ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৮ মে ২০২৫, ১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

টরন্টোর চিঠি

শাসন ও শোষণের পৃথিবী

শামীম আহমেদ

প্রকাশিত: ২০:৩৭, ২৩ মে ২০২৩

শাসন ও শোষণের পৃথিবী

সামারের এই সময়টায় কানাডায় আলোচ্য বিষয় অনেক থাকলেও বিতর্কের বিষয় কমই থাকে

সামারের এই সময়টায় কানাডায় আলোচ্য বিষয় অনেক থাকলেও বিতর্কের বিষয় কমই থাকে। মানুষ সূর্যের আলোতে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে, এই সময়টা তাদের আনন্দের সময়। এই সময় তারা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। একেকজন কানাডিয়ান এমনকি বছর খানেক আগে থেকে ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রাখেন। এই সময় যদি আপনি হোটেল, মোটেল বা এয়ারবিএনবি বুক করতে যান, তাহলে বিপদে পড়বেন। কারণ, প্রায় ৪-৫ মাস আগে থেকেই সব বুকিং শেষ হয়ে যায়। কাছাকাছি সময়ে যা পাবেন তা অত্যন্ত চড়ামূল্যের হবে।

আরেকটা জিনিস আমার মনে হয়েছে, ইউরোপে মানুষ যেমন প্রচুর অন্য দেশে বেড়াতে যায়, কানাডিয়ানরা তুলনামূলকভাবে নিজের দেশের ভেতরেই ঘুরতে পছন্দ করে। তার মানে এই নয় তারা বিদেশে যান না। যান তবে আমেরিকান বা ইউরোপিয়ানদের তুলনায় অনেক কম। ইউরোপিয়ানদের ক্ষেত্রে অবশ্য বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা লোকাল বাস-ট্রেন-প্লেনের ভাড়ায় ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের অন্যান্য দেশ ঘুরে বেড়াতে পারে। কিন্তু আমেরিকানরা অন্য দেশে ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করে। কেবল অন্য দেশেই নয়, তারা ভিন্ন পরিবেশ প্রকৃতির দেশে যেতে চায়। আমেরিকানরা মূলত অ্যাডভেঞ্চারাস জাতি। কানাডিয়ানরা সেই তুলনায় কিছুটা ‘ষধরফ নধপশ’ জাতি। তারা শান্তি পছন্দ করে বেশি, থিতু হতে চায়।

২০২৬ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজক তিনটি দেশ– আমেরিকা, কানাডা ও মেক্সিকো। আমার ধারণা, বিশ্বকাপকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ সংখ্যক বাংলাদেশীর সম্মিলন হবে সে বছর নর্থ আমেরিকায়। গত কয়েক দশকে কানাডায় যে পরিমাণ বাংলাদেশী এসেছে, আর আমেরিকায় তো এসেছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে, সেই বিবেচনায় অনেকের পরিবার, বন্ধুদের আবাসস্থল এখন আমেরিকা ও কানাডায়। সুতরাং মানুষ নিশ্চয় নর্থ আমেরিকা ভ্রমণ করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবল দেখে ফেলার এই সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাতে চাইবে না। তবে ওই সময়টায় বিশ্ব পরিস্থিতি কেমন থাকে সেটাও একটা বিবেচনার বিষয়। ইউক্রেন ইসু ততদিন জিইয়ে থাকবে বলে মনে হয় না। তবে পুতিন ক্ষমতায় থাকলে আমেরিকা-কানাডার সঙ্গে তাদের বৈরিতা পুরোপুরি বজায় থাকবে ওই সময়েও।

আমেরিকায় কে প্রেসিডেন্ট হলো সেটা একটু কম বিবেচ্য বিষয়। কেননা, আমেরিকানরা বরাবরই ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে বিশ্বাসী। যেই ক্ষমতায় আসুক আমেরিকার ‘মষড়নধষ ংঁঢ়ৎবসধপু’ তার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়। অন্যদিকে ইউরোপ বা রাশিয়ার পররাষ্ট্রনীতি অনেকটাই পরিবর্তিত হয় তাদের নেতার ওপর। গর্বাচেভ, বরিস ইয়েলেৎসিন কিংবা পুতিনের রাশিয়া যেন ভিন্ন তিনটি দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই, তা গর্বাচেভের সময় এসে মুখ থুবড়ে পড়ে। বরিস ইয়েলেৎসিন ছিলেন মূলত আমেরিকার পাপেট শাসক, কমিউনিস্ট রাশিয়ায় পুঁজিবাদের জনক।

