ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

স্মার্ট বাংলাদেশের পথে মেট্রোরেল

মো. সাখাওয়াত হোসেন

প্রকাশিত: ২১:০১, ২৯ ডিসেম্বর ২০২২

স্মার্ট বাংলাদেশের পথে মেট্রোরেল

স্মার্ট বাংলাদেশের পথে মেট্রোরেল

অভিভবাদন বাংলাদেশ। মেট্রোরেলের যুগে বাংলাদেশের প্রবেশে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হলো। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অর্জনের ঝুলিতে মেট্রোরেলের সংযোজন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের পরবর্তী ভার্সন স্মার্ট বাংলাদেশের যে ধারণার বিষয়ে আমাদের অবগত করেছেন সে পথেই উজ্জ্বল একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে মেট্রোরেল প্রকল্প। কেননা, মেট্রোরেল ব্যবহার করতে স্মার্ট নাগরিক যেমন হতে হবে, ঠিক তেমনিভাবে রেলটির ব্যবহারবিধিও অত্যাধুনিক ও স্মার্ট। মেট্রোরেলের নির্মাণ ব্যয় ৩৩,৪৭২ কোটি টাকা। এতে সরকারি তহবিল হতে খরচ হয়েছে ১৩,৭৫৩ কোটি টাকা এবং জাইকা থেকে ১৯,৭১৮ কোটি টাকা ঋণ সহায়তা গ্রহণ করা হয়েছে। মেট্রোরেল ঘণ্টায়  ১১০ কি.মি গতিতে চলতে সক্ষম। তবে বর্তমানে ঘণ্টায় ১০০ কি.মি গতিতে চলবে।

মেট্রোরেলে মোট স্টেশন সংখ্যা ১৭টি, দিয়াবাড়ি থেকে কমলাপুর ২১.২৬ কি.মি এবং দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও ১১.৭৩ কি.মি দৈর্ঘ্যসম্পন্ন। মেট্রোরেলে দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও যেতে ১৭ মিনিট সময় লাগবে এবং দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগবে ৩৮ মিনিট। মেট্রোরেলের প্রতিটি ট্রেন একসঙ্গে ২৩০৮ জন যাত্রী পরিবহন করবে। দৈনিক যাত্রী উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০,০০০ এবং দিনে ৪,৮৩,০০০ জন। তথ্য-উপাত্তে প্রতীয়মান হয়, মেট্রোরেল প্রকল্পটি একটি বিপুল কর্মযজ্ঞ। বাংলাদেশের মেট্রোরেল যুগে প্রবেশের অসাধারণ ঘটনাটিকে ইতোমধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রাষ্ট্র ও দায়িত্বশীলরা অভিনন্দন জানিয়েছে। 
সরকারের মেগা প্রজেক্টের মধ্যে অন্যতম একটি জনগুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট মেট্রোরেল প্রকল্প। সেটির বাস্তবায়নে একদিকে যেভাবে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতিচ্ছবি হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার সোপান সামনের দিকে ধাবিত হয়েছে। ঢাকার যানজটের কারণে বছরে আর্থিক ক্ষতি হয় ১ লাখ ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের ২ দশমিক ৯ শতাংশ। মাসে ৫০ লাখ এবং বছরে ৬ কোটি কর্মঘণ্টা খেয়ে ফেলছে যানজটÑঅভিমত বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের।

১৯৯৮ সালে ঢাকায় গাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের গত বছরের ৩ এপ্রিলের গবেষণা অনুযায়ী তা কমে এখন ঘণ্টায় ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দাঁড়িয়েছে। কাজেই মেট্রোরেল প্রকল্পটি ঢাকায় মানুষের কর্মঘণ্টা বাঁচাতে সহায়ক হবে নিঃসন্দেহে। এতে করে অর্থনৈতিক ক্ষতির হারও কমে আসবে ক্রমান্বয়ে। কেননা, মেট্রোরেলের কারণে অন্য গাড়ির উপর চাপ কমবে এবং ঢাকার রাস্তায় যানজট তুলনামূলক বিশ্লেষণে সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে।  
ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুসারে, উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত একটি বাসে যেতে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা এবং ভিড়ের সময়ে সময় লাগে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। মেট্রোরেলে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। যানজটের কারণে বাংলাদেশে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। ২০১৮ সালে পরিচালিত বুয়েটের একটি সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকা শহরের যানজটের জন্য বার্ষিক ৪.৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়, যা জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের বেশি। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকায় যানজটের কারণে প্রতিদিন ৩.৮ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট কর্মঘণ্টার মূল্য বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ ব্যাপক আকার ধারণ করে, যা জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে।

ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, মেট্রোরেল প্রকল্পটি প্রতি বছর ২.৪ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করবে, যা জাতীয় জিডিপির ১.৫ শতাংশের সমান। তাছাড়া মেট্রোরেল ঢাকার ১৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জন্য যাতায়াত সহজ করবে এবং দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে গতিশীল করবে, যা অর্থনীতিতে একটি বড় ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং স্মার্ট বাংলাদেশকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে মেট্রোরেল হবে খুব সহায়ক।
যানজটের কারণে যে অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, মানুষের কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছেÑ বিষয়টা শুধু এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যানজটের কারণে মানুষের হৃৎযন্ত্র ও ফুসফুসে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এর ফলে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হচ্ছে। বিশেষ করে যারা যানজট নিয়ন্ত্রণে কাজ করে তাদের মধ্যে এ ধরনের অসুখের প্রবণতা ব্যাপক। কেননা, তাদের প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা যানজটের অসহনীয় যন্ত্রণাকে সহ্য করতে হচ্ছে। দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের হিসাব মতে, যানজটের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য সমস্যায় দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ গড়ে ৮ কোটি ৭৪ লাখ টাকা।

