
.
প্রেম একটি সর্বজনীন অভিজ্ঞতা। কখনো নিজের সঙ্গে, কখনো আরেকজনের সঙ্গে; কখনো পরিবেশের সঙ্গে, কখনো একটি বস্তুর সঙ্গে; কখনো একটি স্পিরিটের সঙ্গে, কখনো ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে। ভালোবাসা আমাদের, আমাদের ভেতরের সত্তাকে, চারপাশের সঙ্গে সংযুক্ত করে রাখে। হোক সেটি বস্তু, হোক সেটি অনুভব, হোক সেটি অন্য কিছু।
ভালোবাসা আমাদের জীবনে আনন্দ এবং সুখের অন্যতম একটি উৎস। ভালো থাকার একটি উদ্দেশ্যকে সঙ্গে নিয়ে অনুভব সৃষ্টির ক্ষমতা রাখে এই ভালোবাসা। ভ্যালেন্টাইন্স ডে হলো আমাদের সেই ভালোবাসার অনুভবকে স্বীকার করে নেওয়া, স্বীকৃতি দেওয়া। এটির উদ্যাপন আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনে ভালোবাসার কতটুকু প্রয়োজন।
একদিনে Valentine’s Day চালু হয়নি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর উৎপত্তি এবং রীতিনীতির বিকাশ ঘটেছে, বিবর্তিত হয়েছে। আবার একেক সংস্কৃতি এবং দেশীয় পরিবেশে এটি উদ্যাপনের কিছু পার্থক্য চোখে পড়ে। ভালোবাসাকে অনুভবের শিকড় থেকে যে যাত্রা শুরু, সেটি কেবল অনুভবে না থেকে, কোথাও কোথাও বাণিজ্যিক রূপও ধারণ করেছে আধুনিক সময়।
Valentine’s Day এর উৎপত্তি প্রাচীন রোমে। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে লুপারক্যেলিয়া নামে একটি উৎসব হতো রোমে। ওই উৎসবের সময় রোমের যুবকরা একটি কাঁচের বৈয়ামে তাদের প্রিয় মানুষের নাম লিখে সেই মানুষটিকে উপহার দিত। এই সময় তারা সেই মানুষটির সঙ্গে কিছু বিশেষ সময় কাটাত, আরও কিছু উপহার দিত, এমনকি কখনো কখনো শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে যেত। রোমের পাড়ায় পাড়ায় বছর ঘুরে লুপারক্যেলিয়া উৎসবের সময় হয়ে এলে যুবক এবং যুবতীদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। পরবর্তীতে খ্রিস্টান ধর্ম যখন ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল, চার্চগুলো এই পৌত্তলিক উৎসবটিকে খ্রিস্টান উৎসবের সঙ্গে যুক্ত করে সামাজিক উৎসব থেকে একটি ধর্মীয় উৎসবে স্বীকৃতি দিল। বিশেষ করে ১৪ ফেব্রুয়ারি একটি নির্দিষ্ট দিনকে ধার্য করল উৎসবটি উদ্যাপনে।
খ্রিস্টান ধর্ম বিয়ে প্রথাটিকে খুব একটা উৎসাহ দিত না। এমনকি কোনো একটি সময় রোমে বিয়ে প্রথা নিষিদ্ধ করেছিল। সেন্ট ভ্যালেন্টাইন নামক একজন যাজক এটার বিরুদ্ধে ছিলেন এবং তিনি যুবক-যুবতী কিংবা দম্পতিদের ভালোবাসতে এবং বিয়ে করতে উৎসাহ প্রদান করতেন। এমনকি তিনি তাদের গোপনে বিয়ে দিয়ে দিতেন। বলা হয় যে, সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই কাজের কারণে খ্রিস্টান ধর্মের অন্য যাজকরা মিলে তাকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিল। কিন্তু ওই সময় তাকে মেরে বিয়ে কিংবা ভালোবাসা সম্পর্কটিকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করলেও মানুষের মনের মধ্যে ঠিকই সেটির প্রতি আগ্রহ থেকে গিয়েছিল। পরবর্তীতে ক্রিস্টান ধর্ম এবং সামাজিকভাবে বিয়ে প্রথাটি একটি সামাজিক এবং ধর্মীয় স্বীকৃতির বলয় চলে এলে সেন্ট ভ্যালেন্টিনের মতো একজন এমন সাধু সন্ন্যাসীর ভালোবাসা ও বিয়েকে পৃষ্ঠপোষকতার যে নজির রেখেছিলেন, তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে ১৪ ফেব্রুয়ারি হয়ে উঠল ভালোবাসাকে স্মরণ করা এবং ভালোবাসার এক মহান দিবস।
মধ্য শতকে ভ্যালেন্টাইন্স ডে তেমন একটা ব্যাপকভাবে পালিত হয়নি বলে ইতিহাসে দেখা যায়। তবে ১৬ এবং ১৭ শতাব্দীর দিকে এটি ক্রমশ জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ওই সময় তরুণ তরুণীদের মধ্যে চকোলেট এবং ফুলের সঙ্গে প্রেমপত্র কিংবা অন্য কোনো উপহার পাঠানোর একটি প্রচলন শুরু হয় ১৪ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে। আবার ইতিহাসে এও দেখা যায় ভ্যালেন্টাইন ডে উপলক্ষে কার্ড পাঠানোর রীতি শুরু হয় ১৫ শতকের শেষের দিকে। ১৭ শতকের শেষে এসে ১৮ এবং ১৯ শতকের দিকে পুরোপুরিভাবেই উপহার এবং উৎসব হিসেবে Valentine’s Day আরও বাণিজ্যিক হয়ে ওঠে। ১৮ শতকের প্রথমদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ভ্যালেন্টাইন ডে কার্ড মুদ্রিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকাতেও এই দিনটি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
