
ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলার পর প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। অক্টোবরের মধ্যে প্রস্তুতি শেষ করার টার্গেট নিয়ে কাজ করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। জুলাই মাসেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করা হবে।
সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে। তার আগেই নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির সংলাপ হবে। এবার ভোট হবে ব্যালটে। প্রবাসীরাও ভোট দিতে পারবেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র মতে, ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনকে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনে যাবতীয় ব্যয়ের জন্য প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে সরকার। এই বরাদ্দ বুঝে পাওয়ার পর যাবতীয় নির্বাচন সামগ্রী ক্রয় শুরু করবে নির্বাচন কমিশন। ইতোমধ্যেই সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের কাজ শেষ পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। যেসব আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ হবে সেগুলো শীঘ্রই জানিয়ে দেবে ইসি। নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনও দ্রুত শেষ করা হবে।
এ ছাড়াও নির্বাচনের কেন্দ্র চূড়ান্ত করার কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। যেসব কেন্দ্র ভোট গ্রহণের জন্য সংস্কারের প্রয়োজন হবে তা করতে সংশ্লিষ্টদের ইসির পক্ষ থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রিসাইডিং ও পোলিং অফিসারদের তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ করা হবে অক্টোবরের মধ্যেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনকেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তাদের কাছ থেকে সহযোগিতার আশ্বাসও পাওয়া গেছে।
এদিকে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন হতে যাচ্ছে জানার পর বিভিন্ন মহল থেকে তফসিল ঘোষণার দাবি উঠতে থাকে। তবে রেওয়াজ অনুসারে এতো আগে তফসিল ঘোষণার সুযোগ নেই। সাধারণত ভোট গ্রহণের ৪০ থেকে ৬০ দিন আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। সে হিসেবে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সংসদ নির্বাচন হলে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় অথবা তৃতীয় সপ্তাহে তফসিল ঘোষণা করবে ইসি। তার আগেই ভোটার তালিকা চূড়ান্ত করাসহ সিংহভাগ কাজ শেষ করে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করবে।
নির্বাচন কমিশন সচিব আখতার আহমেদ দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা নির্বাচনের প্রস্তুতির জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি। যথাসময়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করা হবে। সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ দিন আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। তাই এবারও সে নিয়মে তফসিল ঘোষণা করা হবে।
দেশে এ পর্যন্ত ১২টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রথম সংসদ নির্বাচন হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ। এর ৬০ দিন আগে ৭ জানুয়ারি ঘোষণা করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনের তফসিল। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ভোট হয় পরের বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল)। ১৯৮৬ সালের ২ মার্চ ঘোষণা করা হয় তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল। ৪৭ দিন পর ভোট হয় ৭ মে।
চতুর্থ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ১৯৮৭ সালের ২৬ ডিসেম্বর। ভোট হয় ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ। পঞ্চম জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করা হয় ১৯৯০ সালের ১৫ ডিসেম্বর। ৭৮ দিন পরে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ভোট। ১৯৯৫ সালের ৩ ডিসেম্বর ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। ৫৫ দিন পর ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি (পুনঃতফসিল) ভোট হয়।
সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৭ এপ্রিল। ৪৭ দিন পর ওই বছরের ১২ জুন ভোট অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ২০০১ সালের ১৯ আগস্ট। ৪২ দিন পর ১ অক্টোবর ভোট হয়। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয় ২০০৮ সালের ২ নভেম্বর। ভোট হয় ৪৭ দিন পর ২৯ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল)।
দশম জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর। এর ৪২ দিন পর ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় ভোট। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০১৮ সালের ৮ নভেম্বর। ৪৬ দিন পর ৩০ ডিসেম্বর (পুনঃতফসিল) অনুষ্ঠিত হয় ভোট। আর সর্বশেষ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ১৫ নভেম্বর। আর ভোট গ্রহণ করা হয় ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি।
