ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত অবস্থান এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা

রায়হান আহমেদ তপাদার

প্রকাশিত: ২০:৪৫, ২৭ মে ২০২৩

চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীত অবস্থান এবং বৈশ্বিক অস্থিরতা

চার দফায় প্রায় চব্বিশ বছর রাশিয়ার ক্ষমতায় পুতিন

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা জোট ও রাশিয়া উভয়েই কমজোরি হয়ে পড়েছে। এখন এরা কেউ আর দক্ষিণের ওপর নিজের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিতে সক্ষম নয়। ফলে সংহত হচ্ছে চতুর্থ বলয়Ñ বৈশ্বিক দক্ষিণ। যুক্তরাষ্ট্র চায় এককৌণিক বিশ্ব। তার কাছে বহুকৌণিকতা মানেই সংঘর্ষ ও অস্থিরতা। কিন্তু বৈশ্বিক দক্ষিণ মনে করে বহুকৌণিকতা একুশ শতকের উপযোগী একটি স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থার ভিত হিসেবে কাজ করতে পারে। একটি অর্থপূর্ণ বহুমেরু বিশ্ব গঠিত হলে তা বিশ্বশান্তির জন্য ইতিবাচকই হবে।

গত এক শতকের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট এক বা দুই পরাশক্তিনির্ভর বিশ্ব আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য মোটেই সহায়ক নয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গঠিত বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক আইনের কথা যতই বলা হোক সে ব্যবস্থায় ছড়ি ঘোরানোর একচ্ছত্র অধিকার শুধু পরাশক্তিগুলোর। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার জোরে তারাই নিজেদের পছন্দমতো আইন বানাচ্ছে, আইন ভাঙছে। দক্ষিণের দেশগুলো দাবি তুলেছে নিরাপত্তা পরিষদে তাদেরও ভেটো ক্ষমতা চাই। পৃথিবী বদলাচ্ছে, পুরনো শক্তিবলয় ভেঙে পড়ছে। নতুন শক্তিবলয় গড়ে উঠছে। নতুন যে  দক্ষিণ তার ন্যায্য পাওনা চুকিয়ে দেওয়ার সময় আসছে

চার দফায় প্রায় চব্বিশ বছর রাশিয়ার ক্ষমতায় পুতিন। কখনও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে, কখনও প্রেসিডেন্ট হিসেবে। শি জিনপিং চীনে সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আছেন এক দশকের বেশি। উভয়ে মাঝেমধ্যে নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় থাকতে এসব নির্বাচন কোনো ঝুঁকি তৈরি করে না। তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে কারও রাজনীতির মাঠে নামার সুযোগই ক্ষীণ। এ রকম চমৎকার ব্যবস্থা গণতান্ত্রিক বিশ্বে’র কোনো রাজনীতিবিদের পক্ষে বছরের পর বছর চালু রাখা কঠিন। ফলে, মূলধারার ওই বিশ্বব্যবস্থা থেকে সি ও পুতিন ভিন্ন ব্যবস্থা গড়তে আগ্রহী। সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্টের মস্কো সফরের ভেতর দিয়ে উভয় নেতার ওই নতুন বিশ্বব্যবস্থার সাধনা শক্ত জমিন পেয়েছে বলে ভূরাজনীতিবিদরা জানাচ্ছেন। কেউ কেউ অবশ্য বলছেন, বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের ভঙ্গুর দেহে মোটা একটা পেরেক ঠোকার মতো বিষয় হলো এটা। বাংলাদেশ এবং অন্যান্য দেশে সি ও পুতিনের সমর্থক বামপন্থী তাত্ত্বিকদের প্রত্যাশা হলো, এই দুই রাষ্ট্রনায়কের মৈত্রী বিশ্বকে পশ্চিমা হেজিমনি থেকে মুক্ত করবে।

