ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

ড. মিহির কুমার রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ২৬ নভেম্বর ২০২২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে রাষ্ট্রপতি

এ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একশত বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান হয়ে গেল। এই পূর্তিকে কেন্দ্র করে আমরা ঢাবি ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা শুনেছি বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অবিভক্ত বাংলার দ্বিতীয় এবং এই উপমহাদেশের এগারোতম বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে বর্তমানে ১৩টি অনুষদ, ৮৪টি বিভাগ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৬১টি গবেষণা কেন্দ্র, ২০০৮ জন শিক্ষক ও ৪৬ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে অধিষ্ঠিত থাকেন পদাধিকার বলে রাষ্ট্রপতি। বর্তমানে দেশের ১৭তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত আছেন এ্যাডভোকেট মো. আবদুল হামিদ, যিনি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য।
১৯ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয় দুুপুর ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে। উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারজ্জামান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ, রেজিস্ট্রার প্রবীর কুমার সরকার, বিভিন্ন অনুষদের ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক পরিষদের সদস্য এবং গ্র্যাজুয়েটরা সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন ।

এর আগে বেলা ১১টায় সিনেট, সিন্ডিকেট ও একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং অধিভুক্ত কলেজের অধ্যক্ষ/ইনস্টিটিউটের পরিচালকরা কার্জন হলে উপস্থিত হয়ে সেখান থেকে শোভাযাত্রা সহকারে অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করেন। সমাবর্তনকে ঘিরে গত কয়েকদিন ধরেই ক্যাম্পাসে বিরাজ করছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। নোবেল বিজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জ্যঁ তিরোল সমাবর্তনে প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন। সমাবর্তনে তাঁকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি দেওয়া হয়। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনে ৩০ হাজার ৩৪৮ জন গ্র্যাজুয়েট ও গবেষক অংশ নিয়েছেন।

সমাবর্তনে ১৩১ জন কৃতী শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীকে ১৫৩টি স্বর্ণপদক, ৯৭ জনকে পিএইচডি, দুজনকে ডিবিএ এবং ৩৫ জনকে এম ফিল ডিগ্রি দেওয়া হয়। অধিভুক্ত সাত কলেজের গ্র্যাজুয়েটরাও ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ ভেন্যু থেকে সমাবর্তনে অংশ নিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এক শিক্ষার্থীকে সেরা মেধাবীর পদক পরিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। উদ্বোধনমূলক ভাষণে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নাম। ১৯২১ সালে মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এই বিদ্যাপীঠের যে অগ্রযাত্রা সূচিত হয়েছিল, নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বর্তমানেও সেই মূলধারা বিকাশমান রয়েছে।

সমাবর্তন উপলক্ষে নবীন গ্র্যাজুয়েট, অভিভাবক, শিক্ষকম-লীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের অন্যতম বৃহৎ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই দেশের সাধারণ মানুষের মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন, মহান ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মহান মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র-শিক্ষক নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, আমি সেসব বীর শহিদের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

তিনি প্রত্যাশা করেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, বিজ্ঞানমনস্ক ও মানবিকবোধসম্পন্ন জাতি গঠনে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান-প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আরও কার্যকর ও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তিনি দেশপ্রেম, মানবিক মূূল্যবোধ ও সৃজনশীলতা দিয়ে নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে দেশের কল্যাণে কাজ করে যাবে। মহামারী ও যুদ্ধে জর্জরিত পৃথিবীতে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন তরুণ প্রজন্মের একান্ত প্রয়োজন উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, সর্ব প্রকার সংকীর্ণতামুক্ত উদার জীবনচেতনা এবং সাংস্কৃতিক, ঐক্যসন্ধানী মানুষের সংখ্যা যত বৃদ্ধি পাবে, ততই বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বে প্রশান্তিময় পরিস্থিতি বিরাজ করবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন গ্র্যাজুয়েট ও গবেষকরা সমৃদ্ধ দেশ ও বিশ্ব গড়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। একই সঙ্গে সমাবর্তনের মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তার একাডেমিক উৎকর্ষ সাধনে ধারাবাহিক সাফল্য অব্যাহত রাখবে।
রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আমরা চাই উপাচার্যের নেতৃত্বে ও ছাত্র-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ও উচ্চ শিক্ষার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হোক। অর্থাৎ, সেন্টার অব এক্সিলেন্স হিসেবে গড়ে উঠুক। শিক্ষকরা হয়ে উঠুন সমাজে মর্যাদা ও সম্মানের প্রতীক। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকসহ যে কোনো নিয়োগের ক্ষেত্রে মেধা ও যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিতে হবে। গবেষণায় অবদানের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এক সময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ মর্যাদার চোখে দেখা হতো। সময়ের বিবর্তনে ক্রমেই যেন সেই ঐতিহ্য সংকুচিত হয়ে আসছে। ছাত্র শিক্ষক, ভৌত অবকাঠামো ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজনের তুলনায় পর্যাপ্ত না হলেও কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তুলনায় শিক্ষার গুণগতমান এবং গবেষণার ক্ষেত্র, পরিমাণ ও মান কতটুকু বেড়েছে বা কমেছে, সেটিও মূল্যায়ন করতে হবে। শিক্ষকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষকদের প্রতি আমার আহ্বান, আপনারা শিক্ষার্থীদের জন্য পড়াশোনা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলুন, যাতে তাদের এ জন্য বিদেশে পাড়ি দিতে না হয়।

