
আসাদুজ্জামান খান কামাল
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, একটি সন্ত্রাসী দল যারা স্বাধীনতাবিরোধী তারা শুধু নরসিংদীই নয়, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা করেছে। এমন জায়গাগুলোতে তারা আক্রমণ করেছে যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি মঙ্গলবার দুপুরে নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, সন্ত্রাসীরা সেতু ভবন পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছে। সেখানে পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ের ডেটা রিজার্ভ ছিল। তারা ত্রাণ অধিদপ্তরের ভবনটিও পুড়িয়ে দিয়েছে। যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ ও ইন্টারনেটের বিভিন্ন অফিস ছিল। সেখানে আগুন দেওয়ায় সারাদেশে ইন্টারনেট বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিটিভি ভবনÑস্বাধীনতার আগে থেকে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যকে ধারণ করেছিল। সেখানে আর্কাইভ, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষিত আছে। সেই আর্কাইভগুলো তারা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশনে তারা আক্রমণ করেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষগুলোতে তারা আগুন দিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, তারা নরসিংদী কারাগার ভাঙচুর করেছে, আগুন দিয়েছে, অস্ত্রাগার লুট করেছে।
আমাদের পুলিশ বাহিনী অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দীর্ঘদিন চেষ্টা করে যে ৯ জঙ্গিকে আটক করেছিল তাদেরও তারা মুক্ত করে নিয়ে গেছে। এটা পরিষ্কার, এটা দেশকে একটা বিপর্যস্ত পর্যায়ে নেওয়ার জন্য, এগিয়ে যাওয়া দেশকে বাধাগ্রস্ত করতে এই তা-ব চালানো হয়েছে। আমরা এসব কার্যকলাপের নিন্দা জানাই। যারা কাজগুলো করেছে তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করে আমরা আইনে সোপর্দ করব। তাদের বিরুদ্ধে যা যা করা দরকার সবকিছুই করব।
আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, যতটুকু খবর পেয়েছি এখানে ৮২৬ জন কারাবন্দি অবস্থান করছিল। দুই নারীসহ ৯ জন জঙ্গি ছিল। ওরা যে কতটা ভয়ংর সেটা হয়তো অনেকেই জানেন না। আমরা যারা এগুলো দেখেছি তারা জানি ওরা কত ভয়ংর। তারা সেই জঙ্গিদের নিয়ে পালিয়েছে। উদ্দেশ্য দেশ অচল করে দেওয়া। তিনি বলেন, আমরা মনে করি, দেশের মানুষ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আমরা তাদের শীঘ্রই আইনের আওতায় আনব।
তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় কারও গাফিলতি আছে কি না তা খতিয়ে দেখার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যবিশিষ্ট এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র সচিবকে প্রধান করে ছয় সদস্যের আরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ১০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা তদন্ত করবে এ ঘটনায় কোনো কারারক্ষীর গাফিলতি ছিল কি না। প্রয়োজনে তাদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামাল বলেন, যে ৮৫ অস্ত্র লুট করা হয়েছিল তার মধ্যে ৩৩টি উদ্ধার করা হয়েছে। পলাতক আসামিদের মধ্যে ১২৯ জন আত্মসমর্পণ করেছে। আমরা এসব ঘটনায় বাধ্য হয়ে কার্ফু জারি করেছি। এতে আপনাদের অসুবিধা হচ্ছে। ধৈর্য ধরুন। আমরা অবশ্যই এই দুষ্কৃতকারীদের, রাষ্ট্রদোহীদের, যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তাদের শনাক্ত করে শাস্তির ব্যবস্থা করব।
তিনি বলেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কার্ফু প্রত্যাহার করা হবে। আমাদের চিরুনি অভিযান চলছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড, আনসার ও দেশের জনগণ সবাই মিলে সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করব।