আজ Valentine’s Day সারা বিশ্বে পালিত হয়। শুধু যে তরুণ তরুণীর মাঝেই এটি সীমাবদ্ধ, এমন নয়। দম্পতি থেকে শুরু করে বয়সী অনেকেই এখন দিনটিকে তাদের সম্পর্কের একটি প্রতীক হিসেবে উদ্যাপন করে। চকোলেট, ফুল, কার্ড থেকে শুরু করে পোশাক, অরনামেন্টস এমন সব উপহার বিড়ি থেকে শুরু করে বর্তমানে এসে এটা দাঁড়িয়েছে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’তে ফুল আর ডিজিটাল প্রেমের বার্তা প্রেরণ। সঙ্গে আছে বিশেষ দিনটি উপলক্ষে কোথাও বন্ধুরা এক হওয়া, মেলা, রেস্তোরাঁয় খাওয়া-দাওয়া। আর এসব কারণে প্রতীকটি ভালোবাসা হলেও কাজগুলো হয়ে উঠেছে বাণিজ্যিক। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান তাদের আয় বৃদ্ধিতেও সুযোগটি কাজে লাগাতে হাতছাড়া করেনি।
ভালোবাসা একটি রোমান্টিক সম্পর্ক। ভালোবাসা দিবস কেবল এই সম্পর্কটিকে স্বীকৃতি দেওয়া নয়। বরং ভালোবাসা দিবস হলো এই দিনটিতে সে বিশেষ মানুষটিকে এটাই স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে- তাদের প্রতি আমরা কতটা যত্নশীল এবং এই যত্নটি কেবল সেই দিনের জন্য নয়, সেটি বছরজুড়ে যে সময়টুকুই আমাদের সামনে আসে, সেই সময়ের জন্য। এবং সব সময়। কারণ ভালোবাসার অনুভূতির চেয়ে এত সুন্দর অনুভূতি আমাদের চিন্তা চেতনাকে আচ্ছন্ন করে, এমনটা আর নেই। সুতরাং ভালোবাসুন, প্রিয় মানুষটিকে ভালোবাসার কথা বলুন, সামর্থ্যরে মধ্যে প্রিয় মানুষটির জন্য এই দিবসে কিছু একটা করুন।
ভালোবাসা দিবস উদ্যাপনের বিশ্বব্যাপী ইতিহাস ৪০০ থেকে ৫০০ বছরের পুরনো হলেও বাংলাদেশে এটির প্রচলন এবং জনপ্রিয় হয়ে ওঠার বয়স ৩০-৩৫ বছরের বেশি নয়।
বেশিরভাগ জায়গায় দেখা যায় ভালোবাসা দিবসের সঙ্গে লাল রংটি প্রায় যুক্ত এবং লাল রংটিকেই ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে বেশি ব্যবহার করা হয়। অন্যান্য ফুলের চেয়ে এই বিশেষ দিনটিতে লাল গোলাপ উপহার হিসেবে দেওয়ার রীতি অনেক জায়গায় প্রচলিত। বিশেষ করে আমেরিকা কিংবা কানাডার মতো দেশে দেখা যায়- এই দিনে তরুণ-তরুণীরা কিংবা দম্পতিরা তাদের ভালোবাসা প্রকাশে চকোলেট, লাল গোলাপ, অথবা দিনটিকে ঘিরে বাইরে ডিনার করা, এমন সব কাজে মেতে থাকে। ফ্রান্সে Valentine’s Day লা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন্স নামে পরিচিত। ফ্রান্সে এই দিনে পুরুষরা মেয়েদের ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে অনেক গোলাপ না দিয়ে একটি গোলাপ উপহার দেয়। এমনকি ফ্রান্সে এটাও চালু আছে যে, ভ্যালেন্টাইন্স ডে উপলক্ষে অনেকে বেনামিতে প্রেমপত্র লেখে। ব্রাজিলে ভ্যালেন্টাইন্স ডে আবার একটু ভিন্ন নামে পালিত হয়, নাম দিয়া দস নামোরডোজ। ভালোবাসা দিবসকে সেখানে বলা হয় প্রেমিকা দিবস। দম্পতি কিংবা তরুণ-তরুণীরা ছোট ছোট উপহার এবং ফুল পাঠায় একে অপরকে। দক্ষিণ কোরিয়াতে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালিত হলেও ১৪ মার্চ মেয়েরা একটু অন্যরকম করে পালন করে দিনটি। এই দিনে মেয়েরা পুরুষদের চকোলেট উপহার দেয় এবং দিনটিকে তারা বলে হোয়াইট ডে। এই বছর ১৪ মার্চ মেয়েরা তার প্রিয় পুরুষকে চকোলেট উপহার দিলে পরের বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি পুরুষরা ভালোবাসা দিবসে সেই চকোলেট দেওয়া উপহারের বিনিময়ে অন্য কোনো একটি উপহার দিয়ে ভালোবাসার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
লেখক : চিকিৎসক লন্ডন, ইংল্যান্ড