ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১

আকাশছোঁয়া দূরত্ব

শিউলী আহমেদ

প্রকাশিত: ২১:০৭, ২১ মার্চ ২০২৩

আকাশছোঁয়া দূরত্ব

আতিকউল্লাহ খান মাসুদ

প্রকৃতিতে আবার চলছে ঝরাপাতার দিন। শুধু ডালপালাগুলো ডানা মেলে আছে। কোথাও আবার সবুজ কচি পাতায় ছেয়ে গেছে। ঝিরিঝিরি বাতাসে তিরতির করে নড়ছে পাতাগুলো, যেন খুশির দোলায় দুলছে। সেদিনও এমনই দিন ছিল। ২০ মার্চ, ২০২১  রমনাজুড়ে শুকনো পাতার মর্মর ধ্বনি তুলে হেঁটেছি, আর কচি সবুজ পাতাদের খিলিখিলি হাসি দেখে পুলকিত হয়েছি। ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি একদিন পরেই আমাদের বটবৃক্ষও এভাবে ঝরে যাবে। সেখানে আর সবুজ পাতা হবে না।

আমাদের স্যার- দৈনিক জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠাতা, সম্পাদক, বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদ বীরের মতোই আমাদের ফাঁকি দিয়ে ২২ মার্চ, ২০২১ সালের শেষ রাতে বিদায় নিয়েছেন। সেদিন ছিল সোমবার। আগের দিনও রাত ৮টা পর্যন্ত অফিস করেছেন। কে জানত, এই যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া!
আজও কেউ মেনে নিতে পারিনি তাঁর এই হঠাৎ না বলে চলে যাওয়া। হয়ত তাঁর মন সে কথা বুঝে গিয়েছিল। তাই শেষদিন আমার সঙ্গে কথা বলে গিয়েছিলেন, খুব শান্ত কণ্ঠে। আমি তখন জনকণ্ঠের টেলিফোন বিভাগে কাজ করি। একটা ফোনকল স্যারকে পাস করেছিলাম। প্রায় একই রকম দুটো নামের কারণে নাম বিভ্রাট হয়েছিল। আমি বলেছিলাম একটা। স্যার বুঝেছিলেন আরেকটা। ফোনটা রেখেই তিনি বিভ্রাটের কথা আমাকে শেয়ার করলেন, ‘আরে ও তো ওমুক ছিল।

আমি তো ভেবেছি অন্যজন।’ বললাম- জি স্যার, আমি তো ঐ নামই বলেছি। - ‘তুমি তো ঠিকই বলছ। দুটা নাম একই রকম না? আমি মনে করছি ঐটা। আচ্ছা রাখো’। খুব সাধারণ একটা বিষয়। আমার সঙ্গে শেয়ার না করলেও পারতেন। এই বিষয়টা আমার কাছে তাঁকে আজও অসাধারণ করে রেখেছে। আজও কানে বাজে তাঁর দরাজ কণ্ঠে বলা এমন ছোট ছোট অনেক কথা। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কেউ যখন তাঁর উক্তিগুলো তুলে ধরেন আমার কানে তখন ঝনঝন করে সেই কণ্ঠস্বর বেজে ওঠে। যেন পাশেই কথা বলছেন। এক সময় তাকিয়ে খুঁজতাম। এখন চোখ বন্ধ করে অনুভব করি।
এবারের ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার সিলেটের সালাম ভাই জনকণ্ঠের প্রতিষ্ঠালগ্নের কিছু ঘটনার কথা স্মৃতিচারণ করেছেন। সেখানে তিনি স্যারের বলা একটি উক্তি লিখেছেন, ‘এই সালাম, তুমি টেলিফোনের কাগজ পাইছো?’- লেখাটা পড়ে আঁতকে উঠলাম! মনে হলো স্যার আমার পাশেই কোথাও বসে কথাটা বললেন। পরক্ষণেই মনে হলো- মিছেই অনুভূতি। চোখ ভিজে গেল। আহা! কতদিন শুনি না এই কণ্ঠস্বর। একরাশ হাহাকারে ভরে গেল বুকের  ভেতরটা। এত বড় একটা  লেখা কখন যে পড়ে শেষ করে ফেললাম টেরই পাইনি। পাতা উল্টে খুঁজছিলাম আর লেখা কোথায়!
এবার আপনাকে নিয়ে কারও লেখা পড়িনি। নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না, তাই। আপনার কথা বলতে গেলেই চোখ দিয়ে পানি পড়তে থাকে। তবে পত্রিকাগুলো হাতের কাছেই রেখেছি। আমার কোথায় স্মৃতির ঝুড়ি! সবাই আপনাকে পেয়েছে ২৮ বছর! আর আমি তো পেয়েছি মাত্র ৮ বছর। তাও এমন না যে, সব সময় দেখা হতো, কথা হতো। এই ৮ বছরে খুব সামান্য সময়ই আপনার সান্নিধ্য পেয়েছি। শুধুই ফোনে ২/১টা কথা। কিন্তু এই সামান্য সময়ে যেটুকু পেয়েছি সেটাই আমার কাছে স্মৃতির পাহাড় হয়ে গেছে।