ইসি সূত্র জানায়, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রবাসীরাও বিশেষ ব্যবস্থায় ভোট দিতে পারবে। তবে এ বিশেষ ব্যবস্থা কি হবে তা শীঘ্রই নিশ্চিত করা হবে। আর দেশের কোনো কেন্দ্রে ইভিএমে ভোট হবে না। সব কেন্দ্রে ভোট হবে ব্যালট পেপারে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের সকল ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে নানা কৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে ইসি। নির্বাচন কমিশন ও ইসির কর্মকর্তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি অগ্রসর করার কাজ এগিয়ে নিচ্ছেন। এ বিষয়ে অংশীজনদের মতামতও নিচ্ছেন।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে এ বছর ডিসেম্বরে অথবা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে বার বার দাবি জানানো হয়। এ পরিস্থিতিতে ঈদুল আজহার আগে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে এপ্রিল মাসে নির্বাচনের ঘোষণা দেন। কিন্তু বিএনপির পক্ষ থেকে ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে অনড় অবস্থানের কথা সরকারকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
এ পরিস্থিতিতে নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়। তবে সম্প্রতি লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পর প্রধান উপদেষ্টা ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলার পর সকল টানাপোড়েনের অবসান ঘটে। এর পর থেকেই নির্বাচন কমিশন প্রস্তুতি জোরদার করতে থাকে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ জন্য সরকারের তরফ থেকে যত ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন হয় তা দেওয়ার আশ্বাসও দেন তিনি। এদিকে সরকার গঠিত নির্বাচন সংস্কার কমিটিও অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বেশ ক’টি সুপারিশ দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক দলগুলোও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে সামনে রেখে নিজ নিজ কৌশলে অগ্রসর হচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, আবদুর রহমানেল মাসুদ, তহমিদা আহমদ ও বিগ্রেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করতে বিরামহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। এ নিয়ে ক’দিন পর পর নিজেদের মধ্যে দীর্ঘ বৈঠকও করেন। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য কি কি প্রস্তুতির ঘাটতি রয়েছে সেদিকে নজর দিয়ে সামনে অগ্রসর হচ্ছেন তারা। এ ছাড়া নির্বাচন বিশেষজ্ঞ, বিদেশি কূটনীতিকসহ অংশীজনের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছেন তারা।
অতিসম্প্রতি নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দীর্ঘ বৈঠক করেন প্রধান নির্বাচন কশিমনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা হবে। তবে এত আগে তারিখ জানানো সম্ভব নয়। তিনি জানান, রেফারি হিসেবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করব। আমাদের দায়িত্ব হলো একটি সমতাভিত্তিক পরিবেশ তৈরি করা।
আমরা সেই লক্ষ্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দেওয়াই ইসির লক্ষ্য। নির্বাচনের প্রস্তুতি সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা অনেক কাজ এগিয়ে নিয়েছি। যেসব কাজ বাকি আছে, তা দ্রুত শেষ করা হবে।
এর আগে সিইসি নাসির উদ্দীন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, দেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে না পারলে বেইমানি হবে। এত রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা সম্ভব নয়। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে। জীবনে কোনোদিন আমি ফেল করিনি। আশা করি এবারও ফেল করব না। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করে সিইসি বলেন, সব বড় বড় দল সুষ্ঠু নির্বাচন চাচ্ছে। আশা করি, তারা তাদের কথা রাখবে।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন আয়োজনের জন্য প্রস্তুত। আমরা স্বাধীন ও ষোলো আনা নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করব। এবার এমন সুষ্ঠু নির্বাচন হবে যা অতীতে কখনো হয়নি। তবে সবাইকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে হবে।
এদিকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ধরে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ে নির্বাচনের প্রস্তুতি জোরদার করেছে। বিএনপির সিনিয়র নেতারা বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগর সফরে গিয়ে সভা-সমাবেশ করছেন। প্রতিটি সংসদীয় এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীরাও গণসংযোগ জোরদার করছেন। বিএনপি আপাতত ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে যদি শেষ পর্যন্ত সমঝোতার ভিত্তিতে সমমনা দলগুলোকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় তবে তা দেবে। তবে আপাতত সব আসনেই নির্বাচনী প্রচারে সক্রিয় রয়েছে দলটির নেতাকর্মীরা।
জামায়াতে ইসলামীও ৩০০ আসনেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইতোমধ্যেই ২৯৬টি আসনে প্রার্থী ঠিক করেছে জামায়াত। অনেক আসনে প্রার্থীও ঘোষণা করে ফেলেছে জামায়াত। এ ছাড়া আলোচিত নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপিও নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে। তারাও ৩০০ আসনে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানা যায়। এ ছাড়াও আরও বেশ কিছু দল নিজেদের মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।