ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১

আইনশৃঙ্খলার অবনতির পেছনে এসব অস্ত্র গোলাবারুদ

লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২২:১৯, ৫ ডিসেম্বর ২০২৪

লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে অভিযান জোরদার

.

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের সময়ে লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদের অনেকাংশই আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকারের চার মাস সময় অতিবাহিত হওয়ার পর এখনো উদ্ধার হয়নি ১ হাজার ৫৪৬টি অস্ত্র। আন্ডারওয়ার্ল্ডে চলে যাওয়া অস্ত্র দিয়ে খুন, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে শাহিদা ইসলাম নামের প্রেমিকাকে গুলি করে হত্যা করে মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গুলিবিদ্ধ লাশ ফেলেছিল তার প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়। এই ঘটনা উদ্ঘাটনের পর থানা-পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত চার মাসে সারাদেশে পাঁচ শতাধিক খুন হয়েছে। উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রের মধ্যে আছে এসএসএফের ৩২টি ভারি অস্ত্র। এসব অস্ত্রের সঙ্গে ২ লাখ ৬২ হাজার গোলাবারুদের হদিস মেলেনি। রাজধানী ঢাকায় থানা পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে ভয় দেখিয়ে ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা ধরনের অপরাধ হচ্ছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে। এ ছাড়া পূর্ব শত্রতা, ব্যক্তিগত বিরোধ ও আর্থিক লেনদেনকে কেন্দ্র করে খুনোখুনির ঘটনা বেড়েছে। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত রাজধানীতে বিভিন্ন অপরাধ ও ঘটনায় দুই শতাধিক লাশ উদ্ধার হয়। এর মধ্যে শতাধিক খুনের ঘটনা রয়েছে। আইনশৃঙ্খলার এমন পরিস্থিতির জন্য পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র গোলাবারুদকে দায়ী বলে ধারণা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
মুন্সীগঞ্জের পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার জানিয়েছেন, মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে শাহিদা ইসলাম নামের যেই তরুণীর গুলিবিদ্ধ লাশ ফেলে রাখা হয়েছিল তাকে রাজধানী ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে পুলিশের লুট হওয়া অস্ত্র দিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। বিয়ের জন্য চাপ দেওয়ায় প্রেমিকা শাহিদা ইসলামকে মুন্সীগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে এনে গুলি করে হত্যা করেন প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়। এই হত্যাকা-ে ব্যবহৃত অস্ত্রটি গত ৫ আগস্ট ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট হয়েছিল। পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেছেন, শাহিদা ইসলামকে হত্যার পর ভোলার মনপুরা দ্বীপে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তৌহিদ শেখ তন্ময়। ভোলার ইলিশায় একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে মুন্সীগঞ্জ জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তথ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে আসামির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে তিনি বলেছেন, উদ্ধারকৃত বিদেশী পিস্তলটি গত ৫ আগস্ট রাজধানীর ওয়ারী থানা থেকে লুট হয়েছিল। পরে তৌহিদ শেখ তন্ময়ের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ঢাকার দক্ষিণ কেরাণীগঞ্জের বটতলী বেইলি ব্রিজের নিচে পানি থেকে হত্যকা-ে ব্যবহৃত পিস্তল উদ্ধার করা হয়, যা রাজধানী ঢাকার ওয়ারী থানা থেকে লুট হয়েছিল।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, পুলিশ, বিভিন্ন থানা, কারাগার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে ৫ হাজার ৮২৯টি আগ্নেয়াস্ত্র এবং ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬০৯টি গুলি লুট হয়। এর মধ্যে ৪ হাজার ২৮৩টি অস্ত্র এবং ৩ লাখ ৮৮ হাজার ১৮২টি গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ১ হাজার ৫৪৬টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। এ ছাড়া গত ৪ সেপ্টেম্বর থেকে গতকাল পর্যন্ত যৌথ বাহিনী ৩৮৯টি অস্ত্র উদ্ধার করেছে। তবে এই অস্ত্রগুলোর মধ্যে এসএসএফের লুট হওয়া অস্ত্র রয়েছে কি না তা কেউ নিশ্চিত করতে পারেননি। গণভবনের দায়িত্বে থাকা এসএসএফ সদস্যদের বিভিন্ন ধরনের ট্যাক্টিক্যাল