ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পঞ্চগড় ট্র্যাজেডি

নিরঞ্জন রায়

প্রকাশিত: ২০:৪৭, ১ অক্টোবর ২০২২

পঞ্চগড় ট্র্যাজেডি

নিরঞ্জন রায়

বাঙালী হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা শুরুর প্রাক্বালে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ নৌদুর্ঘটনায় যে বিপুল সংখ্যক মানুষের সলিল সমাধি ঘটেছে, তেমনটা দেশে এর আগে কখনও ঘটেছে কিনা আমাদের জানা নেই। গত পঁচিশে সেপ্টেম্বর রবিবার দুর্গাপূজার সূচনাপর্ব মহালয়া অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার উদ্দেশ্যে পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে ভক্তদের নিয়ে যাওয়ার সময় নৌকাটি আকস্মিক ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ৭০ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এবং এখনও নিখোঁজ রয়েছে অনেকে।

এই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যুতে সমগ্র জাতি স্তব্ধ হয়ে গেছে। এর শোক জানানোর ভাসা আমাদের জানা নেই। দুর্গাপূজার প্রাক্কালে দুর্ঘটনায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষের হতাহতের ঘটনা দেখে সেই ১৯৮৫ সালের জগন্নাথ হলের ছাঁদ ধসে ৩৯ ছাত্রের নিহত হওয়ার ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখনও সেই দুর্ঘটনায় সমগ্র জাতি হতবিহবল হয়ে গিয়েছিল, পূজার আনন্দ ম্লান হয়ে গিয়েছিল এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধার কাজে এবং বাড়িয়ে দিয়েছিল সহযোগিতার হাত। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি।

এই হৃদয়বিদারক ঘটনায় স্থানীয়ভাবে থমকে গেছে দুর্গাপূজার আনন্দ এবং ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই ঝাঁপিয়ে পড়েছে উদ্ধার কাজে এবং বাড়িয়ে দিয়েছে সাহায্যের হাত। এত কষ্টের মধ্যেও এটাই আশা জোগায়, এটাই সান্ত¡না দেয়। কিন্তু এই অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় যে সকল হতভাগ্য পরিবার তাদের প্রিয়জনদের হারিয়েছে, তাদের তো সবই শেষ হয়ে গেছে। কোন সান্ত¡নাই তো আর তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না।

প্রত্যেকটি পরিবার খুব অসহায়, শান্তিপ্রিয় এবং সাধারণ মানুষ, যারা বছর ধরে অতি সাধারণ জীবনযাপন করে এবং দুর্গাপূজা উপলক্ষে একটু আনন্দফুর্তি করে থাকে, যা তাদের সারা বছরের খোরাক। সেই উদ্দেশ্যেই এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন নৌকাযোগে মন্দিরের মহালয়া অনুষ্ঠান উপলক্ষে আয়োজিত ধর্মসভায় যোগ দিতে রওনা দিয়েছিল। হতভাগ্য ভক্তবিন্দু ঘুুণাক্ষরেও জানতে পারেনি যে, এই যাত্রাই হবে তাদের জীবনের শেষ যাত্রা।
দুর্গাপূজার পূর্বমুহূর্তে এরকম দুর্ঘটনায় পরিবার-পরিজনদের হারিয়ে প্রতিটি পরিবার দিশেহারা অবস্থার মধ্যে পড়েছে। কোন কোন পরিবারের একাধিক সদস্য এই দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। এই অবস্থায় প্রতিটা ভুক্তভোগী পরিবার যে অসহায় অবস্থায় পড়েছে, তা কল্পনা করতেও গা শিউরে ওঠে। প্রশাসন, এলাকাবাসী, সরকার এবং রাজনৈতিক দল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে, যা এই মুহূর্তে ভুক্তভোগীদের জন্য সবচেয়ে বড় শক্তি। কিন্তু পরিবারগুলোর ক্ষতি তো অপূরণীয়। যদিও কোন সান্ত¡না এবং সহযোগিতাই তাদের এই ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবে না, তারপরও তাদের পাশে থাকতে হবে দীর্ঘ সময় ধরে।

এবছর দুর্গাপূজার আয়োজনে কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন করে সেই অর্থ দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে প্রদান করে এই দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আশা করব, দেশব্যাপী দুর্গাপূজা উদ্যাপনের সঙ্গে যারা জড়িত, তারাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন। দুুর্যোগ, দুর্ঘটনা এবং বিপর্যয়ের মুহূর্তে ভুক্তভোগীদের পাশে দাঁড়ানোর চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে না।
সতর্কতা গ্রহণ না করলে বিশেষ করে নিজের সতর্কতা নিজে নিশ্চিত না করলে যে কি মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তার বড় উদাহরণ সাম্প্রতিক পঞ্চগড়ের করতোয়া নদীতে নৌকাডুবিতে অর্ধশতাধিক ভক্তের অসহায় মৃত্যু। নৌকাডুবির যে ভিডিওটি ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে দেখানো হয়েছে, তাতে স্পষ্টতই লক্ষ্য করা গেছে যে, নৌকাটি ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে টালমাটাল অবস্থায় চলছিল এবং মুহূর্তের মধ্যে ডুবে যায় নৌকাটি। অথচ সামান্য সতর্ক হলেই এই দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব ছিল।

