ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২২ মে ২০২৫, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

এবার আলোচনায় এইড চ্যানেল, ত্রান ‘চ্যানেল’ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে

মীর্জা মসিউজ্জামান

প্রকাশিত: ২২:০৮, ২১ মে ২০২৫; আপডেট: ০০:০৬, ২২ মে ২০২৫

এবার আলোচনায় এইড চ্যানেল, ত্রান ‘চ্যানেল’ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে

মানবিক করিডোর নয়, জাতিসংঘের প্রস্তাবে রয়েছে এইড চ্যানেল বা ত্রাণ ‘চ্যানেল’। মানবিক করিডোর ছাপিয়ে এখন আলোচনায় এসেছে ত্রাণ চ্যানেল। বহুল আলোচিত ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়েই আলোচনায় উঠে এসেছে এই এইড চ্যানেল বা ত্রাণ চ্যানেলের প্রস্তাব।

অন্তবর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বুধবার (২১ মে) এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘এইড চ্যানেল নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তবে সকল পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে আসা যেতে পারে।’ রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন অবস্থানের কারণে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান বিষয়টি খোলাসা করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, করিডোরের বিষয় অস্তিত্বহীন। এটা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি, হবেও না। তবে ত্রাণ ‘চ্যানেল’ দেওয়ার প্রস্তাব বিবেচনা করা হচ্ছে। 


এ বিষয়ে নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান আরো বলেন, ‘আরাকানে এইড ও অন্যান্য উপকরণ সাপ্লাই দেওয়া যাচ্ছেনা, তাই জাতিসংঘ সেখানে তার বিভিন্ন সহযোগীদের মাধ্যমে রাখাইনে মানবিক সাহায্য পৌঁছে দিতে চায়। এখানে ’করিডরের প্রয়োজনীয়তা নেই। যেটা প্রয়োজন আছে সেটা হচ্ছে ত্রাণ-সাহায্য পৌঁছে দেওয়া।’ 


তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ‘করিডর’ নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করেনি। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ত্রাণ সরবরাহের একটি ‘চ্যানেল’ তৈরির জাতিসংঘের প্রস্তাব বাংলাদেশ বিবেচনা করছে।’

বিশ্লেষকরা অবশ্য করিডোরের ভাল-মন্দ উভয় দিকই তুলে ধরেছেন। তবে করিডোর ইস্যুটি মানবিক হলেও নিরাপত্তা, অস্ত্র ও মাদক পাচারের মতো অবব্যহারের ঝুঁকির বিষয়টিও সামনে উঠে এসেছে। তারা বলছেন, মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে সেখানকার বিবাদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা হয় কঠিন।

মানবিক করিডোর বনাম এইড চ্যানেল: সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর সম্মতিতে নির্দিষ্ট এলাকা ও নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নিরাপদভাবে সহায়তা পৌঁছানোর পথই মানবিক করিডর। তবে কার্যকর করতে হলে সব পক্ষের সম্মতি ও সহযোগিতা আবশ্যক। অনেক সময় মানবিক করিডর রাজনৈতিক বা সামরিক স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। অস্ত্র ও মাদক পাচার, ভূখণ্ড দখল কিংবা কৌশলগত সুবিধা অর্জনের জন্য এটি অপব্যবহারের ঝুঁকিও বহন করে। 


তবে মিয়ানমার যদি বাংলাদেশকে অনুরোধ করে তাদের সাহায্য করার জন্য তাহলে মিয়ানমার এবং জাতিসংঘের খাদ্য সহায়তা পৌছানোর জন্য বাংলাদেশ এইড চ্যানেল-এর মাধ্যমে সাহায্য করবে। তবে সে এইড চ্যানেল দেবার ব্যাপারেও সরকার জনপ্রতিনিধিসহ সকলের সঙ্গে আলোচনা করার মাধ্যমেই সে সিদ্ধানত নিবে। তা অবশ্যই বাংলাদেশের কল্যাণের জন্য।


উল্লেখ্য এইড চ্যানেল হলো ‘সমস্যাগ্রস্থ দেশে খাদ্য সামগ্রি পাঠানোর জন্যদেশের অভ্যন্তরে কোনো রাস্তা না থাকলে প্রতিবেশি দেশের সীমানা ব্যবহার করে সমস্যাগ্রস্থ দেশেত্রাণ সামগ্রি পাঠানোর রাস্তাকে বলা হয় এইড চ্যানেল।’

মানবিক করিডরের ঝুঁকি কতটা: অনেক ক্ষেত্রে এমন করিডরের রাজনৈতিক ও সামরিক অপব্যবহারের ঝুঁকি থাকে। আবার অস্ত্র পাচার এবং দখলকরা এলাকায় জ্বালানি চোরাচালানের জন্যও এই করিডর ব্যবহৃত হওয়ার আশঙ্কা থাকে বলে মত দিয়েছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, এনআরসি বলছে এ ধরনের করিডরের সুরক্ষা ও প্রবেশাধিকার অনেকটা সীমিত থাকে। যে এলাকায় সংঘাত হয় সেখানে নির্দিষ্ট মানবিক করিডরে নিরাপদে পৌঁছানোও ত্রাণকর্মী ও বেসামরিক নাগরিকদের জন্য অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। তাদের দাবি, মানবিক করিডরের সফলতা নির্ভর করে অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর। যে অঞ্চলে মানবিক করিডর হবে সেখানকার বিবাদমান পক্ষ একমত হলে করিডর পরিচালনা সহজ হয়। কিন্তু সবাই রাজি না হলে তা হয় কঠিন।

রাজনীতিবিদদের অভিমত: করিডরের ব্যাপারে বিএনপি গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দলটির মহাসচিব বলেছেন, ‘জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট এমন বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা না করে সিদ্ধান্ত নিলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়তে পারে।’ জামায়াতে ইসলামীও একই মত পোষণ করে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছে।

