আসছে।’
আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল অধিবেশনটি ছিল বাঙালির ইতিহাসে বাঁক পরিবর্তন। যা ’৬৯-এর মহান গণঅভ্যুত্থান, ৭০-এর ঐতিহাসিক নির্বাচন ও ’৭১-এর মহত্তর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল।

কাউন্সিল সভার সমাপনী জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ছয় দফার প্রশ্নে কোনো আপোস নাই। রাজনীতিতেও কোনো সংক্ষিপ্ত পথ নাই। নেতৃবৃন্দের ঐক্যের মধ্যেও আওয়ামী লীগ আর আস্থাশীল নয়। নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিত প্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়Ñ এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই ছয় দফা আদায় করতে হবে। কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবে না। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তি সনদ।’ স্বভাবসুলভ কণ্ঠে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে’ উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘এই আন্দোলনে রাজপথে যদি আমাদের একলা চলতে হয় চলব। ভবিষ্যৎ ইতিহাস প্রমাণ করবে বাঙালির মুক্তির জন্য এটাই সঠিক পথ।’ সফলভাবে সমাপ্ত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের পর বঙ্গবন্ধু সারাদেশ চষে বেড়ান। ২৬ মার্চ সন্দ্বীপ এবং ২৭ মার্চ সাতকানিয়ার বিশাল জনসভায় ‘ছয় দফা’ কর্মসূচি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতা করেন। এরপর ৭ এপ্রিল উত্তরাঞ্চল সফরে পাবনা ও নগরবাড়ির  জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। এরপর এপ্রিলের ৮ বগুড়া, ৯ রংপুর, ১০ দিনাজপুর, ১১ রাজশাহী, ১৪ ফরিদপুর, ১৫ কুষ্টিয়া, ১৬ যশোর এবং ১৭ তারিখ খুলনায় বিশাল সব জনসভায় ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ বক্তৃতা করেন।

এভাবে সারাদেশে ৩৫ দিনে মোট ৩২টি জনসভায় তিনি বক্তৃতা করেন। বিপুল সংখ্যক জনতার অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় ‘ছয় দফা’র সপক্ষে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ওপর নেমে আসে স্বৈরশাসক আইয়ুবের নির্মম গ্রেপ্তার-নির্যাতন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রদত্ত বক্তৃতার প্রতিপাদ্য বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে বঙ্গবন্ধুকে প্রত্যেক জেলা থেকে জারিকৃত ওয়ারেন্ট বলে লাগাতার গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ১৭ এপ্রিল রাত ৪ টায় খুলনায় এক জনসভায় ভাষণদান শেষে ঢাকা ফেরার পথে রমনা থানার জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা বলে পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে। যশোর মহকুমা হাকিমের এজলাস হতে তিনি জামিন পান।

ঐদিনই রাত ৯টায় সিলেটে গ্রেপ্তার, পুনরায় জামিনের আবেদন এবং ২৩ এপ্রিল জামিন লাভ। ২৪ এপ্রিল ময়মনসিংহে গ্রেপ্তার, ২৫ এপ্রিল জামিন। ‘ছয় দফা’ প্রচারকালে ৩ মাসে বঙ্গবন্ধুকে সর্বমোট ৮ বার গ্রেপ্তার করা হয়। এভাবেই আইয়ুবের দমন নীতি অব্যাহত থাকে। একই বছরের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় ঐতিহাসিক ‘মে দিবস’ স্মরণে শ্রমিক জনতার এক বিরাট সমাবেশে শ্রমিকরা বঙ্গবন্ধুকে বিপুল সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে।  ভাষণদান শেষে রাত ১টায় তিনি যখন বাসায় ফেরেন তখন পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ‘ক’ ধারা বলে তাঁকে এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়। ‘ছয় দফা’ দেওয়াকে অপরাধ গণ্য করে স্বৈরশাসক আইয়ুব বঙ্গবন্ধুকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ হিসেবে অভিহিত করে দেশরক্ষা আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের ওপর অব্যাহত গ্রেপ্তার-নির্যাতন চালায়।