পুতিন খুব ধীরে ধীরে পুঁজিবাদের প্রসার ঘটিয়েছেন, আবার তলে তলে আমেরিকার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে রাশিয়াকে বিশ্ব দরবারে দ্বিতীয় শক্তিশালী দেশ হিসেবে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ইউক্রেন যুদ্ধে প্রথমদিকে রাশিয়া নাস্তানাবুদ হচ্ছে এমনটা প্রচারে পশ্চিমা বিশ্ব সমর্থ হলেও এখন পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে পৃথিবীর প্রায় ৩০টি দেশ পরাস্ত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা তারা খেয়েছে ইউক্রেনে রাশিয়ার হাইপারসনিক মিসাইলের আঘাতে আমেরিকার প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হওয়া। উল্লেখ্য, এই একটি মিসাইল প্রতিরক্ষার দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১১০০ কোটি টাকা।

ফলশ্রুতিতে এটি ধ্বংস হয়ে যাওয়াতে ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর মেরুদ- ভেঙে গেছে। যদিও তারা বলছেন এটি মেরামত করা সম্ভব, কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই মিথ্যাচার তারা করছেন কেবল সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আসলে এটি তাদের সম্পূর্ণ পরাজয়। জার্মানির দেয়া আরেকটি প্যাট্রিয়ট মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইউক্রেনের আছে। কিন্তু এখন সেটি তারা আর ব্যবহার করতে সাহস পাবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়ার এই নতুন হাইপারসনিক মিসাইল প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে দিয়েছে। এই মিসাইলের সমকক্ষ মিসাইল এখন পৃথিবীর আর কোনো দেশের নেই।

উল্লেখ্য, সামরিক শক্তিধর অনেক দেশের সুপারসনিক মিসাইল আছে, যার গতি শব্দের সমান বা শব্দের গতিবেগের চাইতে কম। কিন্তু রাশিয়ার এই হাইপারসনিক মিসাইল শব্দের গতিবেগের চাইতে পাঁচগুণ গতিতে চলতে পারে যা অন্য কারও কাছে নেই এবং এই মিসাইল ঠেকানোর মতো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও পৃথিবীর আর কারও কাছে নেই। 

এছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জান্তিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মেরুকরণের ও বিভাজনের ঘটনা এত বেশি ঘটেনি যা গত বছরখানেকের মধ্যে ঘটেছে। জি ৭, জি ২০ ইত্যাদি প্লাটফর্মগুলোতে রাশিয়ার সমর্থনে চায়না ও ভারতের অনুপস্থিতি কিংবা শক্ত অবস্থান, সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাউথ আফ্রিকাকে পাশে নিয়ে পক্ষাবলম্বন পশ্চিমা বিশ্বের জন্য বিস্ময়করই বটে। বলার অপেক্ষা রাখে না, বিশ্ব বাণিজ্য ও সামরিক দরবারে এখনও তুলনামূলক দুর্বল শক্তির দেশ হয়েও বাংলাদেশ রাশিয়ার পক্ষে বেশ শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের বিনিয়োগ বন্ধু ভারত ও চায়নার রাশিয়ার পক্ষাবলম্বন, এর সবচেয়ে বড় কারণ।

সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ ও মাথা নত না করা পররাষ্ট্রনীতি, যেখানে তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে রাশিয়ার অবস্থান ও আমেরিকার বিরুদ্ধাচরণকে বর্তমানের অবস্থানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আমলে নিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও দ্রব্যমূল্য পরিস্থিতি নাগরিকদের সহনীয় পর্যায়ের বাইরে পৌঁছে গেছে বলে মনে হচ্ছে। বৈশ্বিক ঘোলাটে যুদ্ধাবস্থার কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি সবখানে। কানাডায় গত ৩ বছরে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বেড়েছে অনেক ক্ষেত্রে দ্বিগুণেরও বেশি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনগুণ।

