
রাজশাহীর ভুবন মোহন পার্কে শুক্রবার জুলাই আন্দোলনে রাজশাহীতে আহত ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাৎ ও দোয়ার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিএনপ
আগামী ২০২৬ সালে শেষ হবে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি। এই চুক্তি শেষ হওয়ার আগেই পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতেই নতুন চুক্তির প্রস্তাব করতে চায় বাংলাদেশ ও ভারত। এ লক্ষে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দল সরেজমিন পরিদর্শনসহ ভারতের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। সরেজমিনে ফারাক্কায় পানিবণ্টন নিয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও বর্তমানে গঙ্গায় তুলনামূলক পানি কম থাকার বিষয়ে বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে আগামী তিন মাসের মধ্যে একটি কমিটি গঠনের বিষয়ে সম্মত হয়েছে দুই দেশ।
জানা গেছে, যৌথ নদী কমিশন ভারত যাওয়ার আগে দাবি করেছিল, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের জন্য আগামী তিন মাসের মধ্যে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি করবে দুই দেশ। কমিশন এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটিও করেছে। কমিটির মতামত অনুযায়ী, ভারতের নদী কমিশনকে যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। বৃহস্পতি ও শুক্রবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হোটেল ও ফারাক্কায় যৌথ নদী কমিশনের ৮৬তম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন যৌথ নদী কমিশনের সদস্য মোহাম্মদ আবুল হোসেন।
এ বিষয়ে আবুল হোসেন বলেন, ১৯৯৬ সালে গঙ্গা চুক্তি বাস্তবায়নের পর থেকেই প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত আমাদের চার সদস্যের দল এবং ভারতের চার সদস্যের দলের উপস্থিতিতে প্রতিদিন চারবার গঙ্গার পানি মাপা হয় এবং চুক্তি অনুযায়ী যার যতটুকু পানি পাওয়ার, তা ভাগ করে নেয়। আর এ বিষয়গুলো ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করতে দিল্লি ও ঢাকা থেকে উচ্চপর্যায়ের কমিটি যায় এবং চুক্তি ঠিকভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না বা আমরা যতটুকু পানি পাওয়ার কথা, তা পাচ্ছি কি না, সে বিষয়গুলোই তখন পরীক্ষা করা হয়। আমরা গত মঙ্গলবার ফারাক্কা গিয়েছিলাম, সব কিছুই পরীক্ষা করেছি। কোথাও সমস্যা নেই। বৃহস্পতিবার আমরা কলকাতায় এসে যৌথ বৈঠক করেছি।
দুপক্ষের আলোচনায় কী বিষয় এসেছে-জানতে চাইলে তিনি আরও বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ নেই। পানির ভাগাভাগি গাইডলাইন অনুযায়ী ঠিকভাবেই হচ্ছে, আমরা সেটাই জানিয়েছি। তবে চুক্তি বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হওয়ায় আমরা সন্তুষ্ট হলেও এবার গঙ্গার পানি প্রবাহ কম সে বিষয়টি আমরা শুধু তাদের কনসার্ন জানিয়েছি।
গত ১৯৯৬ সালে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তি হয় গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে। চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত দুই দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রতিদিন চারবার পানির পরিমাপ করা হয় এবং দুপক্ষের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী যার যতটুকু পানির প্রাপ্যতা ভাগাভাগি হয়। এর পাশাপাশি দুদেশের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি দল মার্চে এসে ভাগাভাগি বা পরিমাপ ঠিকভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যালোচনা করে। তাই গঙ্গার পানি চুক্তি পর্যালোচনায় এ বছরও বাংলাদেশ থেকে ভারতে গেছে প্রতিনিধি দল। গত মঙ্গলবার ফারাক্কা ব্যারাজে গিয়ে গঙ্গা থেকে পদ্মায় জলপ্রবাহের পরিমাণ ও অবস্থা খতিয়ে দেখে তারা। কোন প্রক্রিয়ায় গঙ্গা থেকে পদ্মায় জল যায়, তাও পর্যালোচনা করে। পর্যালোচনা করে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল পানি বণ্টনে অনিয়ম দেখতে পাননি। প্রাকৃতিক কারণে প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে গঙ্গার পানি কমে যায়, ফলে প্রাকৃতিক কারণেই পদ্মায়ও পানি কমছে।
৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনীতিক সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। এখনো সেটি স্বাভাবিক হয়নি। তবে আগের মতো অস্বস্তি নেই বলে দুই পক্ষ দাবি করেছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ভারত সফরে যাওয়ার আগে মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেছেন, এবারের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠকে ১১টি এজেন্ডা রয়েছে। কিন্তু সেখানে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়নের বিষয়টি নেই। কারণ এ বিষয়ে যৌথ নদী কমিশন আলাদা আলোচনা করবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছে। ওই কমিটির একটি সভাও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কমিটি জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তন মাথায় রেখে পরবর্তী চুক্তিটি করতে হবে। তিনি বলেন, পর্যালোচনা করার জন্য কমিটি একটি যৌথ টেকনিক্যাল কমিটি করার সুপারিশ করবে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতীয় পক্ষকে উভয় দেশের পানিসম্পদ সচিব পর্যায়ের বৈঠকে এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে জানানো হয়েছে। ভারতও জয়েন্ট টেকনিক্যাল কমিটি করার পক্ষে। আগামী তিন মাসের মধ্যে এ কমিটি গঠন করা হবে। এতে উভয় দেশ থেকে তিনজন করে সদস্য থাকবেন বলেন তিনি।
কি আছে চুক্তিতে ॥ ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি হয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এইচডি দেবগৌড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি করেন। এই চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে পর্যন্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ফারাক্কায় গঙ্গা নদীতে যে পানিপ্রবাহ তৈরি হয়, সেটি দুই দেশ ভাগ করে নেয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে, ফারাক্কায় গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে দুই দেশ সমান সমান, অর্থাৎ মোট পানির ৫০ শতাংশ করে পাবে। আর পানির পরিমাণ ৭০ হাজার কিউসেকের বেশি কিন্তু সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার কিউসেক পর্যন্ত হলে বাংলাদেশ পাবে সর্বোচ্চ ৩৬ হাজার কিউসেক, অবশিষ্ট পানি পাবে ভারত। কিন্তু ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানির পরিমাণ ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি হলে ভারত ৪০ হাজার কিউসেক রেখে বাকি পানি বাংলাদেশকে দিয়ে দেবে। এই পানি ভাগ হয় প্রতি ১০ দিনের পানির পরিমাণ হিসাব করে।
তবে চুক্তিতে শর্ত রয়েছে যে, ১১ মার্চ থেকে ১০ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশ ও ভারত ১০ দিন ১০ দিন করে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। অর্থাৎ ১১ মার্চ থেকে ২০ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে, তার পরের ১০ দিন ভারত গ্যারান্টিযুক্তভাবে ২৫ হাজার কিউসেক পানি পাবে। এভাবে ১০ মে পর্যন্ত চলতে থাকবে। এই সময়ে পানির প্রবাহ তুলনামূলকভাবে কম থাকে। সেজন্য উভয় দেশ প্রতি দশ দিনে গ্যারান্টিযুক্তভাবে ৩৫ হাজার কিউসেক পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে চুক্তিতে এই শর্ত রেখেছে।
যৌথ নদী কমিশন সূত্রমতে, এই চুক্তি করা হয়েছিল ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত গঙ্গা নদীর পানির গড় প্রবাহ ধরে। এই চুক্তি অনুযায়ী গত ২৮ বছর ধরে বাংলাদেশ-ভারত পানি ভাগ করে আসছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশ ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৮৭ কিউসেক পানি পেয়েছে। আর এ সময়ে ভারত পেয়েছে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৬৮ কিউসেক পানি। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরে এই চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। ২০২৪ সালে হাসিনার ভারত সফরের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জানিয়েছিলেন, গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি নবায়ন নিয়ে দুই দেশ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে পর্যালোচনায় রাজি হয়েছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৫৪টি অভিন্ন নদী রয়েছে। গঙ্গা ছাড়া আর কোনো নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি হয়নি। তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা হলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তিতে এ নিয়ে চুক্তি হয়নি।