
সৌদি আরবের স্থানীয় সময় ৯ জিলহজ, পবিত্র হজ
আজ বৃহস্পতিবার সৌদি আরবের স্থানীয় সময় ৯ জিলহজ, পবিত্র হজ। লাখ লাখ হজযাত্রী আজ মিনা থেকে আরাফাতের ময়দানে যাবেন। মিনায় ফজরের নামাজ আদায় করেই ‘লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক’ ধ্বনিতে হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে নিজ নিজ খিমায় আশ্রয় নেবেন। এখানেই দিনভর এবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন তারা। মূলত আল্লাহর অশেষ রহমতের ময়দান আরাফাতে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করার নামই হজ। এর আগে-পরে অন্য আনুষঙ্গিক কাজ করার মাধ্যমে হজের পরিপূর্ণতা দেওয়া হয়। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ¢ হজ। আর্থিকভাবে সক্ষম সব মুসলমানদের জন্য জীবনে অন্তত একবার পালন করা ফরজ।
এবার প্রচ- দাবদাহ ও গরমের মধ্যেই বিশ্বের ১৯ লাখেরও বেশি মুসলমান হজ পালন করছেন। বাংলাদেশ থেকে হজে গেছেন ৮৬ হাজার ৭৭২ জন। তাদেরসহ বিশ্বের সমস্ত হজযাত্রীদের স্বাগত জানাতে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। বুধবার দিনভর মিনায় ইবাদতে মশগুল ছিলেন হজযাত্রীরা। মক্কার গ্র্যান্ড মসজিদ থেকে ৭ কিলোমিটার (৪.৩৫ মাইল) উত্তর-পূর্বে অবস্থিত মিনা। মক্কা ও মুজদালিফার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান এটি। উপত্যকাটি উত্তর ও দক্ষিণে পাহাড় দিয়ে ঘেরা এবং মসজিদুল হারামের সীমানার মধ্যে অবস্থিত। শুধু হজ্জের সময়েই সেখানে দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ মানুষের ভিড় জমে।
এ সম্পর্কে মিনার মাঠ থেকে সাংবাদিক শহিদুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বুধবার মিনায় ছিল ১৯ লক্ষাধিক হজযাত্রীর মিলনমেলা। সবাই মিনার মাঠে এদিন এবাদত বন্দেগিতে ব্যস্ত ছিলেন। সাদা তাঁবুতে সবাই পাশাপাশি অবস্থান করেন। অগ্নি দুর্ঘটনা এড়াতে এ বছরও মিনার মাঠে রান্না করে খাবার তৈরির কোনো ব্যবস্থা নেই। এসব হজযাত্রীর সব খাবারই আসছে বাহির থেকে। অপরদিকে আরাফায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এবার কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে হজ পালনের সুব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আজ বাদ ফজর হজযাত্রীরা আরাফাতের ময়দানে গিয়ে সমবেত হবেন।
প্রতি বছর সৌদি বাদশাহর নির্ধারণ অনুযায়ী একজন সম্মানিত আলেম এ খুতবা দিয়ে থাকেন। গত বছর হজের খুতবা দিয়েছিলেন কাবার ইমাম শায়খ মাহের ইবনে হামাদ। এ বছর হজের খুতবা দেবেন কাবার ইমাম শায়খ ড. সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল হুমাইদ। সম্প্রতি সৌদি রয়্যাল কোর্ট ঘোষণা করেছে যে, সৌদি বাদশাহ শায়খ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল হুমাইদকে ১৪৪৬ হিজরির আরাফার খতিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ৯ জিলহজ ১৪৪৬ হিজরি মসজিদে নামিরা থেকে তিনি হজের খুতবা প্রদান করবেন। মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববির খবর সরবরাহকারী ওয়েব পোর্টাল ‘হারামাইন শরিফাইনে’ এ তথ্য জানানো হয়েছে।
শায়খ সালেহ ইবনে আব্দুল্লাহ আল হুমাইদ সৌদি আরবের বুরাইদা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি মক্কার উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেন। একই ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ও পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন যথাক্রমে ১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালে। পরে তিনি উম্মুল কুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরিয়া অনুষদে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে ৩৩ বছর বয়সে তিনি মসজিদে হারামের ইমাম নিযুক্ত হন। তিনি সৌদি আরবের শূরা কাউন্সিল ও হাই জুডিশিয়ারি কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন তিনি উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর, সিনিয়র ওলামা কাউন্সিলের সদস্য এবং সৌদি আরবের রয়্যাল কোর্টের উপদেষ্টা।
এদিকে মিনার মাঠ থেকে বেশকজন জনকণ্ঠকে জানান, এবারও বাংলাদেশের হজযাত্রীদের জন্য নেওয়া হয়েছে প্রযোজনীয় সব ধরনের ব্যবস্থা। তাদের বহন করার জন্য রয়েছে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস। রয়েছে বাসেরও ব্যবস্থা। মিনা থেকে আরাফাতের দূরত্ব বেশি না হওয়ায় অনেকে হেঁটেও রওনা হবেন। তবে বাংলাদেশি হজযাত্রীদের বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কিছু হজযাত্রী ভিড় এড়াতে মসজিদে নামিরাহর কাছে অবস্থান করার জন্য ফজরের নামাজের আগেই রাত ৩টার দিকে মিনার মাঠ থেকে আরাফাতের উদ্দেশে রওনা হবেন।
