ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বদলে যাওয়া সময় এবং নারীর পোশাক

মিলু শামস

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ২১ মার্চ ২০২৩

বদলে যাওয়া সময় এবং নারীর পোশাক

একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথিদের প্রায় অর্ধেক নারী এবং তাঁদের অর্ধেকেরও বেশির মুখ হিজাবে ঢাকা

একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অতিথিদের প্রায় অর্ধেক নারী এবং তাঁদের অর্ধেকেরও বেশির মুখ হিজাবে ঢাকা। অনেকে এগিয়ে এসে কুশল জানতে চাইলেন। যাদের আগে থেকে বোরকা পরতে দেখেছি তাঁদের চিনলেও অন্য অনেককে চেনা যাচ্ছে না। কারণ এরা আগে হিজাব পরতেন না। তা ছাড়া আগের দিনের বোরকায় মুখের পুরো অংশ খোলা থাকত। কপালের ওপর থেকে আলগা পর্দার মতো ছিল। যাঁরা মুখ ঢেকে রাখতে চাইতেন পর্দাটা তাঁরা মুখের ওপর নামিয়ে রাখতেন, কথা বলার সময় তা মাথার ওপর তুলে কথা বলতেন। তাঁদের মুখের পুরো অংশ দেখা যেত।

এখন বোরকার ধরন বদলেছে। চোখ ছাড়া মুখের অন্য অংশ শক্ত করে বাঁধা থাকে। নিতান্ত কাছের কেউ না হলে শুধু চোখ দেখে চেনা সম্ভব নয়। অনেক দিন পর দেখা হলে তো নয়ই। চোখও সব সময় উন্মুক্ত থাকে না। সানগ্লাস অথবা চশমায় ঢাকা থাকে। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা খোঁপায় ফুল কপালে টিপ আর আঁচল দুলিয়ে শাড়ি পরতেন তাঁদের অনেকেই সালোয়ার কামিজের ওপর শক্ত করে মুখ ঢাকা বোরকা পরে এসেছেন। যেসব মা-খালা আগে শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে পর্দা বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন তাঁদেরও অনেকে শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার কামিজ পরেছেন, ঘোমটা ছেড়ে বোরকা ধরেছেন। 
মাত্র দু’-আড়াই দশকে এ দেশের বাঙালি নারীর পোশাকে এ ধরনের পরিবর্তন চোখে পড়ার মতো। শাড়ির মতো অনবদ্য পোশাকের জায়গা দখল করে নিচ্ছে সালোয়ার কামিজ। সাধারণভাবে তাতে আপত্তির কিছু নেই। কেউ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করলে পরতেই পারেন। জিন্স টপসেও নারীরা এখন দারুণ স্মার্ট। নারীদের ঘরের বাইরে কাজ করার হার এবং পরিসর আগের চেয়ে বেড়েছে। কাজের জায়গায় যাওয়ার ধকল, যানবাহনের ভিড় ইত্যাদি সামলাতে শাড়ির চেয়ে সালোয়ার-কামিজ, জিন্স-টপস বেশি ব্যবহার সহায়ক।

যাঁরা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে ঘরে-বাইরে সালোয়ার-কামিজ পরায় অভ্যস্ত শাড়ি তাদের প্রিয় পোশাক হলেও অভ্যাসের কারণেই সালোয়ার কামিজে তারা বেশি স্বচ্ছন্দ।  যে কোনো উৎসবে, পার্টিতে শখের শাড়িটি পরেন। নিয়মিত শাড়ি পরতে না পারার জন্য গোপন দুঃখবোধও আছে। আবার বাস্তবতা না মেনেও পারেন না। কিন্তু কৈশোর পেরিয়ে যাঁরা শাড়ি পরে আসছেন হঠাৎ করে তাঁরা যখন সালোয়ার-কামিজ পরতে শুরু করেন তখন সন্দেহ জাগে। সন্দেহ দৃঢ় হয় সালোয়ার-কামিজের সঙ্গে হিজাব দেখলে। বিয়েতে আসা রওনক আরা খালা এ রকম একজন।

পরিচয় না দিলে সারাদিন পাশে বসে থাকলেও তাঁকে চেনা সম্ভব হতো না। চমৎকার করে শাড়ি পরতেন। টেনে কাজল আঁকতেন চোখে। হাল ফ্যাশনের গয়না-জুতা-ব্যাগে দারুণ স্মার্ট ছিলেন রওনক আরা খালা। আত্মীয় পরিচিতদের অনেকের ফ্যাশন আইকন ছিলেন তিনি। সেই রওনক আরা খালা এখন পরেন সালোয়ার-কামিজ। ওপরে মুখ বাঁধা বোরকা। কৌতূহল সামলানো সম্ভব হলো না। ভিড়ের মধ্যে এককোণে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম খালা, 
এই ভোল বদলের কারণ কি? সাংঘাতিক মাইন্ড করলেন তিনি। ‘ভোল বদলানো? মানে কি? কি বলতে চাস?’ আমতা আমতা করে বললাম, ‘না মানে এসব পরেছ, আগে তো কখনো...।’ কথা শেষ করতে না দিয়ে তেড়ে উঠলেন- ‘আগে পরিনি মস্ত পাপ হয়েছে, পাপের বোঝা আর বাড়াতে চাই না।’ তার কথার মাথামু- কিছু বুঝলাম না। আগে সালোয়ার-কামিজ না পরে শাড়ি পরতেন তার সঙ্গে পাপ-পুণ্যের সম্পর্ক কি? বুঝলাম খালার বিস্তারিত বয়ানে। তার কথার সারমর্ম হলো, ‘শাড়ি হিন্দুয়ানি পোশাক।

সেলাইবিহীন এ পোশাকে শরীরের নিচের অংশ খোলা থাকে। এতে মাটি লজ্জা পায়, ফেরেশতারা বিব্রত হন। সালোয়ার-কামিজ সেলাই করা শ্লীল পোশাক। সালোয়ারে পায়ের গোড়ালি থেকে কোমর পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকে। শরীরের উপরের অংশও পুরো ঢাকা থাকে। ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে থাকার সুযোগ নেই। আকাশ-মাটি কারও লজ্জা পাবার অবকাশ নেই।’ আগে শাড়ি পরতেন সে জন্য খালা এখন ভীষণ অনুতপ্ত বারবার বললেন সে কথা। আরও বললেন, ‘ওসব নাফরমানি পোশাক ছাড়, ধর্মীয় আদব কায়দায় চল।’ 
তার প্রতিটি কথা পরিষ্কার বোধগম্য হলো। এই তা হলে সালোয়ার-কামিজ পরার মাহাত্ম্য! হিন্দুয়ানি পোশাক ছেড়ে ইসলামী পোশাক পরা! মনে পড়ল খালার মতো অনেককে দেখেছি, যাঁদের এক সময়ের শখের সিল্ক, জামদানি, কাতান শাড়িগুলো আলমারিতে অবহেলায় পচছে। তারা ওদিকে ফিরেও তাকাচ্ছেন না। সেখানে ঠাঁই করে নিচ্ছে চওড়া ওড়নাওয়ালা থ্রিপিস। আজকাল বাজারে প্রচুর পাওয়া যাচ্ছে এগুলো। ভাবলাম আমাদের নানি-দাদি বা মাতৃস্থানীয়রা ধর্মকর্মে যথেষ্ট মনোযোগী ছিলেন।

কিন্তু পোশাক নিয়ে তাঁদের তেমন মাথাব্যথা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। ঘরের বাইরে গেলে ঢিলেঢালা বোরকা চাপাতেন যেন নিয়ম রক্ষা করতেই। তাতে হাতের আঙুল দেখা গেল কি পায়ের গোড়ালি তা নিয়ে তারা পারলৌকিক দুর্ভাবনায় ভুগতেন না। এখন এই সালোয়ার-কামিজ, হিজাব-বোরকা পরার যেন হিড়িক পড়েছে। নিজেকে আড়াল করতে করতে প্রায় অদৃশ্য করে ফেলছেন। 
তবে কি এরা বেশি ধর্মপরায়ণ হয়ে উঠেছেন? আগের দিনের নারীরা কম ধর্মপরায়ণ ছিলেন?

