ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ জুন ২০২৫, ৩০ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

কেন বিশ্বজুড়ে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন বুরকিনা ফাসোর সেনাশাসক

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১২ মে ২০২৫

কেন বিশ্বজুড়ে মুগ্ধতা ছড়াচ্ছেন বুরকিনা ফাসোর সেনাশাসক

ছবি: সংগৃহীত

৩৭ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন ইব্রাহিম ট্রাওরে – বুরকিনা ফাসোর সেনা প্রধান ও রাষ্ট্রনায়ক – আজ আফ্রিকার গণ্ডি ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে পরিচিত এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র অবস্থান, দেশীয় সম্পদের ওপর নিয়ন্ত্রণ, রুশপন্থী কূটনীতি এবং সোশ্যাল মিডিয়া জয়ের মাধ্যমে ট্রাওরে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন নতুন যুগের এক 'প্যান-আফ্রিকান বিপ্লবী' হিসেবে।

ট্রাওরের ভক্তরা তাঁকে তুলনা করছেন থমাস সানকারার সঙ্গে – যিনি ১৯৮০-এর দশকে বুরকিনা ফাসোর প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং যাঁকে অনেকেই 'আফ্রিকার চে গুয়েভারা' বলেন।

২০২২ সালের এক সেনা অভ্যুত্থানে ক্ষমতায় এসে ট্রাওরে ফ্রান্সকে ছেঁটে ফেলেন এবং রাশিয়ার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়েন। রুশ প্যারামিলিটারি বাহিনীর সহায়তায় নিরাপত্তা জোরদার করেন তিনি। পশ্চিমা খনি কোম্পানিগুলোর ওপর কঠোর নিয়ম চাপিয়ে ট্রাওরে দেশীয় খনিজ সম্পদে রাষ্ট্রীয় মালিকানা নিশ্চিত করতে থাকেন।

এপ্রিলে একটি নতুন স্বর্ণখনি প্রকল্পে রুশ কোম্পানি নর্ডগোল্ডকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। একইসাথে একটি জাতীয় স্বর্ণভান্ডার গঠনেরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর কয়েকটি খনি ইতোমধ্যেই জাতীয়করণ করা হয়েছে।

বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে আফ্রিকান-আমেরিকান ও কৃষ্ণাঙ্গ ব্রিটিশদের মধ্যেও ট্রাওরের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কেউ কেউ তাঁকে ‘আফ্রিকার নতুন আশার আলো’ হিসেবে দেখছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁর বিপ্লবী বক্তব্য ও স্টাইলিস্ট উপস্থিতি ভাইরাল হচ্ছে, যদিও অনেক ভিডিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি বিভ্রান্তিকর।

২০২৩ সালে রাশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনে দেওয়া তাঁর বক্তৃতা ("ঔপনিবেশিকদের ইশারায় আর নাচব না") ব্যাপক সাড়া ফেলে। এমনকি মিক মিল নামের এক মার্কিন র‍্যাপার তাঁকে নিয়ে পোস্ট করে বসেন, যদিও পরে নাম গুলিয়ে ফেলায় সেটি মুছে ফেলতে হয়।

ক্যাপ্টেন ট্রাওরে নিজেকে 'জনতার মানুষ' হিসেবে তুলে ধরেন – সরাসরি কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রদের সঙ্গে মিশে কথা বলেন। তাঁর স্টাইল, বক্তৃতা ও তরুণ বয়স তাঁকে বর্তমান আফ্রিকার বয়স্ক, ক্ষমতালোভী রাজনীতিকদের থেকে আলাদা করেছে। ঘানায় একটি রাষ্ট্রপতির শপথ অনুষ্ঠানে যখন তিনি সশস্ত্র পোশাকে উপস্থিত হন, তখন অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধানদের চেয়ে দর্শকদের নজর ছিল তাঁর দিকেই।

তবে সব অর্জনের মাঝেও বুরকিনা ফাসোতে ১০ বছর ধরে চলা জিহাদি বিদ্রোহ দমন করতে পারেননি ট্রাওরে। বিরোধী দল, সাংবাদিক, এমনকি ডাক্তার ও বিচারকদের ওপর দমননীতি চালিয়েছেন। আইভরি কোস্ট ভিত্তিক 'ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ তুলে সেনা মোতায়েন করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকান কমান্ড দাবি করেছে, ট্রাওরে দেশের স্বর্ণসম্পদ নিজ নিরাপত্তায় ব্যবহার করছেন – এমন অভিযোগ তাঁকে নিয়ে সমালোচনার মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।

আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক বলছে, সুরক্ষা সংকট সত্ত্বেও বুরকিনা ফাসোর অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে। চরম দারিদ্র্য কিছুটা হ্রাস পেয়েছে, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয় বেড়েছে।

কিন্তু বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন – অতীতে অনেক জনপ্রিয় সামরিক নেতা, যেমন ঘানার জেরি রলিংস, ক্ষমতার দীর্ঘমেয়াদে দুর্নীতির ছোবল এড়াতে পারেননি। ট্রাওরের জন্যও চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে – তিনি কী ব্যক্তিপূজা ছাড়িয়ে টেকসই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারবেন?

ট্রাওরের নেতৃত্বে বুরকিনা ফাসো, মালি এবং নাইজার ফ্রান্সের প্রভাব থেকে বেরিয়ে নতুন জোট গড়েছে। এই তরঙ্গ পশ্চিম আফ্রিকার রাজনীতিতে এক নাটকীয় মোড় তৈরি করছে। এখন দেখার বিষয়, এই তরুণ ক্যাপ্টেন সত্যিই ইতিহাস গড়তে পারবেন, নাকি তিনিও হবেন আরেকটি সামরিক শাসনের অংশমাত্র।

এসএফ 

×