আমাদের দেশে ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ অন্য যে কোন অনুষ্ঠানে উৎসাহ-উদ্দীপনার মাত্রা একটু বেশিই থাকে এবং এটা আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য। কিন্তু উৎসাহ উদ্দীপনার মাত্রা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, ঘটে তখনই বিপত্তিটা । আমাদের দেশে দুর্গাপূজা একটি সর্ববৃহৎ ধর্মীয় অনুুষ্ঠান যা একটানা পাঁচদিন ধরে উদ্যাপিত হয়। মূলত মহালয়ার মাধ্যমে এই অনুষ্ঠান শুরু হয় এবং বিজয়া দশমীর মাধ্যমে সমাপ্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদী অনুষ্ঠান হওয়ায় এর আয়োজনের ব্যাপ্তিও যেমন অনেক, তেমনি এখানে উৎসাহ-উদ্দীপনাও থাকে যথেষ্ট।

কিন্তু বাস্তবে এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে উৎসাহ-উদ্দীপনার মাত্রা অনেক ক্ষেত্রেই সীমা ছাড়িয়ে যায় এবং এর সঙ্গে নিরাপত্তার বিষয়টি কোনভাবেই বিবেচনা করা হয় না। ফলে, যে কোন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকে প্রতি মুুহূর্তে। যতক্ষণ কোন অঘটন না ঘটে, ততক্ষণ সবই ভাল মনে হয়। কিন্তু কোন দুর্ঘটনা ঘটলেই শুরু হয়ে যায় হৈচৈ এবং চলতে থাকে শোক ও সমালোচনা।
প্রতিবছরই দুর্গাপূজা আয়োজনে নিরাপত্তার বিষয়টি অনেকস্থানে থাকে উপেক্ষিত। ফলে, এরকম দুর্ঘটনা যে কোন মুহূর্তেই ঘটতে পারে, যেমনটা ঘটেছে পঞ্চগড় জেলার করতোয়া নদীতে। এ কারণেই পঞ্চগড়ের দুর্ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে এখন থেকে দুর্গাপূজাসহ সকল অনুষ্ঠান আয়োজনে নিরাপত্তার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে সবার আগে। সকল প্রকার ঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই সব আয়োজন সম্পন্ন করতে হবে।

নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না বা ঝুঁকি থাকে সেরকম আয়োজন তা যত আকর্ষণীয়ই হোক না কেন, তা পরিহার করতে হবে। আর এই নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের সবার। সবই প্রশাসন বা সরকার করে  দেবে, তেমনটা আশা করা ঠিক হবে না। প্রশাসনের আন্তরিকতার কমতি নেই। কিন্তু তাদের অনেক সীমাবদ্ধতাও আছে। প্রত্যেক পূজাম-পের সব নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রশাসনের পক্ষে সম্ভব নয়। তাছাড়া পূজা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অনেকটা  চাইলেও প্রশাসন আগ বাড়িয়ে করতে পারে না। যেমন, নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে যদি কোন স্থানে আলোকসজ্জা বন্ধ করতে হয়, সেটা প্রশাসন আগ বাড়িয়ে নাও করতে পারে।

কেননা, এতে তাদের এই মর্মে দোষারোপ করা হতে পারে যে, প্রশাসন পূজা উদ্যাপনে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে। এ কারণেই নিজেদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিজেদেরই নিশ্চিত করতে হবে। এই ক্ষেত্রে পূজা উদ্যাপন কমিটির রয়েছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও ভূমিকা। তাদেরকেই পূজার সকল প্রকার ঝুঁকি এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে সবার আগে। সেটি করতে গিয়ে যদি তাদের প্রশাসনের সাহায্য সহযোগিতা নিতে হয়, সেটি তারা প্রশাসনকে অবহিত করবেন এবং প্রশাসন নিশ্চয়ই সহযোগিতা প্রদান করবে।

মোটকথা, অনুষ্ঠান আমাদের এবং জীবনও আমাদের। তাই আমাদের নিরাপত্তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে। দুর্গাপূজা উদ্যাপনের উৎসাহ-উদ্দীপনায় মেতে আমরা যেন নিরাপত্তার বিষয়টি বেমালুম ভুলে গিয়ে পঞ্চগড় ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি না ঘটাই, সেদিকে জরুরী নজর দিতে হবে সকলকে।

লেখক : সার্টিফাইড এ্যান্টি-মানিলন্ডারিং স্পেশালিষ্ট ও ব্যাংকার টরন্টো, কানাডা
[email protected]

×