অনেক ফল আগে বিক্রি হতো পাউন্ডে, এখন বিক্রি হয় সংখ্যায়। গরুর মাংসের দাম বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি, মুরগি দেড়গুণ, শাকসবজি প্রায় প্রতিটির দাম বেড়েছে তিনগুণের মতো। তাই বলছিলাম, বাজারে জিনিসপত্রের দাম অসহনীয়। বাংলাদেশেও, কানাডায়ও, সর্বত্র। কালকে বন্ধুদের একটা গ্রুপে কথা হচ্ছিল। যাদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তারা কেউ গরিব না, মধ্যবিত্তও না, স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড বড়লোক। বাপের সূত্রেও, নিজের যোগ্যতাতেও। সবার একাধিক বাড়ি, গাড়ি, জমি, ব্যাংক ব্যালেন্স আছে। সবাই মেধাবী, ভাল ছেলে। জিনিসপত্রের দাম নিয়ে প্রত্যেকে ত্যক্তবিরক্ত।

জিনিসপত্রের দাম, মানে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম সত্য বলতে বাংলাদেশের চাইতে কানাডায় গত অর্ধদশকে বেশি বেড়েছে। এখানে বাংলাদেশের মতো বোনাস নাই, বেতনে ইনফ্লেশন অ্যাডজাস্টমেন্টও নিয়মিত না। বেশিরভাগ মানুষের বাড়ি, গাড়ি ব্যাংকের লোনে কেনা। হিসাব মেলাতে সবাই হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে কানাডার পার্থক্য হচ্ছে অর্থনীতির অবস্থা যে উদ্বেগজনক, জিনিসপত্রের দাম যে বাড়ছে, সেটা এখানকার সরকার স্বীকার করে জনগণের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে এবং কী ভাবে মানুষকে সাহায্য করা যায় সেটি নিয়ে প্রতিনিয়ত ভাবে ও চেষ্টা করে, অন্তত কথা বলে। জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য করোনাভাইরাসে পৃথিবী তিন বছর স্থবির হয়ে থাকা এবং তার পরপরই ইউক্রেনে রাশিয়া-আমেরিকার যুদ্ধের কারণে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি তেল, গ্যাস ও খাদ্যশস্য উদপাদনকারী ইউক্রেন ও রাশিয়ার পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়া বড় কারণ এটা সবাই জানে। কিন্তু এই কথাগুলো বারবার বললে বিপদগ্রস্ত মানুষ আশ্বস্তবোধ করে না। একটা সমস্যা সমাধানের প্রথম ধাপ হচ্ছে সমস্যাটা স্বীকার করা। 
স্বীকার করা উচিত যে জিনিসপত্রের দাম অত্যধিক বেশি। সাধারণ মানুষের তো বটেই, উচ্চ মধ্যবিত্ত মানুষেরও নাগালের বাইরে। এটা নিয়ে কী করা যায় সেটা নিয়ে ভাবা, লেখা, আলোচনা করা উচিত। আমাদের দালাল, মধ্যস্বত্বভোগী, পরিবহন ব্যবস্থায় অরাজকতা, পুলিশ, রাজনীতিবিদদের চাঁদাবাজির বিষয়গুলো নিয়ে লেখা উচিত। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সব জায়গায় দাম বেড়েছে ঠিক, কিন্তু অন্য যে কারণগুলো লিখলাম সেগুলো তো কানাডায় নেই। তার মানে বাকি সমস্যাগুলার সমাধান করলে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে আমরা কানাডার চাইতেও সফল হতাম।
সোমবার কানাডায় ছুটি। রাণী ভিক্টোরিয়ার জন্মদিন ও কানাডায় রাজতন্ত্রের আবহের স্বীকৃতিস্বরূপ এই ছুটি। ২০২৩ সালেও পৃথিবীর অন্যতম গণতান্ত্রিক দেশ কানাডা, ইংল্যান্ড এ সব দেশে এখনও রাজা-রাণীর জন্মোৎসব করা হয়, বিষয়টি একদিকে যেমন হতাশাব্যঞ্জক, তেমনি দিকনির্দেশ করে এখনও আমরা সভ্যতার কতটা আদিম যুগে বসবাস করছি। আপনার সপ্তাহটি ভাল কাটুক। 


টরন্টো 
২২ মে ২০২৩

×