ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হন্তারক হৃদরোগ

ডাঃ এস এম ইয়ার ই মাহাবুব

প্রকাশিত: ২০:৫৮, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২

হন্তারক হৃদরোগ

ডাঃ এস এম ইয়ার ই মাহাবুব

২৯ সেপ্টেম্বর বিশ্ব হার্ট দিবস পালিত হলো। এবারের থিম- টংব যবধৎঃ ভড়ৎ বাবৎু যবধৎঃ. অর্থাৎ হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের খবর নাও।
সারা পৃথিবীর মানুষের জন্য এক নম্বর কিলার বা হন্তারক ব্যাধি হলো হৃদরোগ বা করোনারি হার্ট ডিজিজ। আমরা যতই উন্নত বা শক্তিশালী ওষুধ আবিষ্কার করি না কেন, হৃদরোগ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি না করতে পারলে, এই ব্যাধিকে থামানো যাবে না। অর্থাৎ আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া হৃদয়ের রোগকে থামানো যাবে না। আর এই প্রচেষ্টা হতে হবে সর্বজনীন ও বছরব্যাপী; নির্দিষ্ট একটি দিনকে কেন্দ্র করে নয়।

হৃদরোগের কারণ

বাংলাদেশসহ বিশ্বে হৃদরোগের যে ভয়াবহ প্রকোপ, তার কারণগুলোকে ছোট পরিসরে বর্ণনা করা কঠিন। করোনারি হার্ট ডিজিজ বা হৃদরোগে হৃৎপি-ের ধমনীতে চর্বিযুক্ত পদার্থ জমা  হয়ে এর রক্ত সরবরাহ আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে বাধাগ্রস্ত বা বন্ধ করে দেয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ধমনীর দেয়ালে চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় পদার্থ জমে শক্ত হয়ে যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি এথেরোসক্লেরোসিস নামে পরিচিত। চর্বিযুক্ত শক্ত স্তরকে এথেরোমা বলা হয়।

এথেরোসক্লেরোসিস জীবনধারার কারণে হতে পারে ধূমপান, অলস জীবন কাটানো এবং নিয়মিত অতিরিক্ত এ্যালকোহল পান। কারও রক্তে যদি কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে, উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন আর অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস থাকে, তাহলে তার রক্তনালিতে এথেরোসক্লেরোসিস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। এথেরোসক্লেরোসিসই হার্ট এ্যাটাকের মূল কারণ।

হৃদরোগের উপসর্গ

করোনারি হৃদরোগের প্রধান লক্ষণগুলো হলো-বুকে ব্যথা (এনজাইনা), শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড় করা, বুকে ব্যথার সঙ্গে বেশি ঘাম দেয়া, অজ্ঞান বোধ করা, অসুস্থ বোধ করার সঙ্গে বমি বমি ভাব ইত্যাদি। প্রত্যেকের একই উপসর্গ থাকে না। কিছু লোকের করোনারি হার্ট ডিজিজ নির্ণয় হওয়ার আগে কোন লক্ষণ নাও থাকতে পারে।

হৃদরোগের ডায়াগনোসিস

যদি একজন ডাক্তার মনে করেন যে, কেউ করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকিতে আছেন, তাহলে তিনি একটি ঝুঁকি মূল্যায়ন বা জরংশ অংংবংংসবহঃ করতে পারেন। রোগের লক্ষণ বিশ্লেষণ করে, বর্তমান ও অতীত ইতিহাস মূল্যায়ন করে, অতীত চিকিৎসা ও পারিবারিক ইতিহাস এবং রোগীর জীবনধারা সম্পর্কে সম্যক জেনে জরুরী ভিত্তিতে ইসিজি ও রক্ত পরীক্ষা করা- যার মধ্যে ট্রপোনিন বা ঞৎড়ঢ়ড়হরহ অন্যতম। করোনারি হৃদরোগ নিশ্চিত করার জন্য আরও কিছু পরীক্ষার প্রয়োজন হতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে-ইকোকার্ডিওগ্রাফি, বুকের এক্সরে, ট্রেডমিল বা ইটিটি পরীক্ষা, রেডিওনিউক্লাইড স্ক্যান, করোনারি এনজিওগ্রাফি, সিটি করোনারি এনজিওগ্রাফি ইত্যাদি।