আপনারা তরুণ গবেষকদের মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের মানুষের কল্যাণে এগিয়ে আসুন। ... শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার, কাউন্সিলিং অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ইউনিট, ইত্যাদি চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই ডিজিটাল যুগেও প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে, ভর্তি প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট উত্তোলন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে ছাত্রছাত্রীরা অবহেলা আর হয়রানির মুখোমুখি হন। আমি শিক্ষার্থীদের কাক্সিক্ষত সেবা দিতে ওয়ানস্টপ সার্ভিস সেন্টার, কাউন্সিলিং অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার, ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ইউনিট, ইত্যাদি চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানাই।’

‘পাশাপাশি সেশনজট কমানোর উদ্যোগ হিসেবে লস রিকভারি প্ল্যান, গবেষণা-প্রকাশনা মেলা আয়োজন এবং স্টুডেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড সাপোর্ট ইউনিট চালু করায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানাই।’ গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘তোমাদের শিক্ষার্জন যেন সমাবর্তন আর সার্টিফিকেটেই সীমাবদ্ধ না থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তোমাদের আজকের এই অর্জনের পেছনে বাবা-মা, শিক্ষকম-লী এবং রাষ্ট্রের যে অবদান ও ত্যাগ রয়েছে, তা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। দেশ ও জনগণের কল্যাণে সর্বদা নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে।’ শিক্ষকদের সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার চর্চার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে অনুকরণীয়, অনুুসরণীয় হয়ে ওঠার আহ্বান জানান তিনি।

শিক্ষকদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘আপনারা সমাজের সাধারণ মানুষের কাছে নেতৃস্থানীয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম এবং এর অনেক পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও শিক্ষকদের দেখলে বা তাদের কথা শুনলেই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসত। কিন্তু ইদানীং কিছু  উপাচার্য ও শিক্ষকের কর্মকা-ে সমাজে শিক্ষকদের সম্মানের জায়গাটা ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।’ একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, পরিচালন, মূল্যায়ন ও উন্নয়নকে ঘিরে। রাষ্ট্রপতি বলেন, অসুস্থতা সত্ত্বেও মনের জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অংশ নিয়েছি, যা হবে আচার্য হিসেবে আমার শেষ অংশগ্রহণ।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্য হিসেবে সমাবর্তনে লিখিত বক্তব্যের বাইরেও তিনি অনেক কথা বলেন, যা শিক্ষার্থীসহ সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। যেমন- তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা আমার ছিল না, কিন্তু সেখানে আমি চ্যান্সেলর। ‘আমার যে বংশধারা, সেখানে ৭০-৮০ বছরের বেশি কেউ জীবিত থাকে নাই, আগামী ডিসেম্বরে আমার বয়স ৭৯ বছর হবে। আল্লাহ জানেন কী হবে।’ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন মো. আবদুল হামিদ।

বাংলাদেশে সংবিধান অনুযায়ী দুই মেয়াদের বেশি রাষ্ট্রপতির পদে থাকা যায় না। সমাবর্তনে  রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ‘আমার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দ্বিতীয় মেয়াদ আগামী বছরের এপ্রিলে শেষ হবে, যা হয়ত এটাই আমার শেষ সমাবর্তন। তাই ভেবেছিলাম, দম থাকা পর্যন্ত এখানে উপস্থিত হওয়ার চেষ্টা করব। শরীর সায় না দিলেও মনের জোরে এসেছি।’ সর্বশেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তনের সাফল্য কামনা করেন রাষ্ট্রপতি।
ভাষণ বিশ্লেষণে দেখা যায়,  রাষ্ট্রপতি দেশপ্রেম দিয়েই দেশটাকে ভালোবাসেন, যার প্রমাণ তাঁর সদালাপী ভাষণ। ১৯৭০ সালে জাতীয় নির্বাচনে তদানীন্তন কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন-ইটনা-অষ্টগ্রাম নির্বাচনী এলাকা থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সদস্য নির্বািচত হন এবং তিনি ছিলেন তখনকার সময়ের সর্বকনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। এরপর থেকে সব নির্বাচনেই সফলতার ফল পেয়েছেন, যা সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসের এক বিরল ঘটনা। রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে তিনি জাতীয় সংসদের স্পিকার ছিলেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাও। আচার্য হিসেবেও তিনি সাফল্য দেখিয়েছেন বিগত আট বছরের কর্মকালে, যা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য এক বড় আশীর্বাদ।

লেখক : গবেষক, ডিন ও অধ্যাপক,সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

×