ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ডিজিটাল কৃষি ভাবনা

ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৭ মে ২০২৩

ডিজিটাল কৃষি ভাবনা

চিরাচরিতভাবে বাংলাদেশের কৃষি প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে

চিরাচরিতভাবে বাংলাদেশের কৃষি প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে। কৃষির চ্যালেঞ্জসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো ক্রমাগত কৃষি জমি হ্রাস, আবহাওয়া ও জলবায়ুর অস্বাভাবিক পরিবর্তন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষি জমির ক্ষুদ্রায়তন, কৃষি শ্রমিক সংকট, বিশ্বব্যাপী কৃষি উপকরণের স্বল্পতা ও মূল্য বৃদ্ধি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, কৃষি জমির উৎপাদনশীলতা হ্রাস, নতুন নতুন রোগবালাই ইত্যাদি। এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যেও কৃষিতে বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদনে বিশ্বের গড় উৎপাদনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ।

তারপরও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের বাস্তবায়নে নতুন কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- ১. ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের পক্ষে উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ/ব্যয় নির্বাহ, ২. ডিজিটাল কৃষিতে জ্ঞান স্থানান্তর এবং প্রশিক্ষিত জনবল তৈরি, ৩. প্রযুক্তির স্থানীয়করণ, ৪. নলেজ গ্যাপ, ৫. ধীরগতির ইন্টারনেট, ৬. দেশীয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার তৈরি, ৭. কৃষক পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ, ৮. মোটিভেশন, ৯. বিপ্লবের সুফল সমবণ্টন ইত্যাদি। কৃষি মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুতের কাজ হাতে নিয়েছে। আইওটির সহযোগিতায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে কৃষি মন্ত্রণালয়াধীন সকল সংস্থা থেকে তিন ক্যাটাগরিতে প্রস্তাবিত কার্যক্রম যাচাই-বাছাইপূর্বক কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্তকরণের কাজ চলমান আছে। 
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে নির্দেশনা দিয়েছেন, ‘নিজেদের প্রয়োজনীয় খাদ্য নিজেদেরই উৎপাদন করতে হবে। এজন্য এক ইঞ্চি জমিও অনাবাদি রাখা যাবে না।’ প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসরণ করে এবং এসডিজিকে সামনে নিয়ে কৃষিমন্ত্রীর নেতৃত্বে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সকল দপ্তর ও সংস্থার সমন্বয়ে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইতোমধ্যে Rice Vision 2050 and Beyond এবং Doubling Rice Productivity in Bangladesh কৌশলপত্র প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নে কাজ করছে। কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে বেশ আগেই। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ধারণা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সফল প্রয়োগের (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিক্স, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, ইন্টারনেট অব থিংস্ ইত্যাদি) মাধ্যমে ‘স্মার্ট কৃষিই’ ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। 
স্মার্ট ফার্মিং বা কৃষির প্রধান তিনটি উদ্দেশ্য হলো - কৃষির উৎপাদনশীলতাকে টেকসই এবং আয় বৃদ্ধি করা, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কৃষিকে খাপ খাওয়ানো, উৎপাদনের সকল পর্যায়ে স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখা, সম্ভাব্য ক্ষেত্রে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন হ্রাস অথবা অপসারণ করা। ‘স্মার্ট ফার্মিং  বা কৃষি’র সারমর্ম হলো কৃষি কার্যক্রমে নতুন প্রযুক্তির প্রবর্তন। ড্রোন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, বিগ ডেটা, আইওটি, লোকেশন সিস্টেম, স্যাটেলাইট ইত্যাদির ব্যবহার কৃষিকাজ এবং কৃষিকে ‘স্মার্ট’ করে তোলে। ফলে কৃষি কাজে সম্পৃক্ত কৃষক তাদের কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজ অপ্টিমাইজ করতে পারে, যা কায়িক শ্রম ও দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন খরচ হ্রাস, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সহজীকরণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, উৎপাদন পরবর্তী ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণে সহজীকরণ, তথ্য সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণের গতি বাড়ানো ও কৃষি ব্যবসাকে আরও লাভবান করে তোলে। এসবের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো শস্যের গুণমান এবং পরিমাণ বৃদ্ধি করা ও ব্যবহৃত মানব শ্রমকে অপটিমাইজ করা।
স্মার্ট ফার্মিং এবং আইওটিচালিত কৃষি ‘তৃতীয় সবুজ বিপ্লব’-এর ভিত্তি স্থাপন করছে, যা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্মিলিত প্রয়োগ। এর মধ্যে রয়েছে যথার্থ সরঞ্জাম, আইওটি সেন্সর এবং অ্যাকচুয়েটর (এটি এমন একটি ডিভাইস, যা একটি নিয়ন্ত্রিত সংকেতকে যান্ত্রিক গতিতে রূপান্তর করতে সক্ষম), জিও-পজিশনিং সিস্টেম, মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকল (ইউএভি) এবং রোবটের মতো ডিভাইস। আইওটি প্রযুক্তি উৎপাদনের ঝুঁকি কমাতে কৃষির বিভিন্ন কার্যক্রম আরও ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য এবং পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে, যা কৃষকদের পরিকল্পনা এবং পণ্য বিতরণকে সহজ করবে।

