ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

হাঁকডাকহীন স্মৃতি

বুড়ি নদীর পাড়ে নিঃশব্দ মুরাদনগরের সিদ্ধিগঞ্জ বাজার

মোহাম্মদ শরিফুল আলম চৌধুরী, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, কুমিল্লা

প্রকাশিত: ০২:৩২, ১৯ জুন ২০২৫

বুড়ি নদীর পাড়ে নিঃশব্দ মুরাদনগরের সিদ্ধিগঞ্জ বাজার

একসময় ক্রেতা-বিক্রেতার গলা ফাটানো হাঁকডাকে মুখর ছিল চারদিক। নৌকার বাঁশি বাজত, বুড়ি নদীর ঢেউয়ে মিলত বাজারের জোয়ার। কুমিল্লার মুরাদনগরের সেই সিদ্ধিগঞ্জ বাজার এখন নিঃস্তব্ধ স্মৃতিচিহ্নে পরিণত। শত বছরের বেশি পুরোনো বাজারের গায়ে লেগে আছে কেবল ঘাস, লতা আর নীরবতা। হাঁকডাকের জায়গায় এখন শোনা যায় পাখির ডাক, আর মানুষের কোলাহলের বদলে বয়ে চলে শূন্য সময়।

বাজারের ইতিহাস ও গল্প
বুড়ি নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল এই বাজার। দেড় শতকেরও বেশি সময় আগে নদীপথে আসা কার্গো ও নৌকা ভিড়ত এখানে। কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালী, ভৈরব থেকে আসত পণ্য—শাক-সবজি, দুধ-মাছ আর শাড়ি কাপড়। আনন্দ আর ব্যস্ততায় ভরে থাকত সকাল থেকে দুপুর। ছোট-বড় সবাই আসতেন কেনাবেচা আর মিলনমেলায়।

প্রকৃতি আছে, প্রাণ নেই
বাজারজুড়ে এখন কেবল ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি, তালাবদ্ধ দোকান, আর জং ধরা দরজা-জানালা। সাইবোর্ডের রঙ মুছে গেছে সময়ের খোঁচায়। মানুষ না থাকায় জায়গাজুড়ে ঘাস-লতাপাতা। দৃষ্টিসীমায় দেখা যায় নিঃসঙ্গ মসজিদ, গাছঘেরা মন্দির, আর এককোণে নিস্তরঙ্গ পুলিশ ফাঁড়ি।

মানুষের হৃদয়ের গল্প
সোনারামপুর গ্রামের আহসান হাবীব বলেন, “ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে এই বাজারে এসেছি। নিজের চাষের সবজি বেচে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছি।” সেই কোলাহলমুখর বাজারে আজ চুপচাপ দাঁড়িয়ে চোখে পানি আনেন তিনি। আরেক বাসিন্দা প্রকৌশলী মনিরুল বলেন, “১৯৮৭ সালের ডাকাতির পর বাজারে একটু ধস নামে। তবে প্রাণ হারায়নি, মানুষ ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নেয়।”

স্মৃতি আর সম্ভাবনার দ্বন্দ্ব
বাজারের পুরোনো নাপিতের গাছ, ঘোষদের মিষ্টির ঘ্রাণ আর জলকেলিতে মেতে ওঠা বুড়ি নদী—সবই আছে স্মৃতিতে। কুমিল্লা ওয়াইডব্লিউসিএ’র সাধারণ সম্পাদিকা আইরিন মুক্তা অধিকারী বলেন, “এই স্থানটি পর্যটনের জন্য দারুণ উপযুক্ত। প্রশাসন একটু নজর দিলেই এটি হয়ে উঠতে পারে কুমিল্লার এক দর্শনীয় স্থান।”

দু’শো বছর আগের নদীঘেঁষা প্রাণবন্ত বাজার এখন কেবল হাহাকার আর স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী। তবে আশার আলো দেখান মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলাউদ্দীন ভূঞা। তিনি জানান, বাজারটি পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় সড়ক সংস্কারসহ পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। হয়তো আবারও একদিন বুড়ি নদীর পাড়ে ফিরবে সেই পুরোনো হাঁকডাক, আবারও প্রাণ পাবে সিদ্ধিগঞ্জ বাজার।

 

রাজু

×