ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা-২

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া

প্রকাশিত: ২০:৪০, ১১ আগস্ট ২০২২

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনা-২

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

যে কজন মহান বাঙালী তাদের মেধার উকর্ষ, প্রজ্ঞা, সময়োপযোগী ও গতিশীল নেতৃত্ব এবং সুনিপুণ চিন্তা-ভাবনার আলোকচ্ছটায় বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে অধিকার আদায়ের নিরবচ্ছিন্ন প্রেরণা যুগিয়েছেন, তিনি হলেন- সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী, ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের মহান স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঔপনিবেশিক ও সা¤্রাজ্যবাদী শক্তির বেড়াজাল ছিন্ন করে তিনি বাঙালী জাতিকে শুধু একটি দেশই উপহার দেননি; সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি ভঙ্গুর অর্থনীতির রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো কেমন হবে তারও একটি যুগোপযোগী রূপরেখা প্রণয়ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু

দেশের উন্নয়ন কাঠামোতে অর্থনীতির কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে, কোন কোন খাতের সমন্বয়ে একটি সদ্য স্বাধীন ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পরিকল্পিত কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হবে, এসব বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় ১৯৭৩ সালের নবেম্বর মাসেপরিকল্পনা প্রণয়নে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছেবিনিয়োগ কৌশল, বঞ্চনা থেকে উত্তরণকে প্রাধান্য দেয়া, উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দিয়ে ক্যাডারভিত্তিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা ইত্যাদি সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় নিয়েই প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে

স্বাধীনতার পর প্রথম বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্র পরিচালনার হাল ধরেন, তখন বঙ্গবন্ধুর জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল অনেকযুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, অর্থনৈতিক ভঙ্গু অবস্থা, কলকারখানায় উপাদন বন্ধ; বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার দেশে বঙ্গবন্ধুর নিকট সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য নীতিনির্ধারণ করা ও প্রায় ২০০ বছর ধরে অবহেলিত কৃষি এবং কৃষকের উন্নয়ন এবং শিল্প ও বাণিজ্যকে পুনরুদ্ধার করাস্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠনের পরপরই বঙ্গবন্ধু কৃষি উপকরণ, কৃষি গবেষণা, নতুন জাত উদ্ভাবন ও কৃষি খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার ইত্যাদিকে গুরুত্ব দিয়ে কৃষি খাতে উপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দেনকৃষি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাজেটে ৬০ ভাগ পল্লী এলাকায় উন্নয়নের জন্য ব্যয়ের ঘোষণা দেয়া হয়এছাড়া যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু প্রায় ২২ লাখেরও বেশি কৃষক পরিবারের পুনবার্সনের দায়িত্ব নেন

যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি হিসেবে যে ২১ দফা প্রদান করা হয়েছিল, তাতে স্পষ্ট কৃষক শ্রমিকদের ভাগ্যোন্নয়ন ও স্বার্থের কথা বলা ছিলদফাগুলো বিশ্লেষণ করলে নিঃসন্দেহেই বলা যায় ২১ দফা কর্মসূচীই ছিল দেশের কৃষক ও কৃষির উন্নয়নের প্রথম রাজনৈতিক দলিলকৃষি ও কৃষকদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা বেশ প্রকট ছিল বলেই তাঁকে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষি, বন, সমবায় ও পল্লীমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলতিনি মনে করতেন দেশের কৃষি বিপ্লব সাধনের জন্য কৃষি ও কৃষকের কোন বিকল্প নেইদেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেনসেভাবে অন্যসব বিষয়ের সঙ্গে কৃষি ও কৃষকের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে

দেশকে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে নিতে হলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে, এ কথাটি খুব অল্প বয়সেই বুঝেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানজাতির পুঁজির বিকাশ ঘটানোর স্বপ্ন নিয়ে তিনি রুখে দাঁড়িয়েছিলেন ব্রিটিশ বেনিয়াদের বিরুদ্ধেতিনি পাকিস্তান সরকারের ফেডারেল কন্ট্রোল অব ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাক্ট’-এর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেনতিনি যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকারের শ্রম, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তখন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন এ দেশের শিল্পের বিকাশের পরিবেশ নিশ্চিত করতে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন স্বাধীন বাংলাদেশেনিজেকে নিয়োজিত করেন স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার কাজেদেশের জনগণকে নিয়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শুরু করেন অর্থনৈতিক মুক্তিলাভের সংগ্রামশেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা থেকে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অর্থনৈতিক বুনিয়াদ শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য কৃষি ও শিল্প বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েনএকটি উন্নত শিল্পসমৃদ্ধ দেশ গঠনে তাঁর ছিল একটি স্বতন্ত্র ভাবনাআর সেই ভাবনা থেকেই শিল্প ও শিল্পায়নের জন্য গ্রহণ করেন নানামুখী পরিকল্পনা