এ সময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন নরসিংদী সদর আসনের এমপি লে. কর্নেল (অব.) মো. নজরুল ইসলাম, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব জাহাঙ্গীর আলম এবং একই মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের সচিব মশিউর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি (হাইওয়ে) শাহাবুদ্দিন খান, ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিআইজি প্রিজন আলতাব হোসেন, নরসিংদী জেলা প্রশাসক ড. বদিউল আলম, নরসিংদী পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।
এর আগে কোটা আন্দোলকারীদের মুখোশে লুণ্ঠিত নরসিংদী জেলা কারাগার পরিদর্শন করেন পুলিশ প্রধান চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সোমবার কারাগারের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। পুলিশ প্রধান উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, আপনারা দেখেছেন জেলখানায় কেমন নারকীয় ও জঘণ্য আক্রমণ ঘটনানো হয়েছে। সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্যে তিনি সাফ জানান, অপরাধি চক্র, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের প্রতিহত করার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত।
আইজি বলেন, পরিকল্পতভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য একটি মহল বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য কারাগারে আক্রমণ চালিয়েছে। তিনি বলেন, যারা আক্রমণ চালিয়েছে তারা জেলখানার গেট ভেঙে ফেলেছে, অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছে, আসামিদের ছেড়ে দিয়েছে। তাদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে। এ ঘটনা বিরল। এ ঘটনা উপ-মহাদেশের কোথাও ঘটেছে কিনা-তাও আমাদের জানা নেই। আপনারা লক্ষ্য করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে তারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো এবং দেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছে।
জঙ্গিরা যাতে ছাড়া পায়, অপরাধীরা যাতে ছাড়া পায়, দেশে যাতে একটা অস্থিতিশল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এ জন্যই আক্রমণ চালানো হয়েছে। যারা এই আক্রমণ চালিয়েছে তাদের একজন একজন করে খুঁজে বের করা হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হবে। আক্রমণকারীদের হাত থেকে সাংবাদিকরাও রক্ষা পাননি। যারা সংবাদ সংগ্রহের জন্য সেদিন রাস্তায় নেমেছিলেন তাদেরও রেহাই দেওয়া হয়নি। এমনকি সাংবাদিকদের হত্যা করতেও তারা পিছপা হয়নি।
তিনি আরও বলেন, সেদিন লুট হওয়া অস্ত্রসহ অপরাধীদের ধরিয়ে দিতে পারলে তাদের জন্য রয়েছে বিশেষ পুরস্কার। শুধু অস্ত্র উদ্ধার করে দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। তিনি বলেন, আমরা চাই এ ঘটনায় যারা জড়িত, যে কোনো তথ্য প্রকাশে বা গোপনে পুলিশ সুপার বা তার টিমের কাছে খবর পৌছে দিলে তাদেরও পুরষ্কার দেওয়া হবে। তাদের পরিচয় গোপন রাখা হবে। এ জন্য সহযোগিতার জন্য দেশবাসীকে এগিয়ে আসার আহবান জানান তিনি।
চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, লুট হওয়া প্রতি অস্ত্র উদ্ধারের জন্য ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে আসামিদের আর্তস্মর্পনের জন্য মাইকিং করা হচ্ছে। তাতেও আসামীরা সাড়া না দিলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পুলিশ প্রধান বলেন, এককালে বাংলাভাই ও জঙ্গি শায়খ আব্দুর রহমানদের উস্কে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর ওপর তারা আক্রমণ করেছিল। আপনারা জানেন-বাংলাদেশকে কারা ব্যর্থ ও জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা করেছিল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলকে তারা অপরাধের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সরকারবিরোধী চক্র ফের দেশকে পেছনে ঠেলে দিতে চায়। এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছেন। আবারও তারা প্রয়োজনে এদের রুখে দিতে সবাই একত্রিত হচ্ছেন। আপনারা সবাই মিলে আমাদের সহযোগিতা করুন। অপরাধি চক্র, সন্ত্রাসী জঙ্গি তাদের প্রতিহত করার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত।