হৃদরোগের চিকিৎসা

হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীকে বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করে জরুরীভাবে চিকিৎসা করতে হয়। মূল কথা হলো- Minute is muscle. অর্থাৎ সঠিক চিকিৎসা শুরু করতে কয়েক মুহূর্তের দেরি রোগীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই হার্ট এ্যাটাকে চিকিৎসার জন্য অপেক্ষা করা মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করার সমার্থক। ভর্তি রোগীকে শুরুতে বুকের ব্যথার জন্য মরফিন ইঞ্জেকশন, এস্পিরিন ও ক্লপিডোগ্রেল বা সমজাতীয় ওষুধ, প্রয়োজনে অক্সিজেন, এন্টিথ্রম্বোটিক ও অন্যান্য জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রয়োগ করা হয়। পরবর্তীতে রোগের শ্রেণীবিন্যাস করে রক্ত তরল রাখার চিকিৎসা দেয়া হয়।
সুযোগ থাকলে আর বিশেষ কোন নিষেধ না থাকলে অবশ্যই রোগীকে এনজিওগ্রাম করে হৃৎপি-ের ধমনীতে ব্লক পাওয়া গেলে এর ছবি তোলা অপরিহার্য। এই ব্লক সারানোর জন্য বেলুন এবং স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়, যা এনজিওপ্লাস্টি নামে পরিচিত। সাধারণ মানুষ এই চিকিৎসা পদ্ধতিকে রিং পরানো নামে অভিহিত করে থাকে। অনিবার্য কারণে যখন এই চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয় না, তখন এক ধরনের ওষুধ যা ফিব্রিনোলাইটিক থেরাপি নামে পরিচিত, তা প্রয়োগ করে ধমনীর ব্লকের থ্রম্বাস বা জমাটবাঁধা রক্তকে গলিয়ে ফেলা হয়।
হার্ট এ্যাটাকের আরেকটি জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা  হলো সার্জারি যা বাইপাস সার্জারি বা ওপেন হার্ট সার্জারি যা ঈঅইএ নামে পরিচিত। এক্ষেত্রে রোগীকে অপারেশন করে বুক কেটে হৃৎপি-ের রক্তনালির ব্লককে সরাসরি খুলে দেয়া হয় বা বুকের ভেতর থেকে বা পায়ের রক্তনালি থেকে অংশবিশেষ কেটে এনে ব্লককে এড়িয়ে বা বাইপাস করে বিকল্পভাবে রক্ত প্রবাহ নিশ্চিত করা হয়।

স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসন

কারও হার্ট এ্যাটাক, এনজিওপ্লাস্টি বা ওপেন হার্ট সার্জারি হয়ে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সম্ভব। নিয়মিত হাল্কা ব্যায়াম, সুষম খাদ্য গ্রহণ, সিগারেট বা তামাক জাতীয় সকল প্রকার নেশাদ্রব্য পরিহার, প্রেসার ও ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ, পরিমিত ঘুম, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবন আর হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের দেয়া প্রেসক্রিপশন মতো ওষুধ গ্রহণ করা অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে, কম মাত্রার এস্পিরিন চিকিৎসকের পরামর্শ বাদে কখনও বন্ধ করা যাবে না।

হৃদরোগ প্রতিরোধে করণীয়

দৈনন্দিন জীবনে কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললে একজন ব্যক্তি হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে ফেলতে পারে। যেমন- একটি স্বাস্থ্যকর, সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলা, শারীরিকভাবে সক্রিয় থাকা ও ব্যায়াম করা, ধূমপান ছেড়ে দেয়া, রক্তের কোলেস্টেরল এবং চিনির মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, সর্বোপরি লবণযুক্ত প্যাকেটজাত খাবার পরিহার করা।
মনে রাখতে হবে, সুস্থ হার্ট সুস্থ জীবনের মূল চালিকাশক্তি। অসুস্থ হার্ট শরীরের অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকেও অসুস্থ করে তোলে। হার্টকে সুস্থ রাখলে স্ট্রোক, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ আর কিডনি রোগের মতো অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বহুলাংশে কমে যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

×