বঙ্গোপসাগর
এই গল্প সবাই জানে, অসংখ্যবার লেখা হয়েছে। তবু ইচ্ছে হলো আবার মনে করিয়ে দেই সবাইকে। রাশিয়া যুদ্ধ করছে ইউক্রেনের সঙ্গে আর চীন তার ক্ষমতা দেখাচ্ছে তাইওয়ানের সঙ্গে। দুই জায়গাতেই এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইন্ধন বা উস্কানি দেয়াতে এরা ওস্তাদ। বিশ্বজুড়ে অশান্তি করাই এদের বিদেশনীতি। যুদ্ধ বাধলেই অস্ত্র ব্যবসা চাঙ্গা, তাদের অর্থনীতির উন্নয়ন। আগস্ট মাস এলেই আমাদের মন খারাপ হয়। কারণ, আমার বাবা বলতেন, ১৫ আগস্টের আসল কারিগর এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
১৯৭১ সালের চরম অপমানের প্রতিশোধের বলি বঙ্গবন্ধু আর তাঁর পরিবার। মাঝে মাঝে ভাবি, ১৫ আগস্ট না হলে কি হতো? পদ্মা সেতু মনে হয় আরও ২০ বছর আগেই হতো, আমাদের হয়ত বা একটি বিমানবাহী রণতরী বঙ্গোপসাগরে ভেসে বেড়াত। আর গুধহসধৎ (ইঁৎসধ) আমাদের ডাকত বড়ভাই বলে।
যা হোক, ফিরে আসি গল্পে। খুব শীত পড়েছে, ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। ভারতও পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে যুদ্ধে জড়িয়েছে পাকিস্তানের সঙ্গে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে উত্থাপিত যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব নাকচ হয়েছে। মার্কিনী কূটচাল টিকল না। আমেরিকা তখন ভারতকে হুমকি দিল যুদ্ধ (আমাদের মুক্তিযুদ্ধ) বন্ধ করার। উদ্বিগ্ন ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নে (বর্তমানে রাশিয়া) একটি ঝঙঝ পাঠাল। যখন ’৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় নিশ্চিত, দুষ্ট কিসিঞ্জার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বঙ্গোপসাগরে পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী টঝঝ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ৭ম নৌবহর পাঠাতে প্ররোচিত করেছিল।
টঝঝ এন্টারপ্রাইজ তখন বিশ্বের বৃহত্তম পারমাণবিক শক্তিচালিত বিমানবাহী রণতরী। আর ভারতীয় নৌবাহিনীর বহরের নেতৃত্বে ছিল বিক্রান্ত, ২০টি হালকা যুদ্ধবিমান বহন করছিল। আনুষ্ঠানিকভাবে টঝঝ এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠানো হয়েছিল বাংলাদেশে আমেরিকান নাগরিকদের সুরক্ষার জন্য, আসলে এটি ছিল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভয় দেখানো এবং পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) স্বাধীনতা রোধ করা। একই সময়ে আরেকটি দুঃসংবাদ পেল ভারত। জানা গেল, একটি শক্তিশালী ব্রিটিশ বিমানবাহী নৌবহর বেশ কয়েকটি উবংঃৎড়ুবৎ এবং অন্যান্য জাহাজসহ ভারতীয় জলসীমায় পশ্চিম দিক থেকে আরব সাগরের দিকে আসছে।
ব্রিটিশ এবং আমেরিকানরা ভারতকে ভয় দেখানোর জন্য একটি সম্মিলিত নৌ আক্রমণের পরিকল্পনা করেছিল। ভারত রাশিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠাল। বাঘের বাচ্চা সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া) তৎক্ষণাৎ মার্কিন নৌবহরকে অবরুদ্ধ করতে ১৬টি সোভিয়েত নৌ-ইউনিট এবং ৬টি পারমাণবিক সাবমেরিন প্রেরণ করল বঙ্গোপসাগরের দিকে। ২ ডিসেম্বর ১৯৭১, টঝঝ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ৭ম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছেছিল। ব্রিটিশ নৌবহর আরব সাগরে আসছিল। পৃথিবী তার নিশ্বাস আটকে রেখেছিল।
কিন্তু, আমেরিকানদের অজানা, রাশিয়ার সাবমেরিনের পেরিস্কোপের সীমানায় তারা ধরা পড়ে আছে। টঝঝ এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত সাবমেরিনগুলো সতর্কতা ছাড়াই সামনে আসে। তারা ভারত এবং আমেরিকান নৌবাহিনীর মধ্যে অবস্থান নেয়। দুষ্ট আমেরিকানরা আশ্চর্য ও বিস্মিত, অনেক দেরি হয়ে গেছে, পশ্চাদপসরণ ছাড়া কোন বিকল্প নেই তাদের। আমেরিকান এবং ব্রিটিশ নৌবহর উভয়ই পিছু হটল। রাশিয়ান সাবমেরিনগুলো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকার বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে ভারতীয় নৌবাহিনীকে রক্ষা করেছিল, যা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে করেছিল ত্বরান্বিত।
আমাদের মনে রাখা জরুরী, কে আমাদের বন্ধু আর কে নয়। কেউ যেন আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর দুঃসাহস না দেখাতে পারে, সেই দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়েছে। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই।
লেখক : পরিচালক (ফিন্যান্সিয়াল এইড), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়