উল্লেখ্য, নজিরবিহীন হামলার পর সব বন্দি পালিয়ে যাওয়া ও অসত্রাগার লুটের পর নরসিংদী কারাগার এখন পরিত্যক্ত ও জনমানবশূন্য। কয়েক মিনিটের আকস্মিক এই হামলায় গোটা দেশের কারাগারগুলোতে আতঙ্ক ছড়ায়। শুক্রবার কোটা আন্দোলনকারীদের সুযোগে এলাকার চিহ্নিত দুর্র্বৃত্তরা পরিকল্পনা মোতাবেক সুযোগ বুঝে হামলা চালিয়ে সমস্ত বন্দিকে নিয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় নরসিংদী কারা জেল সুপার ও জেলারের দায়িত্ব পালনে চরম উদাসীনতা, অবহেলা ও গাফিলতির চিত্র ফুটে ওঠে বলে জানিয়েছন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের ভাষ্য হচ্ছে- কারা কর্তৃপক্ষ একটু সতর্কমূলক ব্যবস্থা নিলেই এ ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। গোটা কারাগারে ভুতুড়ে পরিবেশ নেমে এসেছে। একদিন আগেও কোলাহলপূর্ণ কারাগারটির বর্তমান চিত্র দেখতে এখন কৌতহূলী মানুষ দূর থেকে উঁকি দিচেছ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যারা উপস্থিত ছিলেন, তাদের কাছে মনে হয়েছে, কারা রক্ষীরা অনায়াসেই তাদের ঢুকতে দিয়েছে। প্রশ্ন ওঠেছে- কেন কারাকর্তৃপক্ষ কোনো ধরনের আগাম নিরাপত্তা প্রস্তুতি ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এ কারাগারের নিজস্ব নিরাপত্তা বলতে একটি অস্ত্রাগার, প্রশিক্ষিত ও দক্ষ নিরাপত্তা কর্মী ছিল। কোন ধরণের হামলা ও আক্রমণের আশংকা দেখা দিলে নিজস্ব অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুধ বের করে নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে রেখে বিশেষ সাইরেন বাজিয়ে সবাইকে সজাগ ও সতর্কাবস্থায় রাখার বিধান রেওয়াজ ও বিধান রয়েছে।
কিন্তুু নরসিংদী কারাগারে শুক্রবার এমন কোন প্রস্তুতি বা সতর্কতা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে দুর্বৃত্তরা গেটের সামনে জড়ো হয়ে সমাবেশের মতো করে হামলার ঘোষণা দেওয়ার পর একজন কারারক্ষী ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে আরও ভেতরে চলে যান। তার পর ওরা ঢুকে তা-বলীলা চালায়। কারাগারের সাবেক একজন কর্মকর্তা বলেন, কোটা বিরোধী আন্দোলনকে পুঁজি করে ঢাকাসহ দেশব্যাপী দুর্বৃত্তরা যেভাবে সরকারি প্রতিষ্টানে হামলা ,অগ্নিসংযোগ ভাংচুর ও লুটপাট করেছে- সেটা দেখেও তো নরসিংদী কারা কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা জোরদার করতে পারতো। নিজস্ব অস্ত্রাগার যাতে তাৎক্ষণিক ব্যবহার করা যায়, সেভাবেই দক্ষ কারারক্ষীকে দায়িত্বভার দেওয়া উচিত ছিল।
বিকালে যখন দুর্র্বৃত্তরা গেটে হামলা চালায় তখন কারাকর্তৃপক্ষ নিজস্ব অস্ত্রাগার থেকে রসদ দিয়ে ফাকা গুলি জড়ো হওয়া দুর্বৃত্তদের ছত্রভঙ্গ করতে পারত। এমন পরিস্থিতিতে বাহির থেকে পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার নিরাপত্তাকর্মীরা সেখানে হাজির হয়ে দুর্বৃত্তদের নিবৃত্ত করার যথেষ্ট সুযোগ থাকে। কিন্তু নরসিংদী কারাগারে এ ধরনের সময়োচিত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জেল সুপার আবুল কালাম আজাদ উল্টো হামলাকারীদের ভয়ে কারাগারের ভেতরেই ঘাপটি মেরে থাকে। জেল সূত্র জানায় , দৃর্বৃত্তরা প্রথমে কারা সীমানায় স্টাফ কোয়ার্টারে হামলা ও লুটপাট চালায়।
তার পর মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকে প্রথমেই হানা দেয় অস্ত্রাগারে। ভেতরে থাকা কজন বন্দি দুর্বৃত্তদের এমনভাবে রেকি করে অস্ত্রাগারে নিয়ে গিয়েছে যেন তাদের সঙ্গে আগে থেকেই কোনো ধরনের যোগাযোগ ছিল। হামলার ধরন দেখে এটাকে পেশাদার জঙ্গিদের পরিকল্পিত কর্মকা-ের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।