ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০২ জুলাই ২০২৫, ১৮ আষাঢ় ১৪৩২

সাংবাদিকতার ভুবনে কবি নজরুল

নাজনীন বেগম

প্রকাশিত: ২১:১৫, ২২ মে ২০২৩

সাংবাদিকতার ভুবনে কবি নজরুল

ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেয়া কবি নজরুল বিশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের উত্তাল স্রোত

ঊনবিংশ শতাব্দীর ক্রান্তিলগ্নে জন্ম নেয়া কবি নজরুল বিশ শতকীয় অবিভক্ত ভারতের উত্তাল স্রোত, রাজনৈতিক উন্মাদনার সঙ্গে ধর্মীয় বিভাজনের যে বিক্ষুব্ধ চিত্র তাকে কেন্দ্র করে নিজেকে তৈরি করেছেন। তিনি প্রতিকূল বলয়ের একজন সৃজন বোদ্ধাও বটে। ঔপনিবেশিক শাসন শোষণে লাঞ্ছিত মানবতার লড়াকু সৈনিকের স্থানটি দখলও করেছেন। শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্তের দুঃসময়ে এমন কণ্টকাকীর্ণ যাত্রাপথ সুস্থির ও নির্বিঘœ ছিল না। এছাড়াও ছিল দীর্ঘ অর্ধশত বছর রাজত্ব করা রবীন্দ্র সৃষ্টিযজ্ঞের এক অপ্রতিরোধ্য জগত। সৃজনশীল দ্যোতনায় নিজস্ব অভিগমনকে অবারিত করতে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে যে দুঃসাহসিক যাত্রা শুরু করলেন, সেটাও যেন এক অবাক বিস্ময়ের পালাক্রম।

আলাদা এবং ব্যতিক্রমী জগত অভ্যুদয়ে কবিগুরুকে বিন্দুমাত্র পাশ কাটাতে হয়নি। বরং জনশ্রুতি আছে রবীন্দ্র বলয়ে নাকি নিজেকে বিলিয়ে দিতে একেবারে দ্বিধাহীন থাকতেন। সমকালীন প-িত, লেখকদের জবানিতে তা প্রকাশও পায়। রবীন্দ্রনাথের একচ্ছত্র আধিপত্যে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন যেন ধরাছোঁয়ার বাইরে এক অমরাবতী। কিন্তু কি অসম সাহসিক শৈল্পিক সত্তায় কবিগুরুকে ছুঁলেনই না, বরং নিজস্ব ক্ষমতা শৌর্যে যা দিয়ে গেলেন বাংলা সাহিত্যকে, তা যেন অন্য এক সৃজন ইমারত। আপন ঐতিহ্যিক ধারায় কৃষ্টি সংস্কৃতিকে ধারণ ও লালন করে সৃষ্টির উন্মাদনায় যা দিলেন সেটা আজ অবধি বাংলা সাহিত্যের নব সৃষ্টির জোয়ার।

সচেতন সৃজন শৈলীতে নিমগ্ন হওয়ার সময় মাত্র বিশ বছর। কিন্তু এত অল্প সময়ে আপামর বাঙালিকে যে সম্পদ উপহার দিলেন তা আজও এক অনন্য সৃষ্টি সম্ভার। দাপটের সঙ্গে সৃজন সৌধকে অবারিত করতে সমকালীন সার্বিক ধারাকে যেভাবে অতিক্রম করলেন তাও এক অসাধারণ সৃষ্টির উন্মাদনা। নিজেকে যথার্থ আসনে বসানোই শুধু নয়, উপস্থিত সময়েরও এক নান্দনিক দ্যোতনা। যা কাল ও যুগের সীমানা অতিক্রম করে অজেয়, অম্লান, দ্যুতিময় জগত আজও সবাইকে উদ্দীপ্ত চেতনায় মাতিয়ে রেখেছে। অতুলনীয় সংগীত সম্ভার উপহার দেওয়া নজরুল বাংলা গানেরও ব্যতিক্রমী ধারার দিকপাল। রাগ-রাগিণীর সুরঝঙ্কারে সংগীতকে যে সর্বোচ্চ মাত্রায় নিয়ে গেলেন, সেখানেও তিনি তুলনাহীন। বাংলা গানের ভা-ারে অজেয় প্রাণপুরুষ তো বটেই কবি, সংগীতজ্ঞ নজরুল প্রকাশ মাধ্যমের আঙিনাকেও যেভাবে ভরিয়ে তোলেন, সেটাও তার অনবদ্য মনন সাধনা। 
শুধু যে অবারিত লেখনি শক্তিতে মহীয়ান ছিলেন তা নয়, গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ও শিরোনাম নির্ধারণেও ছিল পারদর্শিতা। লেখার মর্মে মর্মে বিচ্ছুরিত হতো সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, ব্যথা বেদনার নির্মম ঘটনা। নিজের অপরিসীম দায়বদ্ধতায় লেখা এমন কাহিনী ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়ার ইতিবৃত্ত সবাইকে চমকে দিত। অবিভক্ত বাংলার সংবাদপত্রের শুভ সূচনা এবং বিস্তার উপনিবেশিক শাসনের দুঃসময়ে। তাই সাংবাদিক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা অত সহজ ও স্বাভাবিক ছিল না। ১৮১৮ সালে ‘সমাচার দর্পণ’ পত্রিকার মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলার সংবাদপত্রের শুভ সূচনা।