অন্যদিকে, চীন-রাশিয়া অক্ষশক্তিকে নিয়ে গণতান্ত্রিক বিশ্বের ভয়-সি ও পুতিন মিলে ধীরে ধীরে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থাকে পাল্টাতে চাইবেন এবং সেই চেষ্টা অন্তত চীনের দিক থেকে প্রকাশ্যে শুরু হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী শাসন-সংস্কৃতির সুনামিও বইছে। ইতোমধ্যে বহুল আলোচিত বিশ্বায়নের স্বপ্ন ভেঙে পড়েছে। কথিত ওই অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন থেকে মূলত গণচীনই লাভবান হয়েছিল এবং সেই লাভের ওপর দাঁড়িয়ে তারা এখন দেশে দেশে তাদের সমর্থক ছোট ছোট স্থানীয় একদলীয় শাসক খুঁজছে। যাকে রাশিয়াসহ তারা বলছে পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থার বিকল্প। সংগত কারণেই নতুন এ বিশ্বব্যবস্থায় সব মহাদেশের খুদে একনায়করা বাড়তি ভরসার জায়গা খুঁজে পাচ্ছেন। 
গণতন্ত্র ও বাক্স্বাধীনতার জন্য আন্তর্জাতিক খবরদারি এড়াতে চীন-রাশিয়া তাদের জন্য বেশ নিরাপদ এক আশ্রয় হয়ে উঠতে পারে। একুশ শতকের বিশ্বব্যবস্থার একটি নতুন উপাদান হলো পরাশক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব। পারমাণবিক অস্ত্র আছে বলেই নয়, অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণেও সে এখন বিশ্বের ২ নম্বর শক্তি। সামরিক শক্তিতেও অন্য দুই পরাশক্তিকে পাল্লা দিতে সক্ষম। দেশটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা আরও ভালোভাবে ঠাহর হয় ইউক্রেনে রুশ হামলার পর। এই যুদ্ধে পুতিন কার্যত একা, চীনকে পাশে পেলে বোঝাটা কমে, সে জন্য তিনি কম কাঠখড় পোড়াননি। ইউক্রেনে রুশ হামলা ন্যাটোভুক্ত ইউরোপীয়দের জন্য বড় ধরনের আঘাত। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে তারা ফের একাট্টা হয়, ইউক্রেনের পক্ষে এক ‘প্রক্সি’ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিম এক হলেও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো ভিন্নপথ বেছে নেয়। এই যুদ্ধ তাদের জাতীয় স্বার্থবিরোধী, সেই যুক্তি মাথায় রেখে দক্ষিণের দেশগুলো একক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্মিলিতভাবে নিরপেক্ষ অবস্থানে আগ্রহী হয়ে ওঠে। বিশ বছর আগে হলে এ প্রশ্নে কোনো বড় বিতর্ক হতো না। আমেরিকার ইচ্ছাই তৃতীয় বিশ্ব মেনে নিত। কিন্তু এখন অবস্থা বদলাচ্ছে। দক্ষিণের দেশগুলোর কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী মনোভাব এড়াতে চীনের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে আগ্রহী। শুধু ব্রাজিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশ নয়, তেলসমৃদ্ধ সৌদি আরব ও উপসাগরীয় দেশগুলোও এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়।

মস্কোর সমর্থনে চীন তাদের মুদ্রা ইউয়ানকে ডলারের বদলে নতুন আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃতি চাইছে। ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো তো বটেই, সৌদি আরবও এ বিষয়ে তাদের আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছে। মস্কো ও বেজিং মনে করে, যুক্তরাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত এক মেরু বিশ্বব্যবস্থা তাদের জাতীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থ রক্ষায় বড় কাঁটা। এই কাঁটা তুলতে তারা একে অপরের সঙ্গে হাত মেলায়। 
ইউক্রেন আক্রমণের ঠিক আগের সপ্তাহে রাশিয়ার পুতিন ও চীনের সি নিজেদের মধ্যে বন্ধুত্বের ঘোষণা দিলেন। এই ঘোষণা থেকে ভাবা হয়েছিল, চীন হয়ত রাশিয়ার প্রতি সামরিক সমর্থন জোগাবে। রাশিয়া তাদের পরিকল্পনা মতো দুই সপ্তাহে কিয়েভ দখল করে ইউরোপের রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে দিতে পারলে চীন কী করত, তা অনুমান করা কঠিন নয়। কিন্তু যুদ্ধের এক মাস না যেতেই বোঝা গেল, মস্কো অঙ্কে বড় ধরনের ভুল করেছে। এই যুদ্ধে রাতারাতি জয় তার পক্ষে অসম্ভব। এ অবস্থায় চীন একটি আপাত-নিরপেক্ষ অবস্থান নেয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তার রাশিয়াকে চাই।

আবার বাণিজ্যিক কারণে পশ্চিমকেও সে হাতছাড়া করতে রাজি নয়। সেই কারণেই নিরপেক্ষতা। তার এই রণনীতির প্রমাণ মিলল জাতিসংঘে, যেখানে রাশিয়ার প্রতি নিন্দাসূচক প্রতিটি ভোটে সে ভোটদানে বিরত থাকল। জাতীয় সার্বভৌমত্বের অখ-তার পক্ষে জোর যুক্তি দিলেও সে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক সাহায্যের সমালোচনা করল। পাশাপাশি রাশিয়ার চাপ সত্ত্বেও তাকে কোনো অস্ত্র-বারুদ দিতে অস্বীকার করল। এদিকে গ্লোবাল সাউথের ভূমিকাও বহুলাংশে চীনের মতো। আফগানিস্তান-ইরাক যুদ্ধে অধিকাংশ দক্ষিণী দেশ মার্কিন নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল। ইউক্রেনের বেলায় নয়।

