ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৯ জুন ২০২৫, ৫ আষাঢ় ১৪৩২

লক্ষ্মীপুরে চোখ ধাঁধানো দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

এইচ.এম আল-আমিন, কন্ট্রিবিউটিং রিপোর্টার, লক্ষ্মীপুর

প্রকাশিত: ০২:৫০, ১৯ জুন ২০২৫

লক্ষ্মীপুরে চোখ ধাঁধানো দৃষ্টিনন্দন মসজিদ

ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও স্থাপত্য আছে। যেগুলোর কোন কোনটি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিশ্ব ঐতিহ্যে স্থান পেয়েছে। ওই সকল স্থাপনার বেশির ভাগই পূরাকীর্তি এবং প্রাচীন মোঘল বা বৃটিশ আমলের তৈরি। যেগুলো নির্মাণ করেছিলেন প্রাচীন শাসক কিংবা রাজা বাদশারা। বর্তমানেও দেশে প্রতি নিয়ত হাজার হাজার স্থাপনা তৈরি হচ্ছে।

আধুনিক যুগে চোখ ধাঁধানো আর দৃষ্টিনন্দন এক অনন্য স্থাপনা লক্ষ্মীপুরের আস-সালাম জামে মসজিদ ও ইদগাহ সোসাইটি । যার অসংখ্য বৈশিষ্ট্যের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দোতলা মসজিদটিতে কোন জানালা নেই। মুসল্লীদের মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে একটি প্রবেশদ্বার। তবুও আলোর কমতি নেই মসজিদের ভেতরে। প্রাকৃতিক আলোয় আলোকিত থাকে এ মসজিদটি।

লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা ইউনিয়নের শেখের কেল্লা এলাকায় স্থাপিত এ স্থাপনাটি বিগত একশ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে একটি বিরল স্থাপনা। স্থানীয় রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ আর জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে এ দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি করেন। ২০২১ সালে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরপরই মসজিদটির তথ্যচিত্র সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার কনফারেন্সে পাঠানো হয়েছে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য। এটি আধুনিককালে লক্ষ্মীপুর জেলা ও বাংলাদেশে নির্মিত স্থাপত্যের মধ্যে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন এক স্থাপনা। এমন দাবি আগত দর্শনার্থী ও নির্মাতা স্থপতিদের।

অন্যদিকে এ মসজিদকে ঘিরে তৈরি হওয়া শিক্ষা কমপ্লেক্সের মধ্যে আস সালাম হাফেজিয়া মাদরাসটিকে হাফেজি ও ইংরেজি শিক্ষার সমন্বয়ে একটি আর্ন্তজাতিক মানের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে। সরজমিনে গিয়ে বিভিন্ন শ্রেনীর মানুষের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

নির্মাতাদের সূত্রে জানা যায়, আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ আর জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে স্থানীয় রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট নিজেদের জায়গায় জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে এ মসজিদ নির্মাণ শুরু করে। মসজিদটির নকশা তৈরিতে বাংলাদেশীয় একটি স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান এবং সাথে ছিল বিদেশী কয়েকজন স্থপতি।

বিরতিহীন কাজের পর ২০২১ সালের শেষের দিকে মসজিদটি মুসল্লিদের ইবাদতের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। প্রায় দশ হাজার বর্গফুট দোতলা এ মসজিদ নির্মাণে ব্যয় করা বহু অর্থ। সকল ব্যয়ভার বহন করেছে রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্ট।

চোখ ধাঁধানো ডিজাইন আর নজরকাড়া নকশায় নির্মিত এ মসজিদটি বাংলাদেশে আধুনিক নির্মাণ শৈলীর অনন্য নজির। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু দর্শনার্থী ছুটে আসছেন এ মসজিদটি দেখার জন্য।

মসজিদের আরও একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সেখানে ইবাদত করতে আসা মুসল্লিরা মসজিদের ভিতরে বসেই রোদ, বৃষ্টি, কুয়াশা উপভোগ করতে পারে। কারণ এ মসজিদটি এমনভাবে ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এর ভেতরে রোদ, বৃষ্টি সরাসরি এসে পড়ে। মুসল্লিরা উপভোগ করতে পারবে কিন্ত বৃষ্টিতে ভিজবে না ও রোদে পুড়বে না।

গরমরে সময় মসজিদকে শীতল করার জন্য মসজিদের ভেতরে রয়েছে বৃষ্টির পানি ও পানি সংরক্ষণের জন্য ৪টি জলাধার। জলাধারগুলোতে রাখা শীতল পাথর গ্রীষ্মকালে মসজিদকে শীতল করে রাখে। দোতলা এ মসজিদটির নিচ তলা দু ভাগে বিভক্ত। সামনে মেহরাব ও মসজিদের মূল অংশ। এর পিছনে মাঝ বরারব গলিপথ। তার দুপাশে শীতল জলাধার এবং রোদ, বৃষ্টি পবেশ পথ। মুসল্লিদের জন্য একটি প্রশান্তময় স্থান তৈরি করতে মসজিদে নরম প্রাকৃতিক আলোর ব্যবস্থা রয়েছে। পেছনের অংশে বড় গ্যালারির মসজিদ। যেখানে বসে মুসল্লিরা নিজ মনে ইবাদত করতে পারে। গ্যালারি অংশের পিছন থেকে দোতলায় উঠার সিড়ি। দোতলায় রয়েছে মহিলাদের নামাজ পড়ার জায়গা। পুরো মসজিদে এক সঙ্গে সাড়ে চারশ' জন মুসল্লি জামাতে নামাজ আদায় করতে পারেন।

নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি ইদগাহ হিসেবেও ব্যবহার করা হবে আস সালাম মসজিদ। প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের পর আগত শিশু ও মুসল্লিদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করা হয়।

মসজিদটির নানা দিক নিয়ে নির্মাণের উদ্যোগক্তা প্রতিষ্ঠান রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্টের দায়িত্বশীল একজনের সাথে কথা হয় । তিনি বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের একজন সিনিয়র আইনজীবি। তিনি তার বাবা মায়ের নামে এ ট্রাস্ট পরিচালনা করছেন যা, জনহিতকর কাজে পরিচালিত হবে।

সাক্ষাতকারের শুরুতে তিনি অনুরোধ করেন, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় নির্মিত এ স্থাপনার সাথে নিজের নাম জড়িয়ে প্রচার করতে চান না তিনি। তার সাথে কথা বলে জানা যায়, এ মসজিদকে ঘিরে এখানে আর্ন্তজাতিক মানের একটি হাফেজিয়া মাদরাসা, একটি গার্ল স্কুল এবং একটি কলেজ নির্মাণ করছেন তাদের ট্রাস্ট।

রহিমা মমতাজ ও সাইফ সালাহউদ্দিন ট্রাস্টের প্রধান র্নিবাহী এবং বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের ওই আইনজীবি জানান, আমাদের উদ্যোগের প্রথম স্থাপনা মসজিদ নির্মাণ শেষ হয়েছে।

আস সালাম হাফেজিয়া মাদরাসা সর্ম্পকে তিনি জানান, একজন মুসলমান হিসেবে আমি দেখছি যে, আমাদের সবার খুব পরিচিত একজন কোরআনে হাফেজকে উচ্চ কোন সমাজ তেমন ভালোভাবে গ্রহন করে না। তারা ভাবে একজন হাফেজ আরবির বাহিরে অন্য বিষয়ে ভালো জ্ঞান রাখে না। অন্যদিকে নন অ্যারাবিক ও অমুসলিম দেশগুলোতে মসজিদের ইমামের খুব অভাব। বিশেষ করে আমেরিকার মতো দেশে মসজিদের ইমাম খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের ইমামরা আরবির পাশাপাশি নিজদেশের ভাষায় পারদর্র্শী তবে তারা ইংরেজি তেমন জানে না। ফলে ইংরেজি ভাষা ভিত্তিক দেশে মসজিদের ইমাম পাওয়া খুবই কষ্টকর। কারণ সে সকল দেশে আলেম তৈরি হলেও হাফেজ তৈরি হয় না। আবার নন ইংলিশ দেশে হাফেজ তৈরি হয় তবে তারা ইংরেজি জানে না। বাংলাদেশে অনেক হাফেজ আছে কিন্ত হাফেজরা ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না।

সে চিন্তা থেকে আমি আর্ন্তজাতিক মানের হাফেজ তৈরির জন্য একটা চিন্তা করি। এ মাদরাসায় পড়তে যোগ্যতা লাগবে খুব মেধাবি কিন্ত কোন অর্থ দিতে হবে না। মাদরাসাটিতে হাফিজির পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদান করা হবে। আর্ন্তজাতিক মানের এ মাদরাসাটি থেকে ভবিষ্যতে যে হাফেজ বের হবে তারা পৃথিবীর যে কোন দেশে ইংরেজি ভাষায় বক্তব্য প্রদানে সক্ষম হবেন।

হাফেজি এবং ইংরেজি শিক্ষার সম্বনয়ে গঠিত মাদরাসাটিতে প্রতি ব্যাচে ৬০ জন ছেলে, ৪০ জন মেয়ে এবং ২০ জন হাফেজ হবেন এতিম ছাত্র থেকে। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে মাদরাসাটি শুরু হয়েছে। ২০২৩ সালে একটি গার্ল স্কুল চালু হয়েছে, ২৪ সালে কলেজও চালু হয়েছে।

সব শেষে তিনি বলেন, আমরা অন্য মানুষের জন্য কাজ শুরু করেছি। অন্যদিকে আমি নিজের ছেলে মেয়ে না, মানুষের ছেলে মেয়েদের জন্য কাজ শুরু করেছি। প্রতিদানে সৃষ্টিকর্তা আমার ছেলে মেয়েদের জন্য করবেন। কারণ প্রতিটি মানুষেরই একটি ভালো শিক্ষা ও ভালো কিছু পাবার অধিকার আছে।

আসিফ

×