সামরিক সরকারের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আহ্বানে ১৩ মে সমগ্র প্রদেশে ‘প্রতিবাদ দিবস’ পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসের জনসভায় ‘ছয় দফা’র প্রতি গণমানুষের বিপুল সমর্থন প্রকাশ পায়। হাজার হাজার শ্রমিক এদিন স্বতঃস্ফূর্তভাবেই হরতাল পালন করে এবং পল্টনে অনুষ্ঠিত জনসভায় উপস্থিত হয়ে সরকারের দমন নীতির তীব্র প্রতিবাদ করে। দলের নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেপ্তার করা হলে সাংগঠনিক সম্পাদক মিজান চৌধুরী অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। 
স্বাধিকারের দাবিতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি ও নেতৃবৃন্দের গ্রেপ্তার-নির্যাতনের প্রতিবাদে ’৬৬-এর ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে ‘সাতই জুন’ সর্বব্যাপী হরতাল আহ্বান করা হয়। বাংলার গণমানুষ সাতই জুন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বব্যাপী হরতাল পালন করেছিল। সাতই জুনের হরতালে সমগ্র পূর্ব বাংলা যেন অগ্নিগর্ভ। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বাধিকার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল।

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ছাত্রলীগের সার্বক্ষণিক কর্মী, ইকবাল হল (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, আমীর হোসেন আমু, সৈয়দ মাজহারুল হক বাকী, আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে- আমরা সেদিন হরতাল কর্মসূচি পালনের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করি। সেদিনের হরতাল কর্মসূচিতে ধর্মঘটী ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। পুলিশের গুলিতে তেজগাঁওয়ে শ্রমিক মনু মিয়া, আদমজীতে মুজিবুল্লাহসহ ১১ জন শহীদ হন এবং প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেপ্তার করা হয়।

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে হরতাল সফল করার দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা খালেদ মোহাম্মদ আলী ও নূরে আলম সিদ্দিকী। তারা সেখানে বক্তৃতা করেন। প্রকৃতপক্ষে সাতই জুন ছিল স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথের আরম্ভস্থল তথা যাত্রাবিন্দু। আর আমরা যারা ছাত্রলীগের কর্মী ছিলাম, আমাদের স্বাধীনতার চেতনার ভিত্তিও স্থাপিত হয়েছিল এদিনটিতেই।
১৯৫২-এর ২১ ফেব্রুয়ারির মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬২-এর ১৭ সেপ্টেম্বরের ‘শিক্ষা আন্দোলন’; ’৬৬-এর ৭ জুন ‘ছয় দফা আন্দোলন’; ’৬৯-এর ১৭ থেকে ২৪ জানুয়ারির ‘গণআন্দোলন-গণঅভ্যুত্থান’; ৯ ফেব্রুয়ারি ১১-দফা বাস্তবায়ন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে ‘শপথ দিবস’ পালন; স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের পদত্যাগ, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার ও বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজবন্দীর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি লাগাতার সংগ্রাম শেষে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম প্রদান। অতঃপর ২২ ফেব্রুয়ারি সকল রাজবন্দীর মুক্তির পর বঙ্গবন্ধুর মুক্তি লাভ এবং ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে ‘মুক্ত মানব শেখ মুজিব’কে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান।

পঞ্চাশের দশক থেকে বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের লক্ষ্যে গড়ে তোলা সকল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে ছাত্রলীগ। এসব মহিমান্বিত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ছাত্রলীগ অর্জন করেছে গণতান্ত্রিক তথা নিয়মতান্ত্রিক আচরণ ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং জয় করেছে বাংলার মানুষের হৃদয় আর সৃষ্টি করেছে ইতিহাস। অতীতে আমাদের সময়ে ছাত্রলীগের সম্মেলন গঠনতন্ত্র মোতাবেক প্রতি বছর ২১ মার্চের মধ্যে সম্পন্ন করার বাধ্যবাধকতা ছিল। তা না হলে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটির কাছে নেতৃত্ব তুলে দিতে হতো। এটাই ছিল বিধান এবং গঠনতান্ত্রিক বিধি-বিধানের অন্যথা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। আজ অতীতের সেই সোনালি দিনগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই স্মৃতির পাতায় দেখি, সেদিনের ছাত্রলীগ ছিল বাংলার গণমানুষের অধিকার আদায় তথা ‘মুজিবাদর্শ’ প্রতিষ্ঠার ভ্যানগার্ড।

