ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মোঃ তরিকুল ইসলাম

অভিমত ॥ আমরা একা নই...

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ মার্চ ২০১৮

অভিমত ॥ আমরা একা নই...

আমাদের পরিবার বলতে শুধু বাবা-মা, ভাই-বোনকে বোঝায় না বরং দাদা-দাদি, নানা-নানি, চাচা-চাচি, ফুফা-ফুফু, মামা-মামি, খালা-খালু, দুলাভাই-ভাবিসহ আরও যারা আত্মীয়-স্বজন আছে সবাইকে নিয়েই পরিবার। শুধু আমরা একা নই, আমাদের পুরো পরিবারকেই আওয়ামী লীগ হতে হবে। আওয়ামী লীগ বলতে সবাইকে নৌকা মার্কার ভোটার হতে হবে। সবাই যদি নৌকার ভোটার হই তাহলে নৌকা মার্কার জয়লাভ করতে কোন দুশ্চিন্তা করতে হবে না। সবাই যদি নৌকা মার্কায় ভোট দেয় তাহলে নির্বাচনের সময় আমাদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইতে হবে না। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। বাংলাদেশের এমন কোন পরিবার নেই, যে পরিবারে নৌকার ভোটার নেই। আর সেই আমরা যদি সবাই সবার পরিবারটাকে কেবল গুছিয়ে রাখি তাহলে আমার মনে হয়, যে কোন পরিস্থিতিতে আমাদের জয় লাভে কোন চিন্তা করতে হবে না। আমরা যেভাবে কর্মী জোগাড় করি সেভাবে যদি সময় পেলে পরিবারের মানুষগুলোর সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে আলাপ করি, তাহলে তারাও একটু রাজনীতিসচেতন হতে পারে। আমরা মাঠে যাদের নিয়ে রাজনীতি করি তারা কিন্তু আমাদের রক্তের কেউ নন। কিন্তু সম্পর্কটা দায়-দায়িত্বটা বা রক্তের সম্পর্কের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী। আমাদের সব আত্মীয়স্বজন যদি একই মন-মানসিকতার হয় তাহলে তাদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে অনেক সুবিধা। আমরা নিজেরাই লক্ষ্য করলে দেখতে পাব- যখন পরিবারের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষ থাকে তখন ঘরের মধ্যেও অন্যরকম এক অশান্তি বিরাজ করে। সে জন্য আমরা রাজপথে কর্মী যোগাড় করার পাশাপাশি পরিবারের সঙ্গেও যদি একটু রাজনৈতিক আলাপ করি তাহলে পরিবারের সদস্যরাও রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে পারে। এর ফলে ঘরের মধ্যেও রাজনৈতিক শান্তি বিরাজ করবে। এমনও দেখা যায়, একজন অনেক বড় নেতা কিন্তু তার পরিবার জানেও না। কেননা সে নিজেই জানায়নি। নিজে নৌকায় ভোট চেয়ে গলা ফাটাচ্ছে, অন্যদিকে তার নিজের পরিবারের সদস্যরা অন্য প্রতীকে ভোট দিচ্ছে। আমি কি করি সেটা আমার পরিবারের জানতে হবে, সেই সঙ্গে আমার পরিবারের সমর্থন থাকতে হবে। অনেক সময় নিজে বড় নেতা হওয়ার পর তার সবধরনের সুযোগ-সুবিধা পরিবারের সদস্যরা ভোগ করছে। অপরদিকে কর্মীরা বঞ্চিত হচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নেতা হওয়ার আগে পরিবারের অনেক সদস্যই খোঁজ রাখে না। তাই আমাদের পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা করতে হবে। নিজেদের পাশাপাশি সব আত্মীয়-স্বজনদের আমাদের রাজনৈতিক মতাদর্শে নিয়ে আসতে হবে। নৌকার ভোটার বানাতে হবে। কেননা পরিবারের সব সদস্য যদি একই মতাদর্শের হয় তাহলে নানাভাবে উপকৃত হওয়া যায়। আমি ছাত্রলীগের একজন সক্রিয় কর্মী। আমি যদি ৫ জন আত্মীয়কে নৌকার ভোটার বানাতে পারি তাহলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের প্রায় ৩০ লাখেরও বেশি নেতাকর্মী রয়েছে। এই ৩০ লাখ নেতাকর্মীদের যদি ৫ জন করে আত্মীয়-স্বজন থাকে তাহলে দেড় কোটি নৌকার ভোটার হয়। এভাবে আওয়ামী লীগসহ অন্য যে সব সহযোগী সংগঠন রয়েছে তাদেরও যদি আজ ৫ জন করে আত্মীয়-স্বজন থাকে, আর তারা যদি সবাই নৌকায় ভোট দেয় তাহলে তো অন্য দলের সমর্থক খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশে যত ছাত্রলীগের কর্মী রয়েছে তাদের আত্মীয়-স্বজন দিয়েই নৌকা মার্কার জয় লাভ করানো সম্ভব। কিন্তু দেখা যায়, ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে অনেকেই নৌকা মার্কায় ভোট দেয় না। অনেক সময় দেখা যায় ছাত্রলীগের নেতা অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু যারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে রাজনীতি করে তারা যদি দল থেকে যথাযথভাবে মূল্যায়িত হয় এবং তারা যদি যথাযথভাবে দলের জন্য কাজ করে তাহলে দলকে জয়লাভ করতে বেশি বেগ পেতে হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ত্যাগী কর্মীরা যথাযথভাবে মূল্যায়িত না হওয়ার জন্য বাকি কর্মীদের মধ্যে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে এবং তারাও দলের জন্য যথাযথভাবে কাজ করতে পারে না। এভাবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, তাঁতি লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগসহ সব সংগঠন নেতা বানানোর ক্ষেত্রে যদি সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে এবং তারা যদি তাদের পুরো পরিবারকে নিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য কাজ করে তাহলে কোন পরিস্থিতিতেই আওয়ামী লীগকে হারানো সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা যারা আওয়ামী পরিবারের সদস্য তারা কেবল নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকি এবং যখন কোন প্রোগ্রাম আসে তখন কেবলই লোক দেখানোর জন্যই বিভিন্নভাবে লোক জোগাড় করে প্রোগ্রাম সফল করি। কিন্তু, প্রকৃতপক্ষে দেখা যায় ওই প্রোগ্রামের সব লোকই কিন্তু নৌকার ভোটার নয়। তাদের মধ্যে অনেকেই ভোটের সময় অন্য প্রতীকে ভোট দেয়। আমরা যদি মাঠে কর্মী অর্গানাইজ করার পাশাপাশি নিজেদের পরিবারের দিকেও একটু খেয়াল রাখি এবং সবাই মিলে এভাবে কাজ করি তখন পুরো বাংলাদেশ একটি আওয়ামী পরিবারে পরিণত হবে। আমরা কখনই আমাদের পরিবারের সঙ্গে রাজনৈতিক আলাপ করি না। আমাদের পরিবারের সদস্যদের নৌকায় ভোট দেয়ার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করি না। অনেক সময় দেখা যায়, আমি নিজে আওয়ামী লীগের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও অন্য দলের সমর্থকদের সঙ্গে আত্মীয়তা করি। ফলে আত্মীয়তা বজায় রাখার জন্য, তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য, সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য কোন রাজনৈতিক আলাপ করি না। যে যার মতো করে বিভিন্ন প্রতীকে ভোট দিই। যে যার মতো করে বিভিন্ন দলের সমর্থক হই। যার জন্য আমাদের সমর্থক কমে যায় এবং ভোটারও কমে যায়। এজন্য আমাদের আরও শক্ত, সচেতন ও রাজনৈতিকসচেতন হতে হবে। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আওয়ামী লীগ পরিবারের বাইরে আমরা আত্মীয়তা করব না। রাজনীতিতে পরিবারের সমর্থন না থাকলে ভাল কিছু করা সম্ভব হয় নয়। পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের সমর্থন রাজনীতিতে অনেক বড় শক্তি। আর এই শক্তি কেবল নৌকার ক্ষেত্রে নয় আমাদের ব্যক্তিগত জীবনেও অনেক ভূমিকা রাখে। আমরা যখন স্থানীয় পর্যায়ে কোন নির্বাচন করতে যাই তখন এইসব আত্মীয়-স্বজনদের ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। স্থানীয় ক্ষেত্রে যাদের আত্মীয়-স্বজন বেশি সেই সঙ্গে যাদের বংশ ও আত্মীয়-স্বজন বেশি ঐক্যবদ্ধ তারাই প্রকৃতপক্ষে বেশি শক্তিশালী। আমরা চেয়ারম্যান, মেম্বার, পৌর মেয়র, উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি দেখতে পাই? যাদের আত্মীয়-স্বজন বেশি এসব ক্ষেত্রে তারাই মূলত জয় লাভ করে। যার জন্য পরিবারকে বাদ দিয়ে কিছুই করা সম্ভব নয়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি পরিবারের পুরোপুরি সমর্থন পাওয়া না যায় তাহলে রাজনীতি করে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা যদি জাতির পিতার দিকে লক্ষ্য করি তাহলে দেখতে পাই যে, তিঁনি একদিনে এমনি এমনি জাতির পিতা হননি। বঙ্গবন্ধুকে তাঁর বাবা-মা, ভাই-বোনসহ সব আত্মীয়-স্বজন রাজনীতির ক্ষেত্রে অন্যরকম ভালবাসতেন। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা ও তার স্ত্রী সবচেয়ে বেশি ছাড় দিতেন এ ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু যখন জেলে থাকতেন, তখন তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী অনেক কষ্ট করে তাঁকে দেখতে যেতেন, তার খোঁজ-খবর নিতেন। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একজন মহীয়সী নারী ছিলেন। তাঁর ত্যাগের কথা বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধুকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হতো, তখন পুরো পরিবার তিঁনি সামলে রাখতেন। বঙ্গমাতা অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে বঙ্গবন্ধু যখন বাড়ি ফিরতেন তখন তাঁর হাতে তুলে দিতেন। বঙ্গমাতা তাঁর নিজের অলঙ্কার, বাসার ফ্রিজ বিক্রি করে দলের খরচ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ভাই আবু নাছের বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী, ছেলে-মেয়ের খরচ দিতেন। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারের ত্যাগই তাঁকে জাতির পিতা বানিয়েছে। কিন্তু, আমাদের পরিবারের ক্ষেত্রে কি এমন ত্যাগ আমরা দেখতে পাই? আমাদের ক্ষেত্রে কয়টা পরিবার আছে যেখানে আমাদের স্ত্রী, বাবা-মা, ভাই-বোন এতটা ত্যাগ স্বীকার করবে? জাতির পিতার পরিবার থেকে আমরা অন্তত এই শিক্ষাটা নিতে পারি। আমাদের নিজের প্রয়োজনে একটি ত্যাগী, রাজনৈতিক, আওয়ামী ও নৌকার পরিবার গড়তে হবে। এবং এটাই এখন সময়ের দাবি। লেখক : সভাপতি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ
×