সঠিক শিক্ষাই পারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে
পুঁজিবাদী সমাজে আজকের অর্থনীতিতে মানুষ পণ্য ও বাজারের হাতে শৃঙ্খলিত। শৃঙ্খলিত মানুষের সম্পর্কও। নারী-পুরুষের সম্পর্ককে পুঁজি করে পৃথিবীজুড়ে গড়ে ওঠা পর্নোবাণিজ্য পুরনো ব্যাপার হলেও মুক্ত তথ্য প্রবাহে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। এর নানা বিকৃতি ও অপপ্রয়োগ স্পর্শ করছে আমাদের এদেশীয় মূল্যবোধকেও।
নানাভাবে হয়রানি হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেল চলছে। সমাজের দুর্বল অংশ এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হচ্ছে নারীর। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গ্রাম-শহরের সাধারণ নারী অসতর্ক মুহূর্তে ট্রাপে পা দিয়ে সারাজীবন সামাজিক নিগ্রহে ভুগছে- প্রচুর ঘটছে এ রকম।
এ শতকের শুরুতে আমেরিকা প্রবাসী এক তরুণ দেশে এসে কয়েকজন তরুণীর সঙ্গে শারীরিকভাবে মিলিত হয়ে তার ভিডিও চিত্র বাজারে ছেড়েছিল। সে সময় ওই তরুণীদের একজন আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। ওই ঘটনার পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে সে সময়ের শীর্ষ এক টিভি তারকাসহ বেশ কিছু পর্নো সিডির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছিল। ধীরে ধীরে সংখ্যা বাড়ে।
শো বিজের অনেক মডেল অভিনেত্রী, নির্মাতার ভিডিও চিত্র ছড়িয়ে পড়লে এ নিয়ে আইন করার প্রশ্ন সামনে আসে। মডেল তারকাদের ভিডিওর বেশিরভাগই স্বেচ্ছায় ধারণ করা হলেও স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রী বা সাধারণ নারীদের ব্ল্যাকমেল করার জন্য অথবা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ট্র্যাপে ফেলে তাদের পর্নোসিডি প্রচার করা হয়েছে। ধর্ষণ দৃশ্য ভিডিও করে মোবাইলে ইন্টারনেটে ছড়ানো হয়েছে। সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন অনেকে। কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এমন প্রেক্ষাপটে আইনের প্রয়োজন জরুরী হয়ে ওঠে।
পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে সর্বোচ্চ দশ বছর সশ্রম কারাদ- অথবা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা একই সঙ্গে এ দুই ধরনের শাস্তির বিধান রয়েছে। বিচার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল আইন-২০০২ এর আওতায় গঠিত ট্রাইব্যুনালে। আদালতে সোপর্দ করার পনেরো দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। মোবাইল কোর্টে বিচারের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, অভিযুক্তের সাজা হলে ষাট দিনের মধ্যে আপীল করতে পারবে। কোথাও পর্নোগ্রাফি তৈরি বা সংরক্ষণ করা হচ্ছে এমন খবরে সাব ইন্সপেক্টর বা তার উর্ধতন পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা বিনা ওয়ারেন্টে তল্লাশি চালাতে পারবে।
এ আইনের অধীনে কোনভাবেই পর্নোগ্রাফি তৈরি, সংরক্ষণ, বাজারজাতকরণ, বহন, আমদানি, রফতানি, সরবরাহ ক্রয়-বিক্রয় ও প্রদর্শন করা যাবে না। যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি তৈরি এবং এর জন্য কোন নারী, পুরুষ বা শিশুকে পারফর্ম করতে বাধ্য অথবা তাদের প্রলোভন দেখিয়ে স্থিরচিত্র ভিডিওচিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করেন তবে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদ- ও পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। যদি কোন ব্যক্তি পর্নোগ্রাফি সৃষ্টি করে কারও সামাজিক মানহানি এবং এর ভয়ভীতি দেখিয়ে কোন আর্থিক সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে তাহলে তাকেও একই শাস্তি দেয়া হবে।
এছাড়া কোন ব্যক্তি যদি পর্নোগ্রাফি বিক্রি, প্রদর্শন বা সরবরাহ করে তাহলে ওই ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ তিন বছর কারাদ- ও দশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। কোন ব্যক্তি যদি পর্নোগ্রাফি বিদেশ থেকে আমদানি রফতানি কিংবা ইন্টারনেট বা ওয়েবসাইটে সরবরাহ করে তাহলে দুই বছর সশ্রম কারাদ- এবং বিশ হাজার টাকা অর্থদ- দেয়া হবে। এ আইনের অধীনে কেউ পর্নোগ্রাফি সরঞ্জাম নিজ দখলে রাখলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা ও তিন মাস কারাদ- দেয়া হবে।