মূলত বঙ্গবন্ধু মুজিবের নির্দেশে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতৃত্বই সেদিন সারাদেশে সাতই জুনের কর্মসূচি সফলভাবে পালন করে স্বাধিকারের পথে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। আর বাংলার মেহনতি মানুষ আত্মত্যাগের অপার মহিমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীসহ সমগ্র বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রদত্ত ‘ছয় দফা’ই হচ্ছে বাঙালি জাতির মুক্তিসনদ।
আজ সাতই জুনে অতীতের অনেক স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। বঙ্গবন্ধুর স্নেহে আমার জীবন ধন্য। সাতই জুনের শহীদের রক্তের সিঁড়ি বেয়ে জাতির পিতার সংগ্রামী চেতনার ভিত্তিতে, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আজ আমরা উন্নয়নের নবদিগন্তের সূচনা করেছি। বর্তমান সময়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও অনাকাক্সিক্ষত বিভিন্ন রকম বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ^ অর্থনীতিতে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। দেশের অর্থনীতিতেও তার প্রভাব পড়েছে। তবে আমি মনে করি এটি সাময়িক। ধৈর্য সহকারে বাস্তবভিত্তিক কৌশলগত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলে এই সংকট উত্তরণ সম্ভব।

বর্তমানে বহুল আলোচিত বিষয় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’-এর সফল বাস্তবায়নের পথ ধরেই এবারের লক্ষ্য ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ কর্মসূচিতে কী আছে এবং কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবে তা নিয়ে সুধী সমাজে আলোচনা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।” ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর রূপরেখা ঘোষণা করে তিনি এর চারটি স্তম্ভের কথা বলেছেনÑ (১) স্মার্ট সিটিজেন; (২) স্মার্ট গভর্নমেন্ট; (৩) স্মার্ট ইকোনমি এবং (৪) স্মার্ট সোসাইটি। প্রধানমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করে আরও বলেছেন, ‘২০৪১ সালের মধ্যে সারাদেশের সর্বস্তরের জনগণকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ গড়ে উঠবে।’

এসব কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে হলে ‘স্মার্ট সিটি ও স্মার্ট ভিলেজ বাস্তবায়নের জন্য স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট ট্রান্সপোর্টেশন, স্মার্ট ইউটিলিটিজ, নগর প্রশাসন, জননিরাপত্তা, কৃষি, ইন্টারনেট কানেকটিভিটি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করতে হবে।’ এ জন্য আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, রোবটিক্স, মাইক্রোচিপ ডিজাইনিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং ও সাইবার সিকিউরিটি, এ চারটি প্রযুক্তিতে আমাদের মনোযোগী হতে হবে। আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে চারটি ভিত্তির কথা পুনরুল্লেখ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের জনশক্তিকে স্মার্ট হতে হবে, প্রতিটি কাজ অনলাইনে করতে শিখতে হবে, ইকোনমি হবে ই-ইকোনমি যাতে সম্পূর্ণ অর্থ ব্যবস্থাপনা ডিজিটাল ডিভাইসে করতে হবে।’

আমি বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্দীপনামূলক যে দৃঢপ্রতিজ্ঞ মনোভাব নিয়ে উদয়াস্ত কাজ করছেন, তাঁর নির্দেশমালা যদি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি, তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের মতো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর কর্মসূচিও সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারব। আসলে তিনি ত্ার পিতার মতোই অন্তর থেকে যা বিশ্বাস করেন, তাই বলেন এবং বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধু দুটি লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেছেন। একটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আরেকটি অর্থনৈতিক মুক্তি। তিনি আমাদের স্বাধীনতা দিয়েছেন কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি দিয়ে যেতে পারেননি। সেই কাজটি দক্ষতা, সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করে চলেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে উত্তরণের স্বপ্ন নিয়ে নবপ্রজন্ম আজ প্রগতির পথে ধাবমান। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় অগ্রগতির এই অভিযাত্রার প্রারম্ভ বিন্দু ছিল ঐতিহাসিক সাতই জুন। আর তাই স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন চেতনার প্রারম্ভ বিন্দু ঐতিহাসিক সাতই জুনের শহীদদের অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন আমার পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করি। 

লেখক : আওয়ামী লীগ নেতা; 
সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি
[email protected]

×