আর সেই স্মৃতির টুকরোগুলো আরও বিশালাকার হয়েছে ওবায়েদ স্যার, কাওসার স্যার, মোয়াজ্জেম ভাই, মোরসালিন ভাই, সমুদ্র ভাইসহ দেশ-বিদেশ থেকে আরও অনেকের স্মৃতিচারণমূলক লেখাগুলো পড়ে। আপনার দৃঢ় সিদ্ধান্তে যারা বিস্মিত হয়েছেন, কথার জাদুতে মুগ্ধ হয়েছেন, তাঁরা অনেক সৌভাগ্যবান। তাঁদের স্মৃতিচারণ পড়ে পড়ে আমার ঝুলিতে জমে থাকা আপনাকে নিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্মৃতিগুলো আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। ওবায়েদ স্যার আর কাওসার স্যারের আপনাকে নিয়ে প্রথম লেখাগুলো পড়ে আমি খুব আবেগাপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। পড়া শেষ করে তাঁদের ফোন দিয়ে আর কথাই বলতে পারছিলাম না।
সব সময় একটা ধারণা ছিল বসেরা খুব রাগী হয়। এখানে এসে সিনিয়রদেরও দেখেছি আপনাকে কিছু বলতে সংকোচ করত, ভয় পেত- পাছে আপনি রাগ হয়ে যান। কখনো কোনো বিষয় নিয়ে রাগ যে হননি তা না। সেই প্রথমদিকের কথা। একবার ফোনে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে আপনার আসার কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। তাই যথাযথ জায়গায় খবর জানাতে পারিনি। আপনি রাগ হয়ে রুমে চলে এসেছিলেন। আমার সিনিয়র ভাইয়া বলেছিলেন কিছু না বলে যেন চুপ থাকি। কিন্তু আমি কারণটা বলেছিলাম। আর আপনি বুঝতেও পেরেছিলেন। তাই আমাকে আর বকা দেননি।

সেইদিন প্রথম আপনাকে দেখেছি, আর মুগ্ধ হয়েছি আপনার এই মহানুভবতায়। ভাবছিলাম অন্য কোনো বস হলে এক্ষুণি চাকরিটা চলে যেত। আপনার প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মানবোধটা তখন থেকেই আরও বেড়েছে। তখন থেকেই দেখেছি অফিসের প্রতিটা বিষয় আপনি খুব ভালো খেয়াল রাখেন। তাই যতই রাগ হন সঠিক বিষয়টা শুনে শান্ত হয়ে যান। আর বকা দেওয়ার জন্য পরক্ষণেই আহ্লাদ করে, আদর করে কিছু বলতেন। কখনো কোনো ভুলের কারণে বকা দিলেও একটু পর প্রয়োজন থাকুক আর না-ই থাকুক ফোন করে মজা করে, ভেংচি কেটে কিছু বলে মন ভালো করে দিতেন।

দরকারি কোনো কাজের জন্য ফোন দিলেও এত্ত নরম করে আদরভরে কথা বলতেন, যেন বলছেন- ‘অনেক কঠিন করে বকা দিয়েছি। মনটা খারাপ হয়ে গেছে, তাই না?’ ঠিক একজন বাবা যেমন সন্তানকে শাসন করার পর আবার আদর করে দেন। এটা শুধু আমার কথা না, প্রত্যেকেই এই কথা বলেছেন। এখানেই আপনার মহত্ত্ব। এজন্যই আপনি সবার থেকে আলাদা। আমি আপনার এসব ছোট ছোট বিষয় খুব অনুভব করতাম। এখান থেকেই আদর, স্নেহ, ভালোবাসা কুড়িয়ে নিতাম।

এখন আমি সম্পাদনা বিভাগে কাজ করছি। এখানে আসার প্রথমদিকে মন খুব অশান্ত ছিল। মনে মনে চোখ বুলিয়ে আপনার উপস্থিতি খুঁজতাম। আপনি কোথায় এসে দাঁড়াতেন, কোথায় বসে কথা বলতেন বোঝার চেষ্টা করতাম। আস্তে আস্তে শান্ত হয়ে এখানে আমি একটি ছোট্ট প্রজাপতি হয়ে গেছি। একটা একটা করে দিন, মাস, বছর চলে যাচ্ছে। আর আপনার আদর, ভালোবাসায় ভরপুর শাসনগুলো থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। একটা সময় এই দূরত্ব আকাশ ছুঁয়ে যাবে। শূন্যতা আরও বেড়ে যাবে। আমি তাই এখন চুপ হয়ে গেছি। শুধু অনুভব করি খুব নীরবে।

কখনো নিজেকে সামলাতে পারি, কখনো পারি না। তারাভরা বিশাল আকাশ! ওখানে সবচেয়ে উজ্জ্বল যে তারাটা সেটা আপনি। এক কোণে চুপটি করে বসে সেই তারাটির দিকে তাকিয়ে কত কথা বলি আমি আপনার  সঙ্গে! সবাই বলে ওপারে চলে যাওয়া মানুষদের স্বপ্নে দেখা ভালো না। কিন্তু আমি দেখতে চাই, স্বপ্নের মাধ্যমেই তাঁদের কাছে থাকতে চাই। কিন্তু স্বপ্নগুলো যেন সুন্দর হয়, হাসিখুশি হয়!
লেখক : সাংবাদিক

×