আরাফাতের অবস্থান সম্পর্কে হাদিস শরিফে বলা আছে- হজের মোট ফরজ কাজ হচ্ছে ৩টি। ইহরাম বাঁধা, ৯ জিলহজ নির্দিষ্ট সময়ে উকুফে আরাফায় অবস্থান করা ও কাবাঘরে তাওয়াফ করা। ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক হজের প্রধান রুকন উকুফে আরাফায় অবস্থান করাটা ফরজ। তাই আজ মিনার মাঠে ফজরের নামাজের পর পরই হজযাত্রীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ ও তামাম জিন্দেগির গুনাহ মাফ করার একান্ত বাসনা নিয়ে রওনা দেবেন আরাফাত অভিমুখে। এখানে জোহরের ওয়াক্ত থেকে শুরু হবে উকুফের সময়। এদিন যোহরের ওয়াক্ত থেকে সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যে ব্যক্তি আরাফায় উপস্থিত হবেন তার জন্য সূর্যাস্ত পর্যন্ত উকুফ করা ওয়াজিব। কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে পৌঁছতে না পারলে আগত রাতের সুবেহ সাদিক পর্যন্ত সময়ের মধ্যে জ্ঞাত ও অজ্ঞাতসারে কিছুক্ষণ অবস্থান করলেও উকুফের ফরজ আদায় হয়ে যাবে।
হাদিস মোতাবেক- আরাফায় পৌঁছে উকুফের আগে গোসল করা সুন্নত। অনেকে গোসল না করে শুধু অজু করেই সামান্য খাবার খেয়ে নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। আরাফাতের মাঠে আজকের করণীয় হচ্ছে -আরাফার কেন্দ্রবিন্দু মসজিদে নামিরার জামায়াতে অংশগ্রহণ করা। ইমামের পেছনে এক সঙ্গে একই আজানে যোহর ও আছর আদায় করতে হয়। কিন্তু মসজিদে নামিরায় জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় নিজ নিজ খিমায় বা তাঁবুতে যোহর ও আছর আলাদা পড়ার নিয়ম। তবে এ নিয়ে মতবিরোধও রয়েছে। নিজের তাঁবুতে যদি কেউ মসজিদে নামিরার জামায়াতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যোহর ও আসর একত্রে পড়তে চান, সেটাও সহিহ্ হয়ে যায়। এ নিয়ে বিবাদে না জড়ানোই শ্রেয় বলে মনে করেন মসজিদে নামিরার খতিব।
হাদিসে রয়েছে- আরাফাতের ময়দানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকার পর একজন হজযাত্রীর আসল হজ হয়ে যায়। সূর্যাস্তের পর সবাই হাজি হিসেবে গণ্য হবেন। আরাফাত ময়দান থেকে সূর্যাস্তের পর মাগরিবের নামাজ না পড়েই মুজদালিফার দিকে সব হাজি রওনা হবেন।
মুজদালিফার আমল ॥ আরাফাত থেকে এসে ৯ জিলহজ দিবাগত রাতে মুজদালিফায় অবস্থান করা সুন্নতে মুআককাদা। এদিন মাগরিব ও এশার নামাজ এক আজান ও এক ইকামতে মুজদালিফায় একত্রে পড়তে হবে। তবে অতিশয় বৃদ্ধ, নিতান্ত দুর্বল কিংবা অধিক পীড়িত রোগীর জন্য মুজদালিফায় অবস্থান না করে আরাফা থেকে সোজা মিনায় চলে যাওয়ার অনুমতি আছে। এ রাতে ঘুমানো ও আরাম করাই প্রধান আমল। কেননা মুসলিম শরিফের এক হাদিসে আছে, রাসুল (স) এ রাতে এশা পড়ে শুয়ে গেছেন। যেন সুবেহ সাদিকের পর উকুফের সময় দোয়া ও জিকিরে মশগুল থাকা যায়। তবে বর্তমানে দেখা যায়, মুজদালিফায় হাজিরা সারা রাতই বিছানায় সজাগ অবস্থায় শুয়ে থাকেন।
এ ছাড়া এখান থেকেই সংগ্রহ করতে হয় কঙ্কর। এসব কঙ্কর মারতে হবে মিনার মাঠের জামারায়। মুজদালিফায় ফজর নামাজ শেষে শ্রক্রবার (দশই জিলহজ) সব হাজি একত্রে রওনা দেবেন ফের মিনার মাঠে। এ দিন শুধু বড় শয়তানের ওপর কঙ্কর মারতে হয়। হজের ইহরাম বাঁধার পর থেকেই এ পর্যন্ত সবচেয়ে উত্তম জিকির তালবিয়া পড়া এখানেই শেষ করতে হয়।
কঙ্কর বা পাথর মারার নিয়ম হচ্ছে- ১০ জিলহজ সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য ঢলে পড়া পর্যন্ত অর্থাৎ জোহরের সময়ের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাথর মারা উত্তম। তবে অসুস্থ ব্যক্তিরা সূর্যাস্ত পর্যন্ত পাথর মারতে পারেন। তাও সম্ভব না হলে অন্য কেউ বদলি পাথর মারাও জায়েজ আছে। পাথর মারার পর তামাত্ত ও কিরান হাজিদের জন্য কোরবানি দেওয়া ওয়াজিব। মিনার মাঠেই কোরবানির সুবন্দোবস্ত রয়েছে। অবশ্য বাংলাদেশের হাজিরা সরকারি ও ব্যক্তিগতভাবে কোরবানি দিতে পারেন। কোরবানির পরই হাজিরা মাথামুন্ডন করে হালাল হয়ে যান। এরপর আবার তারা যাবেন মক্কা শরিফে। পবিত্র কাবাঘর তাওয়াফ করা ফরজ। তার পরের কাজটি সাফা মারওয়া সাতবার সায়ী করা ওয়াজিব। রাতে আবার হাজিরা ফিরে এসে মিনার মাঠে পর পর আরও ৩ দিন অবস্থান করে শয়তানকে পাথর মারার মধ্য দিয়ে শেষ করবেন ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ।