ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন

রাজু মোস্তাফিজ

প্রকাশিত: ২২:১৭, ৭ অক্টোবর ২০২২

স্মৃতিতে বেঁচে থাকবেন

তোয়াব খান

ঢাকার বনানী কবরস্থানে তার আদরের কন্যার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের সবার প্রিয় তোয়াব ভাই। একজন ৮৭ বছরের মানুষ এত স্মার্ট হতে পারেন আর প্রতিদিন অফিস করতেন ভাবতেই অবাক লাগে। সাংবাদিকতার বর্ণাঢ্য জীবন তার। প্রচার বিমুখ এ মানুষটি নিজের কাজকে ভালবেসে শুধু তার পেশাদারিত্ব ঠিক রেখেছিলেন অবিচলভাবে। অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। এ কারণে প্রবীণ বয়সেও এই মানুষটিকে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছিল বিএনপি সরকারের আমলে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষটি সারাটি জীবন শুধু দিয়েই গেছেন দেশ ও জাতিকে। আমি সৌভাগ্যবান আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মাঠের সাংবাদিককে তার স্নেহের পরশে আগলে রেখেছিলেন পরম আদরে। আমার দীর্ঘ ২৭ বছরে জনকণ্ঠের সাংবাদিকতা জীবনে ঢাকার বাইরে থাকার কারণে মাঝে মধ্যে তার সঙ্গে দেখা হলেও প্রায় টেলিফোনে কথা হতো। তার দিকনির্দেশনায় চলতাম সব সময়।

স্বল্পভাষী দরাজ কণ্ঠের মানুষটিকে প্রচন্ড ভয় পেতাম আমি। কুড়িগ্রামের রৌমারীর বড়াইবাড়ী সীমান্তে বিডিআর (বিজিবি) এবং বিএসএফের সংঘর্ষে প্রায় ১৬ জন বিএসএফ সদস্য মারা যায়। সারা বিশ্বে তোলপাড় হয়। তখন ছোট মানুষ আমি নিউজের গুরুত্ব তেমন বুঝতে পারিনি। নিউজের ভেতরের নিউজ চাচ্ছিলেন তোয়াব ভাই। আমার এ নিউজের অবহেলার কারণে প্রচন্ড বকাবকি করেছিলেন তিনি। নীরবে শুধু তার বকা শুনেছিলাম আর টপ টপ করে পানি বইছিল চোখ দিয়ে। কিছুক্ষণ পর আবারও অফিস থেকে টেলিফোন অপারেটর আমাকে জানালেন তোয়াব ভাই কথা বলবেন। যথারীতি দরাজ কণ্ঠে বলছেন মন খারাপ করো না। নির্দেশনা দিলেন কিভাবে নিউজের গভীরে ঢুকে নিউজ বের করে আনতে হয়। কাকডাকা ভোরে চলে গেলাম রৌমারীর সেই বড়াইবাড়ী সীমান্তে। তখনও সংঘর্ষ চলছিল। ধানক্ষেত ও তার আশপাশের জঙ্গলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিএসএফের লাশ। সরেজমিন রিপোর্ট একের পর এক করছি। প্রতিদিনই প্রথম পাতা অথবা শেষের পাতায় সেই সব স্টোরি বিশেষ আইটেম হিসাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। সারাদেশসহ সারা বিশ্বে আলোচিত হচ্ছিল আমার সেই রিপোর্টগুলো। এমন কভারেজে দারুণ খুশি হয়েছিলাম সেই দিনগুলোতে। আর আনন্দিত হয়ে মনে মনে ভাবতাম কবে আবার তোয়াব ভাই এমন বকুনি দেবেন।
এরও আগের কথা ১৯৯৪ সাল, সবেমাত্র রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কুড়িগ্রামে ফিরেছি। জনকণ্ঠের সংবাদদাতা হিসেবে কাজও করছি। প্রচন্ড খরা তখন। জুন মাসের দিকে ঢাকার জনকণ্ঠ অফিস থেকে রিপোর্টার হাসনাইন খুরশীদ ও ফটোগ্রাফার ইয়াসিন কবির জয় এসেছিল কুড়িগ্রাম অঞ্চলের খরার প্রতিবেদন তৈরি করতে।

এ সময় তারা আমাকে নিয়েছিল খরার প্রতিবেদন করার জন্য। তাদের কাছেই শুনেছি তোয়াব ভাইয়ের কথা। জনকণ্ঠের প্রাণ তিনি। তিনি সাংবাদিক তৈরির কারিগর। আমার যে কোন সমস্যা, সংবাদ তৈরির নানা কলা কৌশল সব কিছুই যেন তার সঙ্গে শেয়ার করি। এবং তাকে আগাম জানিয়ে রিপোর্ট তৈরি করি। জীবনের টার্নিং পয়েন্টে আসলাম আমি। মনে হয়েছিল উত্তাল এক সমুদ্রে বাঁচার জন্য এক টুকরো কাঠ পেলাম। ওই দুজন রিপোর্টার ঢাকায় ফিরে যাবার পর আমি একের পর এক সরেজমিন রিপোর্ট করা শুরু করলাম। তখন কুড়িগ্রামসহ উত্তরাঞ্চলে চলছিল মঙ্গা। কাজ করতে করতে বুঝছিলাম তোয়াব ভাই কী ধরনের রিপোর্ট পছন্দ করেন। তিনি মানুষের দুঃখ কষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। দুর্গম এলাকার এসব মানুষর কষ্টের চিত্র তুলে আনতে বলতেন। শুরু হলো কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাটের তিস্তা ধরলা ব্রহ্মপুত্র আর দুধকুমার নদ-নদীর চরের মানুষের মঙ্গার চিত্র তুলে ধরা। প্রতিদিন জনকণ্ঠে দারুণ কভারেজ দিতেন তিনি। এক সময় কুড়িগ্রামের এ অঞ্চলে প্রচুর ফতোয়াবাজি হতো। নারীদের প্রকাশ্যে বিচারের নামে দোররা মারত মাওলানা, মাতব্বরসহ গ্রামের দেওয়ানীরা। তোয়াব ভাইকে জানানোর পর টানা দুই বছর ফতোয়ার রিপোর্ট করেছি আমি। শুধু তার কারণেই কুড়িগ্রামসহ সারা দেশে বন্ধ হয়ে যায় ফতোয়াবাজি।

সম্মানিত হয় গ্রামীণ নিরপরাধ ওই মহিলারা। তুই রাজাকারের রিপোর্ট করলাম। তখনকার কুড়িগ্রামের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য তাজুল ইসলাম কাঁঠালবাড়ী গণহত্যার মূল নায়ক ছিল। তার রিপোর্ট প্রকাশিত হওয়ার পর কুড়িগ্রামসহ সারা দেশে হৈচৈ পড়ে গিয়েছিল। তাজুল ইসলাম আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তোয়াব ভাইয়ের কাছে গিয়েছিলেন। তোয়াব ভাই ফোন করে শুধু জানতে চাইলেন আমার কাছে কি কি প্রমাণ আছে।  দালিলিক সব কাগজ আর ভিডিও সব কিছুই পাঠিয়েছিলাম তার কাছে। এর পর আর কিছুই বলেননি। শুধু বলেছেন, এমনিভাবে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করো।
আমি যেন আমার আর এক বাবাকে হারালাম। কত বিপদে নানাভাবে সান্ত¡না দিয়েছেন। বুকের মাঝে আগলে রেখেছেন। বিএনপি আমলে সারের নিউজ করার অপরাধে স্থানীয় বিএনপির নেতৃবর্গের পেটোয়া বাহিনী এসে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান  ভাঙচুর করেছিল। হয়রানি গালিগালাজ করেছিল বারবার। তোয়াব ভাই পরম স্নেহে শুধু বলেছিলেন, মন খারাপ করো না। আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে আর যে এমন পরম স্নেহে কেউ আগলে রাখবে না। বলবে না আছি তোমার পাশে, মন খারাপ করো না। আমাকে ক্ষমা করবেন তোয়াব ভাই, আমি আপনার জন্য কিছু করতে পারিনি। এমন কি শেষ দেখাটিও দেখতে পারলাম না। ওপারে ভাল থাকবেন ভাই। আমি যতদিন বেঁচে থাকব আপনাকে ভুলব না।
 লেখক : সাংবাদিক

 

 

×