করিডর বিষয়ে সরকারের এমন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’ মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেছেন, আলোচনা ছাড়া কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে‘ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ার সম্ভবনা থেকে যায়।’


মানবিক করিডরের ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামি’র নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোঃ তাহের বলেন, ‘চায়না এখানে সবচাইতে বেশি ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ মিয়ানমারের সাথে চায়নার বড় ধরনের রিলেশনশিপ আছে। তারা আমাদের এই নিউ প্রোপোজাল সম্পর্কে তাদের গভর্নমেন্টকে বলবে এবং উদ্যোগ গ্রহণ করার ব্যাপারে তারা চেষ্টা করবে’।


তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী বলেছেন,আলোচনার মাধ্যমে মানবিক করিডোর দেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।’

বিশ্লেষকদের মত
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক ভূতত্ববিদ এবং মানারাত ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুর রব জনকন্ঠকে বলেন, ‘বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের মতো দেশগুলো এখানে কূটনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ক রক্ষা করতে চায়।’


তিনি মনে করেন, ‘রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি না দিয়ে, সচেতনতা তৈরীর মাধ্যমে দেশপ্রেমকে সামনে রেখে কৌশলের মাধ্যমে করিডর ব্যবস্থায় অংশ নেওয়া সম্ভব। মানবিক করিডর দেওয়া কোনো সমস্যা বলে মনে হয়না।’ তবে দেশের রাজনৈতিক বিভাজনের কারণে আমাদের দুর্বলতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’


তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীনের কাউকেই বিমুখ করা যাবে না। সরকারকে অত্যন্ত হিসেব-নিকেশ করে, জনগণের সমর্থন নিয়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে দুই পক্ষের স্বার্থ রক্ষা হয়।’ 


চীনে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ জনকন্ঠকে বলেন, ‘করিডরের পরিচালন ব্যবস্থা জাতিসংঘের হাতে থাকলেও চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের হাতেই থাকা উচিত, যাতে প্রয়োজনে দেশ নিজেই তা বন্ধ করতে পারে।’


নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. বায়েজিদ সরোয়ার বলেন, ‘মানবিক করিডর বাস্তবায়িত হলে রোহিঙ্গা অনুপ্রেবেশ আপাতত কমতে পারে এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়তে পারে। তবে এর স্থায়িত্ব ও সফলতা নির্ভর করবে এর ব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর।’


মানবিক করিডর শুধু একটি পলিটিক্যাল টুল নয়, বরং এটি হতে পারে কৌশলগত সহযোগিতার একটি পথ। যদি তা সঠিকভাবে পরিচালিত হয় এবং দেশের স্বার্থ সর্বাগ্রে রাখা হয়। জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারতসহ সব পক্ষকে সামলে, সকল ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে বাংলাদেশকে রাষ্ট্রীয় দক্ষতায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে মানবিক সহায়তা এবং জাতীয় নিরাপত্তা দুই-ই সুরক্ষিত থাকে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের  প্রসঙ্গেও এই করিডোরের সম্ভাবনা রয়েছে বলে অনেকেই মনে করছেন।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ  জনকন্ঠকে বলেন, ‘যেই করিডর দিয়ে মানবিক সহায়তা যাবে, সেই পথেই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম বলেন, সংঘাতময় অঞ্চলে বেসামরিক মানুষের জন্য খাদ্য, ওষুধ, আয়সহ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার জন্য মানবিক করিডরের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।’ জাতিসংঘের রেজুলেশন ৪৬/১৮২ ও ৫৮/১১৪-এ মানবিক সহায়তার গাইডলাইন নির্ধারণ করা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফয়েজ আহমেদ বলছেন, সরকার নীতিগত রাজি হয়ে ভালো করেছে কারণ যেই করিডর দিয়ে সহায়তা যাবে সেই একই করিডর দিয়ে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠিয়ে তাদের জন্য সেখানেই মানবিক সহায়তার কথা বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বলতে পারবে।


তিনি বলছেন, করিডর জাতিসংঘ করলেও এতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন বা ভারত কিংবা এমন আরও কোনো শক্তি যুক্ত আছে কি-না সেটা জানতে হবে এবং তারা কিসের ভিত্তিতে যুক্ত হবে সেটাও সরকারকে পরিষ্কার করতে হবে। মনে রাখতে হবে এটা করতে গিয়ে প্রতিবেশীদের সাথে যেন নতুন সংকট  তৈরি না হয়।


মিয়ানমার বিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ বলছেন, মানবিক করিডরের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন সিদ্ধান্ত হচ্ছে অথচ দেশের মানুষ, রাজনীতিক ও প্রশাসনের কেউ কিছু জানে না বলেই তারা তথ্য পাচ্ছেন। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই মানবিক করিডর হয়ে আছে বলেই ১৩ লাখ রোহিঙ্গা এখানে আসতে পেরেছে। 

মুলত করিডোর নিয়ে এতো আলোচনা সমালোচনার সৃষ্টি হয় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে। যদিও এটিকে পরবর্তীতে ‘স্লিপ অব টাং’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই সময় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘এতটুকু আপনাদের বলতে পারি, নীতিগতভাবে আমরা এতে সম্মত। কারণ, এটি একটি হিউম্যানিটেরিয়ান প্যাসেজ (ত্রাণ সহায়তা পৌঁছানোর জন্য করিডর) একটা হবে। কিন্তু আমাদের কিছু শর্তাবলি রয়েছে, সেই বিস্তারিততে যাচ্ছি না। সেই শর্তাবলি যদি পালিত হয়, আমরা অবশ্যই জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’

রিফাত

×