
ছবি: সংগৃহীত
আল-আহসা — পূর্ব সৌদি আরবের বুকে বিস্তৃত এক প্রাচীন মরুদ্যান, যা শুধু আরবই নয়, সমগ্র বিশ্বের জন্য এক অনন্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বিস্ময়। ‘আল-আহসা’ নামটি আরবি ‘আল-হিসা’-এর বহুবচন, যার অর্থ শক্ত বালুমাটির নিচে জমা পানির আধার। বালির গভীরে লুকানো প্রাকৃতিক মিঠা পানি হাজার বছর ধরে এই শুষ্ক অঞ্চলে সবুজ জীবনের ধারক ও বাহক হয়ে আছে।
পারস্য উপসাগরের উপকূল থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অবস্থিত আল-আহসা সৌদি আরবের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের বৃহৎ অংশ জুড়ে বিস্তৃত। এই মরুদ্যান ঐতিহাসিকভাবে খ্যাতি পেয়েছে সূচিকর্মের শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী ‘বিশত’ নামক পুরুষদের পোশাক তৈরির জন্য। আল-আহসা অঞ্চলটি ঐতিহাসিক বাহরাইন প্রদেশের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবেও পরিচিত ছিল, যেখানে প্রাচীনকাল থেকে কৃষিকাজ এবং জনবসতি গড়ে উঠেছে।
পূর্ব আরবের রাজনৈতিক উত্থান-পতনের সঙ্গে আল-আহসার ইতিহাস অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বলা হয়ে থাকে, ৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে প্রখ্যাত কারমাতিয়ান নেতা আবু তাহির আল-জান্নবির নেতৃত্বে আল-আহসা আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনমুক্ত হয়ে স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়।
পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে এটি একের পর এক আরব বংশের হাতে শাসিত হয়েছে—উয়ুনিদ, উসফুরি এবং জাবরিদ বংশের অধীনে অঞ্চলটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়।
১৫২১ সালে আল-আহসা পর্তুগিজদের দখলে যায় এবং ১৫৫০ সালে এটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তবে উসমানীয়দের প্রভাব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি—১৬৭০ সালে বনু খালিদ উপজাতি অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ নেয়।
ঔপনিবেশিক ও আঞ্চলিক রাজনীতির নানা পালাবদলের পর উকায়ের চুক্তি (১৯২২) এবং কিং ইবনে সৌদের সামরিক বিজয়ের মধ্য দিয়ে আল-আহসা অবশেষে আধুনিক সৌদি আরবের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে, যা আজও তার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য আর ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে চলেছে।
আল-আহসা মরুদ্যানকে বাঁচিয়ে রেখেছে এখানকার অজস্র প্রাকৃতিক ঝর্ণা। উম্মে সাবা’হ, আল-হাররাহ এবং আল-খোদোদ-এর মতো প্রায় ৬০ থেকে ৭০টি ঝর্ণা শুষ্ক মরুভূমির বুকে সজীবতার ধারা বইয়ে দিচ্ছে অবিরাম। এসব ঝর্ণার ধারাবাহিক স্রোত হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে খেজুর চাষ ও কৃষিকাজের স্থায়িত্ব রক্ষা করে চলেছে।
বর্তমানে আল-আহসা প্রায় ২০ লাখ খেজুর গাছের নিবিড় আবাসস্থল। এখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ টন খেজুর উৎপন্ন হয়, যা শুধু সৌদি আরবেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
এই মরুদ্যানকে তার অনন্য প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বের কারণে ২০১৮ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ২০১৫ সাল থেকে এটি ইউনেস্কো সৃজনশীল শহরের নেটওয়ার্কেরও অংশ।
আল-আহসা মরুদ্যানের ১২টি গুরুত্বপূর্ণ স্থান আন্তর্জাতিকভাবে সাংস্কৃতিক ভূদৃশ্য হিসেবে নির্ধারিত:
সেগুলোর মধ্যে, পূর্বাঞ্চলীয় ও উত্তরাঞ্চলীয় মরুদ্যান- • আস-সীফ • সাক আল-কায়সারিয়া • কাসর খুজাম, কাসর সাহুদ, কাসর ইব্রাহিম • জাওয়াথা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান ও মসজিদ • আল-ওয়ুন গ্রাম • আইন কানাস প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান • আল-আসফার হ্রদ
আল-আহসা শুধু প্রাচীন মরুদ্যান ও সমৃদ্ধ কৃষিভূমি হিসেবেই নয়, বরং তেল সম্পদের জন্যও বিশ্বব্যাপী খ্যাত। ১৯৩৮ সালে দাম্মামের নিকট তেল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক চিত্র পরিবর্তিত হয়। এখানকার ঘাওয়ার তেলক্ষেত্র পৃথিবীর সর্ববৃহৎ প্রচলিত তেলক্ষেত্র হিসেবে স্বীকৃত, যা সৌদি আরবের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে। এই বিশাল তেলভাণ্ডারের কারণে আল-আহসা শুধু সৌদি আরব নয়, গোটা বিশ্বের জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।
বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই মরুদ্যান আজ পর্যটন, কৃষি ও শিল্পের এক অনন্য কেন্দ্রবিন্দু। প্রাকৃতিক ঝর্ণা, বিস্তীর্ণ খেজুর বাগান, প্রাচীন দুর্গ ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদগুলো হাজার বছরের আরব সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের জীবন্ত প্রমাণ। আধুনিক সৌদি আরবের দ্রুত উন্নয়নের ছোঁয়াতেও আল-আহসা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গৌরবময় ইতিহাসকে আগলে রেখেছে আজও।
সৌদি আরবের ইতিহাস, কৃষি, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন হলো আল-আহসা মরুদ্যান। আরব উপদ্বীপের বুকে জেগে ওঠা এই সবুজ মরুদ্যান শুধু আরব জগতেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের কাছে এক অনন্য প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিস্ময় হিসেবে বিবেচিত। প্রাচীনকাল থেকে এ অঞ্চল তার অগণিত প্রাকৃতিক ঝর্ণা, শীতল পানির উৎস আর বিস্তীর্ণ খেজুর বাগানের জন্য বিখ্যাত। এখানকার উর্বর জমি আর প্রাচীন সেচ ব্যবস্থা হাজার হাজার বছর ধরে কৃষিকে টিকিয়ে রেখেছে, যা আজও স্থানীয় মানুষের জীবিকা ও আর্থ-সামাজিক জীবনধারার গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, আল-আহসা বহু সভ্যতার সাক্ষী। এখানকার দুর্গ, প্রাচীন মসজিদ ও বাজারগুলোতে আরব ঐতিহ্যের শিকড় আজও অটুটভাবে লেগে আছে। আধুনিক সৌদি আরবের দ্রুত নগরায়নের মাঝেও আল-আহসা তার প্রাকৃতিক শোভা ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে সযত্নে সংরক্ষণ করে চলেছে। তাই ইউনেস্কো একে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, যা সৌদি আরবের গর্ব ও বিশ্ব পর্যটনের জন্য এক অমূল্য রত্ন।
আসিফ