গিয়ার, অস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজসরঞ্জাম, বেতার যোগাযোগ ও অপারেশনাল সরঞ্জামাদির মজুত ছিল। এছাড়া জাতীয় সংসদ ভবনেও এসএসএফের অস্ত্র গোলাবারুদ মজুত ছিল। গত ৫ আগস্ট জনতা গণভবন ও জাতীয় সংসদ ভবনে প্রবেশ করার পর ওই সব অস্ত্রশস্ত্র লুট হয়ে যায়। লুট হওয়া অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে অত্যাধুনিক অ্যাসল্ট রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল, ফ্ল্যাশব্যাং গ্রেনেড, অ্যান্টি- ড্রোন সিস্টেম, বেতার যোগাযোগের ডিভাইস ও বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদসহ ৩২টি ভারি অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) এনামুল হক সাগর গণমাধ্যমে বলেছেন, লুট হওয়া অস্ত্রের মধ্যে ৭৫ ভাগ অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। ৬০ ভাগ উদ্ধার হয়েছে গোলাবারুদ। গত ১৮ অক্টোবর থেকে যৌথ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যৌথ বাহিনীর অভিযানে লুট হওয়া অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। গোটা রাজধানীতে স্থায়ী চেকপোস্টের পাশাপাশি শতাধিক অস্থায়ী চেকপোস্ট স্থাপন করে রাতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। পুলিশের নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতাবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত আছে।
গোয়েন্দা সংস্থার সূত্র জানান, গোয়েন্দাদের ধারণা যেসব অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি, তার একটি বড় অংশ সারা দেশের আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতে চলে গেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, পল্লবী, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, কলাবাগান, হাজারীবাগ, ঢাকা উদ্যান, বছিলা, আদাবর ও লালবাগ এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী গ্রুপের কাছে হাত বদলের মাধ্যমে এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ চলে গেছে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে ইসরাইলের  তৈরি উজি পিস্তলও দেখা গেছে।
র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনিম ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্লক রেইড দিচ্ছি। র‌্যাবের অভিযানে দাগী আসামি, মাদক ব্যবসায়ী, অস্ত্র ব্যবসায়ী গ্রেপ্তার হচ্ছে। অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারাভিযান অব্যাহত আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি নিকটস্থ থানায় জমা দেওয়ার জন্য সরকারের বারবার আহ্বান জানালেও এখনো অনেক অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। অন্তর্বর্তীকালীন সমরকারের নির্দেশে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারে  দেশব্যাপী যৌথ অভিযান পরিচালিত হচ্ছে এই যৌথ অভিযানে অংশ নেবে সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, পুলিশ, র‌্যাব ও আনসার সদস্যরা। গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর বিক্ষুব্ধ জনতা দেশের বিভিন্ন থানা ও প্রতিষ্ঠান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও গুলি লুট করে।
গত ১২ আগস্ট থেকে পুলিশ সদর দপ্তর একাধিকবার অস্ত্র ও গুলি জমা দেওয়ার আহ্বান জানায় এবং এগুলো জমা দেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পুলিশের কম জনবল ও মনোবল ভেঙে যাওয়ার  কারণে এসব অস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না। সারাদেশে ভয়ংকর অপরাধের হার দ্রুত বাড়ছে, যা আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজধানী ঢাকায় প্রায়ই ছিনতাই, খুন, চুরি ও ডাকাতির মতো অপরাধ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অদৃশ্য আতঙ্কও ঘনীভূত হচ্ছে। রাজধানীতে প্রতিদিনই ছিনতাইয়ের হাজারও ঘটনা ঘটছে, কিন্তু হতভাগ্য ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ সময়ই থানায় অভিযোগ পর্যন্ত করেন না। এই পরিস্থিতি জানিয়ে দেয়, একদিকে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে পুলিশি পরিসংখ্যানেও সেগুলো ঠিকভাবে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। তবে পুলিশের নিয়মিত অভিযানের পাশাপাশি যৌথ বাহিনীর অভিযান অব্যাহত রয়েছে। খুব শীঘ্রই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতাবস্থায় ফিরে আসবে বলে পুলিশ কর্মকর্তা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।

 

×