উপরন্তু কৃষিসহ বেশ কয়েকটি সেক্টরে, পরিষেবা প্রদানকারী এবং মোবাইল অপারেটর কোম্পানি তাদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো আধুনিকীকরণ করছে, নেটওয়ার্ক সংস্থাগুলোকে গ্রাহকের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে আসছে এবং ৫-জি রোল-আউটে প্রস্তুত হওয়ার জন্য ছোট সেল ও বিশাল MIMO (Multiple-Input Multiple-Output)-এর মতো প্রযুক্তির মাধ্যমে দূরত্বকে একীভূত করছে। 
স্বল্প পরিসরে হলেও বাংলাদেশের কৃষিতে এর উপস্থিতি লক্ষণীয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি) ইতোমধ্যেই ধানের রোগবালাই ব্যবস্থাপনার জন্য পূর্ব সতর্কীকরণ, রোগ চিহ্নিতকরণ এবং দমনের  লক্ষ্যে ‘রাইস সল্যুশন’ নামক একটি মোবাইল অ্যাপস উদ্বোধন করেছে। এর মাধ্যমে ধানের মাঠ হতে আক্রান্ত ধান গাছের ছবি দেখে রোগ চিহ্নিত করতে সক্ষম। সাপ্তাহিক এবং মাসিক আবহাওয়া বার্তা প্রদান করা হয়, যার মাধ্যমে কৃষক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

অন্যদিকে ডায়নামিক ওয়েবসাইট তৈরিসহ সকল পর্যায়ে ই-গভর্নেন্স ও ই-কৃষিসেবা ব্যবস্থা চালুর লক্ষ্যে আরকেবি, ব্রি রাইস ডক্টর এবং আধুনিক ধানের পরিচর্যা নিয়েও মোবাইল অ্যাপস তৈরি করা হয়েছে। জিআইএস প্রযুক্তির মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে সেচ উপযোগী এলাকা চিহ্নিতকরণ ও ব্রি ধান৪৮ হতে ব্রি ধান১০০ পর্যন্ত মাটির গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে চাষাবাদ উপযোগিতার ম্যাপ তৈরি করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ড্রোন প্রযুক্তি নিয়ে কাজ শুরু করেছে। 
এসব রূপান্তরের মাধ্যমে দেশের জনগণের জীবনমানের গুণগত পরিবর্তনসহ টেকসই খাদ্য এবং অন্যান্য কৃষিপণ্যের সরবরাহকে নিরবচ্ছিন্ন ও বেগবান হবে।

লেখক : প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
[email protected]

×