ব্রিটিশ রাজশক্তির একাধিপত্যে প্রকাশ পাওয়া গণমাধ্যমের সীমাবদ্ধতাও ছিল নানামাত্রিক। রাষ্ট্রীয় কর্ণধার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লেখনি কোনোভাবেই প্রকাশিত হওয়া ছিল এক প্রকার অনিবার্য। সমসাময়িক কাল ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের এক উত্তাল পর্ব। আর নজরুলের সৃজন সাধনা এবং সংবাদপত্র জগতে অনুপ্রবেশ সবই উত্তপ্ত সময়ের বিক্ষুব্ধ আবহে। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও আর্থ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আঙিনায় এক মতদ্বৈতার চরম প্রবাহ। বিদ্রোহী চেতনা ধারণ করা নজরুল সেভাবে কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করতেন না। নির্ভেজাল বাঙালি সংস্কৃতির ধারক হিসেবে যা সৃজন দ্যোতনায় উদ্বেলিত হতো, সেটাই অবলীলায় প্রকাশ করতে থাকতেন অকুণ্ঠ চিত্তে।

এসব কারণে রাজ রোষানলে পড়ায় নজরুলের জীবনকে নিরাপদ এবং স্বস্তিতে থাকতে দেয়নি। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে ওঠা বিদ্রোহী সত্তা কখনো শাসক গোষ্ঠীর রক্তচক্ষুর ভয়ে পেছনে হটার দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যায় না। ফলে সৃজন ও মনন দ্যোতনায় সিদ্ধ এই লড়াকু ব্যক্তিত্ব থেকে সাংবাদিক হিসেবে নিজের স্থান তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগেনি। সমসাময়িক অঙ্গন ছিল মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সম্পাদিত ‘মাসিক সওগাতের’ নবরূপে অভ্যুদয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগ দেওয়া নজরুল করাচিতে বসেই লিখলেন ‘বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী’। এটা কবির সাহিত্যিক আঙিনায় সদর্পে নিজেকে আবিষ্কার করা। ১৯১৯ সালে করাচি থেকে পাঠানো এই গল্প ছাপা হলো মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায়।

বাংলার সাংবাদিকতার জগতে আজও যিনি মাইলফলক, অগ্রগামী নায়ক। নজরুল প্রথমবারের মতো নিজের লেখা পত্রিকায় বের হতে দেখে আনন্দে উজ্জীবিত। বিস্ময়ে অভিভূত কবি নজরুলের প্রথম আত্মপ্রকাশ তাকে এতই বিমুগ্ধ করে যে, তিনি সহযোদ্ধাদের তা পড়ে শোনাতেন বলে জানা যায়। তেমন স্বপ্নাবিষ্ট আবেগে সংবাদপত্রের প্রতি এক ধরনের মনোযোগও এসে যায়। যা পরবর্তীতে নজরুলকে সাংবাদিক হওয়ার প্রেরণায় উদ্বেলিত করে। পরাধীন ভারতের অবিভক্ত বাংলায় কবির সব লেখা পত্রিকায় ছাপার জন্য বিবেচিত না হওয়াও সমকালীন অঙ্গনের অবরুদ্ধতা। তেমনই একটি কবিতা ‘মুক্তি’, যা মাসিক সওগাতে ছাপার অনুমতি পায়নি। বরং অন্য একটি কাগজ ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায়’ ছাপা হয়। এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন বাঙালির আর এক স্বপ্নদ্রষ্টা বহুভাষাবিদ ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ। স্বনামখ্যাত এই প-িত কবি নজরুল আর তার লেখনী সত্তাকে বিবেচনায় আনতে ভুল করেননি। 
১৯১৮ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধের অবসান হলেও ১৯২০ সালেই হাবিলদার নজরুল করাচি থেকে কলকাতায় ফিরলেন। সৈনিক জীবনের যবনিকাপাত। নতুন করে ভেতরের বোধ নবউদ্যম জেগে উঠল। অন্তর্নিহিত চেতনায় সৃষ্টিসুখের উল্লাস যেন বাঁধভাঙা জোয়ারের স্রোতে ভেসে যাওয়ার উপক্রম। সাহিত্যের আঙিনায় নতুন ফসল ফলাতে নিজেকে বিপ্লবী মনস্তত্ত্বে অন্য মাত্রায় ভাবতে বসলেন। ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া বিশ্বযুদ্ধের মাঝপথে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব সারা দুনিয়াকে নবতর এক সমাজ বিনির্মাণের নিশানা দিল। যা এতদিন তাত্ত্বিকভাবে বুদ্ধিজীবী জগতকে নানামাত্রিকে মাতিয়ে যাচ্ছিল।

ধারণা করা হয়, ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বিপ্লব বিদ্রোহী কবির আপন চেতনাসিদ্ধ বলয়ে যেন আছড়ে পড়েছিল। সংগত কারণেই সৃজন আনন্দের অবিমিশ্র ধারায় মিলে মিশে এক হয়ে গেল সংগ্রাম, লড়াই আর বিপ্লবের জয়গান। আর হাবিলদার নজরুলের লড়াকু অভিগমন সেই যাত্রারই নবদ্যুতির নতুন সময়ের আহ্বান। পরিস্থিতির বিভিন্ন চাহিদায় নিজের লেখা শুধু ছাপানোই নয়, আরও বেশি নজর কাড়ে সংবাদপত্রের মহিমান্বিত জগতে নিজের ভাবনা-চিন্তাকে একীভূত করা। যখন যা চাইতেন তাৎক্ষণিকভাবে সেটা করতেও পারতেন উপস্থিত ক্ষমতার নজরুল। আর শৈল্পিক অনুরণন তো প্রচ্ছন্ন ভাবনায় সর্বক্ষণ তাড়িত করত। ১৯২০ সালে করাচি থেকে ফিরে এসেই যুগান্তকারী পদচারণায় সংবাদপত্র জগতে অভিষেক হওয়ার শুভ সূচনা। তেমন মাঙ্গলিক যাত্রায় একই সালের ১২ জুলাই সান্ধ্য ‘দৈনিক নবযুগে’ সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন।

গণমাধ্যম জগতও পেল এক লড়াকু, অবিস্মরণীয় সুদক্ষ নান্দনিক কলম যোদ্ধাকে। নতুন এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন মুজাফ্ফর আহমদ এবং স্বয়ং কাজী নজরুল ইসলাম। মুজাফফর আহমদের ধারণা ছিল, প্রথম দিন থেকেই ‘দৈনিক নবযুগ’ পাঠক তৈরি এবং জনপ্রিয়তায় বেশ এগিয়ে যাবে। অনেকেরই অভিমত, নজরুল নিজেই এই জনপ্রিয়তার নায়ক ছিলেন। শুরু হলো জীবনের অন্য এক ব্যতিক্রমী পর্ব। অসাধারণ মনন শৌর্যে সংবাদপত্রের আঙিনায়ও পড়ল নতুন এক দুঃসাহস আর অফুরন্ত উদ্যম। যা নজরুলের চিরায়ত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে নতুন মাত্রায় সংশ্লিষ্টদের মাতিয়ে দিল। নতুন এক বলয়ে অনভিজ্ঞ নজরুল উৎসারিত শৈল্পিক মাহাত্ম্যকে কেমন যেন অবিমিশ্র করেও দিলেন।

সম্পাদকীয়র দায়িত্বও সুদক্ষ লেখনী শক্তিতে সামলে নিতেন, যা চমৎকৃত করে দিত পাঠক সমাজকে। এমনকি বিদগ্ধ মহলকেও। দীর্ঘ সংবাদকে সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করার অসাধারণ মনন দক্ষতায় নজরুল নতুন এই পেশাকে আলোড়িত করতেও বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এবং মুখরোচক সংবাদের শিরোনামও ছিল আকর্ষণীয় এবং প্রাসঙ্গিক। সময়টা ছিল খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের এক বিক্ষুদ্ধ আবহ। সংবাদের ভেতরের মূল সারবার্তা নিয়ে সেখান থেকে প্রতিনিধি হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতেন খবরের আদ্যোপান্ত। বিস্ময়করভাবে সংবাদ শিরোনামে থাকতো কবিগুরুর বাণী আর শাব্দিক ঝংকার। মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ারই ব্যাপার। নজরুলের বলিষ্ঠ আর দীপ্ত প্রত্যয় ও মনন শৌর্যের অনন্য সক্ষমতায় সংবাদ জগতে নতুন জোয়ার এসেছিল।

সমকালের প-িত ব্যক্তিদের অভিমতে তা জানাও যায়। উজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, গতিশীল শব্দচয়নই শুধু নয়, সংবাদের মর্মবাণীতেও জিইয়ে থাকতো যুগের আবেদন, সময়ের দাবি এবং কালের ঘটনা প্রবাহের এক অনির্বাণ শিখা। যে নবযুগের হাত ধরেই নজরুলের সংবাদপত্র জগতে পথ চলা, সেই অনন্য পত্রিকাও নাকি নজরুলের সৃজন চেতনার অলঙ্কারে সুসজ্জিতভাবে দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠতো। সেটা যেমন সাধারণ মানুষের কাছে একইভাবে জ্ঞানী-গুণী বিদগ্ধ জনের নিকটেও। আমরা জানি সংবাদ মাধ্যমের পাঠক হবেন সবাই। আর সকলের কাছে পৌঁছাতে না পারলে প্রকাশ মাধ্যম তার মর্যাদা হারিয়ে ফেলতে সময় নেয় না।
অন্য একটি বিশেষ বিষয়ও যুক্ত হয়। জননন্দিত ‘নবযুগ’ ঔপনিবেশিক ভারতের ব্রিটিশ শাসনকেও নাড়িয়ে দেয়। নজরুলের চেতনা শক্তি এত প্রবল ছিল যে, শুধু পাঠকপ্রিয়তা নয়, ক্ষমতাসীনদের হতচকিত করে দেয়। শাসক শ্রেণিও নড়ে চড়ে বসে। মুক্ত  আর উচ্চকণ্ঠে সমকালীন ঘটনাপ্রবাহকে যেভাবে উপস্থাপন করতেন তাতে অবিভক্ত উত্তাল বাংলা কেঁপে উঠত। ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী এমনই ক্ষিপ্ত হলো যে, নবযুগকে বাজেয়াপ্ত করতে নির্দেশও দেওয়া হলো। পরবর্তীতে দুই হাজার টাকা জরিমানা নিয়ে নবযুগ তার নিজের জায়গা পুনরায় ফিরে পেল। তবে এবার নজরুলকে আর যুক্ত করা সম্ভব হয়নি। স্বাধীনচেতা আর আত্মপ্রত্যয়ী নজরুলের ব্যক্তিত্ব বোধ এতই প্রখর ছিল যে, সামান্য আঁচড় লাগাও সেখানে অসম্ভব ছিল।
১৯২২ সালে ‘দৈনিক সেবক’ পত্রিকায় কবির দ্বিতীয়বার অভিগমন। গণমাধ্যমের বলয়ে পুনরায় নিজেকে যুক্ত করা। উপমহাদেশের সাংবাদিকতার ইতিহাসে আর এক প্রাণপুরুষ মাওলানা আকরম খাঁনের পত্রিকা ছিল ‘সেবক’। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের উত্তেজক অধ্যায় সমকালীন অঙ্গনে যে উত্তাপ ছড়ায় তাও সে সময়ের এক বিক্ষুব্ধ আবহ। চলমান আর্থ সামাজিক আর রাজনৈতিক অস্থিরতার দুঃসময়ে ‘দৈনিক সেবক’ এর ভূমিকা ছিল লড়াকু আন্দোলনের অনুষঙ্গ। জননন্দিত হওয়ার সমস্ত সুযোগ এই সেবকের হাতের নাগালেই ছিল। ফল হলো এইভাবে জনগণের বিশ্বস্ত সেবক রাজদ্রোহের মতো বিপাকে পড়াও ছিল এক প্রকার অবিচ্ছিন্নতা।