বঙ্গবন্ধু সরকার সীমিত সাধ্যের মধ্যেও এই বিষয়ে যথেষ্ট প্রয়াস চালায় সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি শিক্ষা বিভাগের এক ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ছাত্র বেতন মওকুফ করা হয়তবে শিক্ষক-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনাধীন বলে ঘোষণা করা হয়েছিলমুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে দেশের শতকরা ৬০ ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলএই সময়ে অনেক ছাত্র-শিক্ষক শহীদ হন এবং অনেক ছাত্রের অভিভাবক শহীদ হনসব মিলিয়ে শিক্ষা পুনর্গঠনের প্রশ্নটি সামনে আসে

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণনীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার-টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব সাধনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরির লক্ষ্যে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করতে বলেন এবং কমিশন শুধু শিক্ষার ভবিষ্যত কাঠামো এবং কারিকুলামই চিহ্নিত করে দেবে না, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবেশ এবং পরিস্থিতির নিরিখে জীবনঘনিষ্ঠ, পাদনমুখী ও পেশাসংশ্লিষ্ট মানবোন্নয়নমূলক বিষয়গুলোকেও সম্পৃক্ত করে দেবেপ্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে গণশিক্ষার আব্যশকতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বিলেছিলেন, গণশিক্ষা ছাড়া অর্থনৈতিক সমস্যার কার্যকর সমাধান সম্ভব নয়, সম্ভব নয় সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়নশিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানীদের সমন্বয়ে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করে তার সুপারিশসমূহ বাস্তবায়নের জন্য তিনি আন্তরিকতার সঙ্গে চেষ্টা করবেন

১৯৭২-এর অর্থনীতির আকার যেখানে মাত্র ৮ বিলিয়ন ডলার, সঞ্চয় জিডিপির তিন শতাংশ, বিনিয়োগ নয় শতাংশ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্বক ১৪ শতাংশ, সেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তূপ বললেও খুব বাড়িয়ে বলা হবে নাচারদিকে শুধু ঘাটতি আর প্রতিকূল প্রকৃতি, রাস্তাঘাট, বন্দর, রেললাইন ও সেতু বিধ্বস্ত, এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন, এ রকম শত শত প্রতিকূলতার মাঝেই সোনার বাংলা গড়ার মহাদায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন জাতির পিতাভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেয়ার ঘোষণাও দেন

একটি শিল্পোন্নত দেশ গড়ার জন্য বঙ্গবন্ধু তৈরি করলেন পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮)তিনি পরিকল্পানুযায়ী ছিয়াশি পৃষ্ঠাব্যাপী মস্ত এক শিল্পোন্নয়ন পরিকল্পনার ঘোষণা দিয়েছিলেনকালীন বিশ^ পরিস্থিতির আলোকেই বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক মুক্তির চিন্তা করেছিলেন১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু ব্যাংক, বীমা ও সব বৃহ শিল্প-কারখানাকে রাষ্ট্রীয়করণের ঘোষণা দেন এবং আরও জানান, শিল্প-কারখানার ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে ৪০ শতাংশ শ্রমিক থাকবেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিলগ্নিকরণ করা হবে, যার অনেকটা পরিত্যক্ত করা হয়েছেস্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান যথার্থরূপে ও স্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দর্শন নির্দেশিত ও প্রতিফলিত হয়েছে

বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রণীত দেশের সংবিধানে ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চল বৈদ্যুতিকীকরণের ব্যবস্থা, কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং জনগণের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়এর আগের অনুচ্ছেদে সমবায় ব্যবস্থার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করে ১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে প্রদত্ত এক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু বলেন, আজকে উপাদন বৃদ্ধি করতে হবেস্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবেসেজন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে

দেশের গ্রামীণ উন্নয়নকে সফল করার জন্য প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সমতাভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশল হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধুসমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে চালু করেছিলেন বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি কুমিল্লা উদ্ভাবিত দ্বিস্তরবিশিষ্ট নতুন সমবায় ব্যবস্থা যা পরে বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে

দেশের দারিদ্র্যপীড়িত উত্তরাঞ্চলে গ্রামীণ উন্নয়নের প্রশিক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনার জন্য ২.২ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলেন বগুড়া একাডেমিপরে ১৯৯০ সালে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি, বগুড়া একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে

বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার প্রতি পরতে মানুষের কল্যাণে কাজ করা দৃপ্ত চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়আর জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সেই স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করেছেনএ মুক্তি সংগ্রামে তিনি নিজের জীবনকে তুচ্ছ করেছিলেন১৯৪৭-এ দেশ ভাগ হওয়ার পর থেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠারবঙ্গবন্ধু সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়েছেন এবং ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে ছিনিয়ে আনেন মহান বিজয়

তারপর থেকে তিনি যুক্ত হন আরেক সংগ্রামেযার মূলমন্ত্র ছিল একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনতিনি এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করে গেছেনদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক নিরাপত্তাসহ মূল ক্ষেত্রে উন্নয়নের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলেনবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক কারণে দেশের প্রায় প্রতিটি জেলা, উপজেলা, থানা ঘুরেছেনতিনি এই দেশের অপার সম্ভাবনা দেখে মুগ্ধ হয়েছেন বারংবার

 

লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

×