রাশিয়ার হামলা তারা সমর্থন করল না বটে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান সত্ত্বেও নিজেদের এই যুদ্ধে জড়াল না। বৈশ্বিক দক্ষিণের পঞ্চাশটির বেশি দেশ জাতিসংঘে ইউক্রেন প্রশ্নে ভোটদানে বিরত থাকে। এই যুদ্ধের ফলে জ্বালানির দাম বেড়েছে, খাদ্য সরবরাহ বিঘিœত হয়েছে। কোভিড-সংকটের সময় তারা দেখেছে, পরাশক্তির ওপর আর নির্ভর করা যায় না। ফলে, উভয় পরাশক্তি এড়িয়ে তারা নিজেদের পথ বেছে নিল। তৃতীয় বিশ্বের এই অবস্থান তাদের পরিপক্বতার প্রমাণ বলে ভাবা যেতে পারে। তবে বাস্তব সত্য হলো, যুক্তরাষ্ট্র বা রাশিয়া কেউ এখন আর আগের মতো শক্তিধর নয় যে, তাদের লেজুড় হয়ে থাকলে ফায়দা মিলবে। 
এই উপলব্ধি থেকেই বৈশ্বিক দক্ষিণের নীতিগত নিরপেক্ষ অবস্থান। এই নয়া কৌশলগত সমীকরণে নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারত, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যায় বলা হয়েছে, আজকের যে পৃথিবী, শীতল যুদ্ধের সময়ের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। আজকের পৃথিবী বাণিজ্য, প্রযুক্তি, অভিবাসন, ইন্টারনেট ইত্যাদির কারণে আমাদের একে অপরকে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক নিকটবর্তী করেছে। ইউক্রেনের বিষয়ে পশ্চিমের কথা হয়ত ঠিক যে, রাশিয়া সেখানে মানবাধিকারের লঙ্ঘন করছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্বও তো ভিয়েতনাম থেকে ইরাকে কতবার কতভাবে অন্যায় ও সহিংস হস্তক্ষেপ করেছে। আমরা তাই রাশিয়াকে একঘরে করার পশ্চিমা আহ্বানে মোটেই আগ্রহী নই।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই যুদ্ধের ফলে পশ্চিমা জোট ও রাশিয়া উভয়েই কমজোরি হয়ে পড়েছে। এখন এরা কেউ আর দক্ষিণের ওপর নিজের ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দিতে সক্ষম নয়। ফলে সংহত হচ্ছে চতুর্থ বলয়Ñ বৈশ্বিক দক্ষিণ। যুক্তরাষ্ট্র চায় এককৌণিক বিশ্ব। তার কাছে বহুকৌণিকতা মানেই সংঘর্ষ ও অস্থিরতা। কিন্তু বৈশ্বিক দক্ষিণ মনে করে বহুকৌণিকতা একুশ শতকের উপযোগী একটি স্থিতিশীল বিশ্বব্যবস্থার ভিত হিসেবে কাজ করতে পারে। একটি অর্থপূর্ণ বহুমেরু বিশ্ব গঠিত হলে তা বিশ্বশান্তির জন্য ইতিবাচকই হবে। গত এক শতকের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট এক বা দুই পরাশক্তিনির্ভর বিশ্ব আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য মোটেই সহায়ক নয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর গঠিত বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক আইনের কথা যতই বলা হোক সে ব্যবস্থায় ছড়ি ঘোরানোর একচ্ছত্র অধিকার শুধু পরাশক্তিগুলোর। নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার জোরে তারাই নিজেদের পছন্দমতো আইন বানাচ্ছে, আইন ভাঙছে। দক্ষিণের দেশগুলো দাবি তুলেছে নিরাপত্তা পরিষদে তাদেরও ভেটো ক্ষমতা চাই। পৃথিবী বদলাচ্ছে, পুরনো শক্তিবলয় ভেঙে পড়ছে। নতুন শক্তিবলয় গড়ে উঠছে। নতুন যে দক্ষিণ তার ন্যায্য পাওনা চুকিয়ে দেওয়ার সময় আসছে।
যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া আর চীনের বাইরে নতুন বলয় হচ্ছে বৈশ্বিক দক্ষিণ। দক্ষিণ বলয়ের ওপর আগের মতো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না কোনো পরাশক্তি। তারা নিজেদের স্বার্থে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে চায়। ত্রিশ বছর ধরে যারা বিশ্বকে ইউনিপোলার বা এক মেরু ভেবে এসেছে, এই স্বীকারোক্তিতে তাদের ভ্রƒ কোঁচকাতে পারে বৈকি। তিন বলয় মানে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া। কিন্ত চতুর্থ একটি সম্ভাব্য বলয়ের কথা বিশ্ব ভুলে গেছে। আর সেটি হলো তথাকথিত তৃতীয় বিশ্ব, যা এখন ‘গ্লোবাল সাউথ’ নামে পরিচিত। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে ঘিরে যে মেরুকরণ ঘটেছে, তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় বিশ্বরাজনীতির এই চতুর্থ স্তম্ভটি জমাট বাঁধতে শুরু করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্ব ভেবেছিল সারা বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয়ে চলে এসেছে। এর আগে দুর্বল হয়ে গেলেও সোভিয়েত ইউনিয়ন টিকে থাকতে তাকে দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে মানা হতো। নব্বই দশকের গোড়ায় নতুন ও খ-বিখ- রাশিয়া সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরাধিকারী হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও তাকে পরাশক্তি হিসেবে কেউ গায়ে মাখত না। তার পারমাণবিক ভা-ার ছিল বটে, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিল ও অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এতটাই কাবু করে ফেলেছিল যে, সে পরাশক্তির মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। সোভিয়েত ব্যবস্থার পতনের কারণেই এক মার্কিন প-িত ইতিহাসের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিলেন, যার মোদ্দাকথা ছিল, পশ্চিমা মূল্যবোধ ও রাজনীতির বিজয় হয়েছে। ২০ বছর না যেতেই নতুন করে হিসাব কষতে হলো।