বিভিন্ন আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলে সেবকও তার আগের জায়গা আর ধরে রাখতে পারেনি। ইতোমধ্যে মওলানা আকরম খাঁকেও কারাগারে আটক করে রাখে ঔপনিবেশিক শাসকবর্গ। বিপ্লবী চেতনায় উদ্দীপ্ত নজরুলকে সেবকের দায়ভার নিতে হয়েছিল উপস্থিত সময়কে সামলাতে। মনুষ্যত্বের অতন্দ্র প্রহরী নজরুল অনুক্ষণ মানবতার জয়গান গেয়ে গেছেন। সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প কিংবা মৌলবাদ তাঁকে কখনো গ্রাস করতে পারেনি। তবে ‘সেবক’ সাম্প্রদায়িকতার কোপানলে পড়ার দুঃসময়ে কবির সঙ্গে মতদ্বৈধতা তৈরি হতেও দেরি হয়নি। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার হারানোর সঙ্গে সঙ্গে সেবকের সঙ্গে কবির  চিরবিচ্ছেদ ঘটে যায়। 
পরবর্তীতে দৈনিক মোহাম্মদী পত্রিকায় নজরুল ব্যঙ্গ রসাত্মক কলাম লিখতে শুরু করেন। সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন এই পত্রিকার সঙ্গে। নজরুলের হাসির ব্যঙ্গ রসাত্মক অঙ্গনও এক সময় মৌলবাদে আক্রান্ত  হলো। অতঃপর এই পত্রিকাটির সঙ্গেও ইতি ঘটে। 
মুজাফ্ফর আহমদ আর নজরুল মিলে ‘ধূমকেতু’ নামে নতুন এক পত্রিকার গোড়াপত্তন করলেন। ততদিনে নজরুলের বিদ্রোহী সত্তার পরিপক্বতাই নয়, বরং সমসংখ্যক নারীর প্রতি তৈরি হলো সচেতন দায়বদ্ধতা। অর্ধাংশ নারীকে যথার্থ মর্যাদা দিয়ে ধূমকেতুতে খোলা হলো নারী পাতাÑ ‘সান্ধ্য প্রদীপ’ নামে। এখানে নরীরাই লেখক আলোচকই শুধু নন, সমালোচকও বটে। সর্বমানুষের কাছে এর গ্রহণযোগ্যতা এত ব্যাপক ছিল যে, জনপ্রিয়তায় একেবারে শীর্ষস্থানে চলে যায়। সারা বাংলা তোলপাড় করা পত্রিকাটি রাজরোষানলে পড়তেও দেরি হয়নি। সচেতন রাজনৈতিক বক্তব্য এবং সর্বমানুষের জয়গানে মুখরিত পত্রিকাটি ব্রিটিশ শাসকের মসনদ কাঁপিয়ে দেয়।

ফলে নজরুলকেই কারাবন্দি করে আটকে রাখা হয় জেলে। ‘ধূমকেতু’র সঙ্গেও বিরহের পালা শুরু হয়ে যায়। সৃজন চেতনায় উদ্দীপ্ত নজরুলের মননশক্তিরও অনবদ্য আবেদন প্রকাশ পায় সংবাদপত্র জগতে। যদিও সময় খুব সামান্য। নজরুলের সাহিত্য জীবনই তো মাত্র ২০ বছরের। সংগীতের ভুবন আরও কমÑদশ বছর। নজরুলের মতো অসাধারণ সৃজনসত্তার কাছে সময় যে কোনো বিষয় নয়, সেটার প্রমাণও রেখে যান তিনি। সৃষ্টিশীল জীবন বহতা নদীর মতো ধাবমান হলেও সেরা সময় আসলে খুব কমই থাকে। নজরুলের বেলায় তা আরও বেশি কম ছিল। তবে সাহিত্য আর সংগীতের বলয়কে যা তিনি দিয়ে গেছেন তার দাম আজও অনন্য সাধারণ।
 
লেখক : সাংবাদিক

×