ট্রাফিক সিগন্যালে দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। কাজেই, বাংলাদেশে বিশেষ করে যারা ঢাকার বাসিন্দা, তাদের নিকট মেট্রোরেল হতে যাচ্ছে একটি স্বপ্নের বাহন। তবে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনাও কিন্তু অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে মেট্রোরেলের স্টেশনে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যাত্রীদের জন্য ছোট গাড়ির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ঠিক তদ্রƒপ স্টেশন থেকে গন্তব্যে পৌঁছাতেও রাখতে হবে পরিবহনের ব্যবস্থা।

 
মেট্রোরেলের সুফল বাংলাদেশকে গ্রহণ করতে হবে পুরোপুরি। কেননা, এর আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব অপরিসীম। মেট্রোরেলের ওপর নির্ভর করে যে ধরনের অর্থনৈতিক উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে এবং ভবিষ্যতে হবে সব যেন বাস্তবায়ন সাপেক্ষে লাভজনক হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের নজরদারি প্রয়োজন। মেট্রোরেল মূলত একটি দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা, যা বিশ্বের অনেক বড় শহরে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এর ব্যবহার থেকে সংশ্লিষ্ট সিটির নাগরিক ও অর্থনৈতিক খাত উভয়ই লাভবান হতে পারে। সমসাময়িক সময়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত বাসে যেতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ ঘণ্টা। আর যদি যানজটের শিকার হয় তাহলে কতক্ষণ লাগতে পারে বলা মুশকিল।

সে তুলনায়, মেট্রোরেলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাতে সময় লাগবে মাত্র ৪০ মিনিট। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে জাপান হলো প্রথম দেশ, যেটি ১৯২৭ সালে একটি পাতাল রেলব্যবস্থা তৈরি করে। ভারত ১৯৭২ সালে কলকাতায় শুরু করে মেট্রো সিস্টেম নির্মাণ। এর পরে ভারত অন্যান্য শহরেও মেট্রোরেল ব্যবস্থা তৈরি করে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ১৭৮টি শহরে ১৮০টি পাতাল রেলব্যবস্থা চালু রয়েছে।
মেট্রোরেলের ব্যাপক প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। এর মাধ্যমে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ১৭টি স্টেশনের জন্য অপারেটিং রুম, টিকিট কাউন্টার, লাউঞ্জ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্লান্ট, প্রার্থনার স্থান, অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, এসকেলেটর, লিফট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সংস্থাপন থাকবে।

সেসবের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য লোকবলের প্রয়োজন রয়েছে। তদুপরি স্টেশনগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আবাসিক স্থাপনা, বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে ব্যবসা পরিচালনায় প্রচুর লোকবলের দরকার হবে। এসব কিছুর সম্মিলিত অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ সৃষ্টিশীল বাজার অর্থনীতির নতুন নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি করবে এবং বিষয়গুলো সামগ্রিক অর্থনীতিতে মূল্যবান অবদান রাখবে।
পরিবেশবিদরা মেট্রোরেল প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়ে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দাবি করেছেন। মেট্রোরেলে পরিবেশ দূষণ নেই বললেই চলে। কেননা, এটি বিদ্যুৎচালিত গণপরিবহন। সরকার আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে আরও পাঁচটি মেট্রোরেল স্থাপনের উদ্যোগ হাতে নিয়েছে। মেট্রোরেল রাজধানীর পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মেট্রোরেল প্রতি ঘণ্টায় বেশি যাত্রী বহন করতে পারে, তাই ঢাকায় বাস ও অন্যান্য পরিবহনের ওপর চাপ ক্রমান্বয়ে কমে যাবে। এতে সড়কে যানবাহনের সংখ্যা কমবে, যা পরিবেশের জন্য হবে উপকারী। শব্দ, শক এবং কম্পন কমাতে মেট্রোরেলে ম্যাস স্প্রিং সিস্টেম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। 
এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে, মেট্রোরেল একটি দীর্ঘদিনের স্বপ্নের প্রকল্প, যেটি ঢাকা শহরকে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আধুনিক ও বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করবে। মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন সরকারের জন্য কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। ২০১৬ সালে গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলায় জাইকার প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানরা নির্মমভাবে নিহত হলে মেট্রোরেল প্রকল্প দীর্ঘদিন স্থগিত ছিল। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টায় হলি আর্টিজান ইস্যুটি নিয়ে বিশ্ববাসী সরকারের জঙ্গিবাদের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতির সুদৃঢ় অবস্থান দেখতে পায়। পরবর্তীতে করোনা মহামারিও প্রকল্পটির গতি মন্থর করে দেয়। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার ও জাপান সরকারের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের বহির্প্রকাশ ঢাকার বুকে মেট্রোরেলের বাস্তবায়ন। 
বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বে পদার্পণ সময়ের ব্যাপার মাত্র। বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বাংলাদেশের ধারাবাহিক উন্নয়ন অব্যাহত থাকলে সে সময় খুব বেশি দূরে নয়। কাজেই মূল কাজ হবে, সাধারণ জনগণকে সরকারের সঙ্গে একীভূত হয়ে উন্নয়ন কর্মকা-ে শামিল হওয়া। জাতীয় সম্পদের অপচয় ও অপব্যবহার রোধে সবারই সজাগ ও সচেতনতা। বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকার যে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা দেখিয়ে চলেছে, তার ধারাবাহিকতা বিদ্যমান থাকলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন যেভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে, স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নও অনুরূপ পূরণ হবে নিশ্চয়ই।  

লেখক : সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

×