প্রেসিডেন্ট পুতিন সেই রাশিয়াকে শুধু আগের জায়গায় ফিরিয়ে নেননি, পশ্চিমের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো অবস্থায় নিয়ে আসেন। ফলে, পৃথিবীর কর্তা আর এক নয়, দুইয়ে দাঁড়াল। কিন্তু গোল বাঁধল রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণে। এই আগ্রাসী অভিযান শুরুর আগে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোটে প্রচ্ছন্ন বিভক্তি ছিল। কোনো কোনো ইউরোপীয় দেশ, বিশেষত ফ্রান্স, ওয়াশিংটনের ছাতা থেকে বেরিয়ে আন্ত-ইউরোপীয় জোট গঠনে আগ্রহী হয়ে ওঠে। 
শুধু তেল-গ্যাসের খোঁজে মস্কোয় আসেননি প্রেসিডেন্ট সি। তার লক্ষ্য আরও গভীর। তিনি নিজেকে ও নিজের দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিকল্প পরাশক্তি হিসেবে উপস্থিত করতে চান। চীন অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে যত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমেই তীব্র হয়েছে। ওয়াশিংটন খোলামেলাভাবেই বেজিংকে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করছে। বাইডেন প্রশাসন বলেছে, রাশিয়া বা ইসলামি জঙ্গিবাদ নয়, চীনই তাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য প্রধান হুমকি। মাসখানেক আগে এক শীর্ষস্থানীয় মার্কিন জেনারেল এমন কথাও বলেছেন যে, তাইওয়ানকে নিয়ে আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য। এই চিত্রনাট্য চীনের অজানা নয়। 
যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে উঠতে দেয়নি, দেবেও না। সে হিসাব মাথায় রেখেই চীন প্রধানত তার নিজ প্রভাব বলয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সামরিক, বিশেষত সমুদ্রভিত্তিক উপস্থিতি সংহত করতে উঠেপড়ে লেগেছে। তাইওয়ানকেও সে নিজের অঙ্গীভূত করতে চায়। এই চেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রের চোখ এড়ায়নি। পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে সেও এই অঞ্চলে তার সামরিক শক্তি ও আঁতাত জোরদার করেছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সামরিক আঁতাত গড়ে তুলেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যকেও সে কাছে টেনে নিয়েছে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে নিজের সঙ্গী খুঁজতে গিয়ে রাশিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে চীন। হতে পারে রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের তুলনায় নস্যি, কিন্তু পারমাণবিক শক্তি হিসেবে সে কারও চেয়ে কম নয়। এই দুই দেশ এবং তার সঙ্গে যদি ব্রাজিল, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইরানের মতো দেশকে সঙ্গে পাওয়া যায়, তাহলে যে ‘বিকল্প’ বিশ্বব্যবস্থার কথা চীন ভেবেছে, তার বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়।

লেখক : গবেষক, লন্ডন প্রবাসী

[email protected]

×