নাকি ধর্মের প্রতি আনুগত্যকে সহজে ধর্মতন্ত্রের দিকে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্য কূটচাল ধর্মের নামে প্রথমেই কুপোকাত করা হয় নারীকে। এক প্রবীণ শুভানুধ্যায়ী বলেছিলেন, ‘ধর্ম আর ধর্মতন্ত্র এক নয়। মানুষ হিসেবে প্রত্যেক মানুষেরই ধর্ম আছে কিন্তু ধর্মতন্ত্র অন্য জিনিস। এর পেছনে উদ্দেশ্য থাকে।’ ভয় হয় তিনি যে উদ্দেশ্যের কথা বলেছিলেন রওনক আরা খালারা সে উদ্দেশ্যের শিকার নন তো?
একদিকে হিজাবের আড়ালে লুকিয়ে ফেলা, অন্যদিকে প্রযুক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে নারীর নগ্নতাকে হাতে হাতে পৌঁছে দেওয়া, এই আপাত বৈপরীত্যে আজকের সমাজে নারীর এক অদ্ভুত ইমেজ তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরে সাইবার ক্রাইম ছড়িয়েছে ভাইরাসের মতো। এর শিকার হয়ে এ পর্যন্ত বহু কিশোরী আত্মহত্যা করেছে। যার ধারাবাহিকতায় একটি সংযোজন ছিল দশম শ্রেণির এক ছাত্রী। সে খবরের কাগজের শিরোনাম হয়েছিল এভাবে-
কয়েক সহপাঠীর মোবাইল ফোনে তোলা আপত্তিকর ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ায় বিরূপ এক পরিস্থিতি ও মানসিক চাপে ছিল মেয়েটি। বিদ্যালয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ হয়েছিল। প্রতিকূলতা কাটিয়ে ওঠার আগেই সাংবাদিক পরিচয়ে দুই ব্যক্তি যখন বাড়ি এসে বাবার কাছে তার ওই আপত্তিকর ছবিসহ সংবাদ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে প্রকাশের হুমকি দেয়, তখন মেয়েটির সব ধৈর্য আর ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ধস নামে।

শেষ পর্যন্ত নিজের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে স্যাভলন পান করে আত্মহত্যা করে। আত্মহত্যার আগে বান্ধবীকে সে বলেছিল- ‘ঘটনার জন্য দায়ী ছেলেদের বাড়ি সাংবাদিক যায় না, আমার বাড়িতে সাংবাদিক আসে। আমি কোথাও বের হতে পারি না। বাড়ির মধ্যেও অনেক কথা শুনতে হয়। আমি আর পারছি না। আমার মনে হয় মরে যাওয়াই ভালো’ প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধ ঘটনার জন্য মেয়েদেরই দায়ী করে। সব ধিক্কারের আঙুল তার দিকেই উদ্যত। 
বুঝে হোক কিংবা না বুঝে, মেয়েটি যে কাজ করে ফেলেছে একটি জীবনের সম্ভাবনার কাছে তা তুচ্ছ, এই প্রয়োজনীয় কাউন্সেলিং সে আপনজনদের কাছ থেকে পায়নি। বাস্তব পরিস্থিতি যত দুরূহই হোক তা থেকে বাঁচতে মরে যাওয়ার মতো ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত কিছুতেই নেওয়া যায় না। এই একটি ঘটনা জীবনের অন্য সব সম্ভাবনাকে শেষ করে দিতে পারে না। জীবনের গতি বিচিত্র ও বহুমুখী। অনেক কিছু করার ছিল তার।

এ কথা বোঝানোর মতো কেউ বোধহয় ছিল না তার আশপাশে। থাকে না আমাদের দেশের মেয়েদের জন্য। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর সময় হয়েছে। সহজ সরল অবোধ বিশেষণের ঘেরাটোপ ভেঙে বেরোতে হবে। জটিল সমাজে সারল্যের তকমা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দেয়। সমাজের আমূল পরিবর্তনের সম্ভাবনা যেখানে ক্ষীণ সেখানে বিদ্যমান বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার বিকল্প নেই। তবে তা অবশ্যই নিজের স্বাতন্ত্র্য ও ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে। পরিবারের ভূমিকা এখানে অনেক বেশি।

ছোটবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে মা-বাবাকে। কোন ঘটনায় কতটুকু প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে সেই ব্যারোমিটার সন্তানদের আত্মস্থ করানো দরকার এ জন্য যে, বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বাড়ছে। নিজেকে নিজেরই রক্ষা করতে হবে। রাষ্ট্র সাহায্যের হাত বাড়াতে অক্ষম। সমাজ  বৈরী সুতরাং নিজেদের দায়িত্ব অনেক বেশি।
যে সমাজে মানুষের মূল্য মানুষ হিসেবে নয়, নির্দিষ্ট ইমেজের ভিত্তিতে হয় সে সমাজে যে কোনো মানুষের জীবন পরিস্থিতির চাপে ভালনারেবল হয়ে পড়ে। নারীর বেলায় পরিস্থিতির চাপ অন্য যে কোনো মানুষের তুলনায় অনেক বেশি। 
একদিকে নানা ধরনের সৌন্দর্য সম্মোহনে আবিষ্ট করা অন্যদিকে হিজাবের দিকে ঠেলে দেওয়া এ দুই-ই পুঁজিবাদী দুনিয়ার চালাকি। এ বাস্তব পরিস্থিতি বোঝার শিক্ষা দীক্ষা নিয়েই জীবনের পথে এগোতে হবে।

×