আঠারো বছরের কম বয়স্ক কারও কাছে কোন অশ্লীল বস্তু বিক্রি, ভাড়া, বিতরণ, প্রদর্শন ও প্রচার করা হলে তাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড ও বিশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড দেয়া হবে। এমনকি এ আইনের অধীনে কোন অশ্লীল কল্পমূর্তি আঁকা যাবে না এবং তা বাজারে সরবরাহও করা যাবে না।
কিন্ত অনেকেই এই আইন সম্পর্কে সচেতন নয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাইবার অপরাধ বিষয়ক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের শতকরা ছাপ্পান্ন দশমিক আটাত্তর ভাগই এ আইন সম্পর্কে কিছু জানেন না। গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগের বয়স আঠারো থেকে তিরিশ বছর। যারা আইন সম্পর্কে জানে এবং আইনের আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যে মাত্র সাত দশমিক শূন্য চার ভাগ সঠিকভাবে আইনী সুবিধা পায়। বাকিরা আইনী প্রক্রিয়ার প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ভুক্তভোগীদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যা তেতাল্লিশ দশমিক বাইশ ভাগ এবং নারীর সংখ্যা ছাপ্পান্ন দশমিক আটাত্তর ভাগ।
ইউএস নিউজ এ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিনীরা আট শ’ কোটি ইউএস ডলারেরও বেশি দিয়ে কিনেছে হার্ডকোর পর্নো, ভিডিও, পিপ শো, লাইভ সেক্স এ্যাক্টস, এ্যাডাল্ট কেবল প্রোগ্রামিং, পর্নো উপকরণ, কম্পিউটার পর্নো এবং পর্নো ম্যাগাজিন। হলিউডের সব ছবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাজারে যে আয় করে এ টাকা তার চেয়ে অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের রক ও কান্ট্রি মিউজিক থেকে অর্জিত যাবতীয় করের পরিমাণের চেয়েও বেশি। পুঁজির লক্ষ্য মুনাফা। আর তা টানছে আমাদের দেশীয় পুঁজিকেও।
স্বাভাবিকতাকেই অস্বাভিক করা হয় নানা ধরনের টাবু আরোপ করে। একটি শিশু বড় হতে হতে পৃথিবী সম্পর্কে অনেক জিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়। আমাদের অনুন্নত দেশে অনেক প্রশ্নের সদুত্তর বা বৈজ্ঞানিক উত্তর সে পায় না। তার জীবনের প্রথম শিক্ষক মা-বাবা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই উত্তর দিতে পারেন না। সবচেয়ে বেশি ভ্রান্ত ধারণা পায় সে শরীর সম্পর্কে। জন্ম রহস্য সম্পর্কে। সঠিক সেক্স এডুকেশনের অভাব বিভিন্ন ধরনের বিকৃতির দিকে ঠেলে দেয়। সেক্স এডুকেশন উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে অনেকে নাক সিঁটকে মুখ ঘুরিয়ে নেবেন। ভাববেন এসব নিষিদ্ধ কথা। আসলে নিষিদ্ধ নয়। মানুষের জন্ম বায়োলজিক্যালি স্বাভাবিক ঘটনা। এর পেছনে যে প্রক্রিয়া রয়েছে তাও স্বাভাবিক।
স্বাভাবিকভাবেই তার উপস্থাপন হওয়া উচিত। অভিভাবকরা জানেন না যে তাঁরা নিজেরাই ভুল ধারণা নিয়ে বড় হয়েছেন। সন্তানদের কাছে বিষয়গুলো যত লুকোতে চান তারা তত বেশি এ সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠে। একথার সত্যতা দেখেছি শিক্ষিত বিজ্ঞানমনস্ক দু’য়েকজন অভিভাবকের সন্তানদের ক্ষেত্রে। পিউবার্টির সঙ্গে সঙ্গে সন্তানদের শরীর এবং শারীরিক প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তারা বুঝিয়েছেন। এ নিয়ে অহেতুক ঢাক ঢাক গুড় গুড় না করাতে সন্তানদের স্বাভাবিক বিকাশ হয়েছে। সেক্সুয়ালিটি নিয়ে তারা তাই বাড়তি কৌতূহল দেখায়নি।
পর্নোসিডি বা সাইট তাদের কাছে রহস্যময়তার খনি নয়। নিষিদ্ধ আনন্দ অনুভব করার বিষয়ও নয়। সুতরাং কোনও কোনও ক্ষেত্রে আইন অবশ্যই দরকার তবে সবচেয়ে বেশি দরকার শিক্ষা। সঠিক শিক্ষাই পারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করতে। আর তা যদি অর্জিত হয়ে যায় তাহলে বিকৃতি স্পর্শ করতে পারে না।
আইন যতই হোক মুক্ত তথ্যপ্রবাহে পর্নোগ্রাফি হাতের নাগালেই থাকবে। মা-বাবা কতক্ষণ পাহারা দেবেন। পাহারা দেয়ার চেষ্টাই হাস্যকর। তারা বন্ধুর বাড়ি যাবে নয়ত সাইবার ক্যাফেতে। অথবা অন্য কোন উপায়ে বিকৃত কৌতূহল মেটাবে। এ যুগে কাউকে প্রযুক্তির বাইরে রাখা যাবে না। প্রতিরোধটা তাই বাইরে থেকে আরোপ না করে ভেতর থেকে তৈরি করে দিতে হবে। এজন্য মা-বাবা ও শিক্ষককে শিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনষ্ক হতে হবে আগে।