ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

প্রতিকার মেলে না ॥ ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় মৃত্যু

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

প্রতিকার মেলে না ॥ ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় মৃত্যু

ভুল চিকিৎসা ও অবহেলায় মৃত্যু

মৃত মায়ের পেট থেকে জীবিত সন্তান বের করে আবারও মায়ের পেটে নবজাতককে রেখে সেলাই করে দিয়েছেন চিকিৎসক। এটি কোনো হরর সিনেমার দৃশ্য নয়। বরগুনার বামনা এলাকার এক সন্তানসম্ভবা নারীর ক্ষেত্রে এ ঘটনা ঘটে গত ১৫ জানুয়ারি। ওই নারীর প্রসব বেদনা উঠলে দিশাহারা পরিবার তাকে ৪ নম্বর ডৌয়াতলা ইউনিয়নের সুন্দরবন ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি করেন। তখন কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, অপারেশন বাবদ ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।

পরিবার তাতে রাজি হয়ে অগ্রিম ১০ হাজার টাকা দিলে রাত সাড়ে ৮টায় গর্ভবতী মাকে চিকিৎসকরা নেন অপারেশন থিয়েটারে। কর্তব্যরত ডাক্তার সবুজ কুমার দাশ অন্যদের নিয়ে শুরু করেন অস্ত্রোপচার। কিন্তু দীর্ঘ সময় পার হলেও অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষমাণ নারীর পরিবারের সদস্যদের কোনো কিছু জানানো হচ্ছিল না। এতে সন্দেহ তৈরি হয়। এরপর তারা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে অপারেশন থিয়েটার খোলার জন্য বললেও দরজা বন্ধ করে রাখে দায়িত্বরত কর্মীরা। এভাবে দীর্ঘ আড়াই ঘণ্টা চলে যায়। চিকিৎসক নারীর পেট থেকে অপারেশন করে জীবিত বাচ্চাকে বের করে আনেন।

কিন্তু ততক্ষণে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন সেই নারী। ঘটনার আকস্মিকতায় ঘাবড়ে যান চিকিৎসক। উপায়ান্তর না থেকে মৃত নারীর পেটে আবারও জীবন্ত শিশুকে রেখে বাইরে থেকে সেলাই করে দেন সেই ডা. সবুজ কুমার দাস। শেষে থিয়েটার থেকে বের হয়ে রোগীর স্বজনদের জানান, রোগীর হার্টবিট বেড়ে গেছে। তাকে দ্রুত বরিশাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে আদতে মা-সন্তানের কেউই আর জীবিত নেই। 
এর আগে গত বছরের মাঝামাঝিতে সারাদেশে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল সেন্ট্রাল হাসপাতালের চিকিৎসকদের ভুল চিকিৎসায় সন্তানসম্ভবা মাহবুবা রহমান আঁখির মৃত্যু নিয়ে। এরপর মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে চলতি বছর আবারও সমালোচনার ঝড় ওঠে ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় শিশু আয়ানের মৃত্যুতেও। সুন্নতে খতনা করাতে আসা শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘটনা পর্যালোচনা করে খোদ আদালত পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়েছেন, এত ওষুধ কারও বাইপাস সার্জারিতেও লাগে না।

আঁখি বা শিশু আয়ানের মতো পরপর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর কয়েকটি ঘটনা সমালোচিত হলেও বেশিরভাগ ভুল চিকিৎসায় মৃতদের স্বজনরাই নীরবে ফেলেন চোখের পানি। শুধু লাইসেন্স বাতিল করা ছাড়া অভিযুক্ত চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যবস্থায় নেওয়ার এখতিয়ার থাকে না বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের। ফৌজদারি মামলা হলে দীর্ঘসূত্রতার ফলে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় দিন কাটে স্বজনদের।

দোষী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিএমডিসিকে আরও ক্ষমতায়নের পাশাপাশি রোগীদের সুষ্ঠু আইনের তদারকি বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে কোনো চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর গাফিলতিতে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। প্রয়োজনে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে পরিবর্তন আনা যায় কি না তা বিবেচনা করার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। 
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনা করাতে শিশু আয়ানকে রাজধানীর সাতারকুল বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন বাবা শামীম আহমেদ। সেখানে তাকে অস্ত্রোপচার আগে চেতনা নাশক (অ্যানেসথেসিয়া) দেওয়া হয় এবং এরপর তার জ্ঞান ফেরেনি। টানা ৭ দিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর ৮ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১২টায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে মৃত ঘোষণা করে। এরপর পরই শুরু হয় সমালোচনার ঝড়।

ভুল চিকিৎসায় তার মৃত্যুর প্রতিবাদে ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করে বিভিন্ন সংগঠন। এ ঘটনার তীব্র সমালোচনা করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক নাজমুল হাসান বলেন, বরাবরই ভুল চিকিৎসায় একেক জন রোগীর মৃত্যু হয় আর চিকিৎসকরা পার পেয়ে যান। কোনো কঠিন শাস্তি তো দূরে থাক ন্যূনতম আর্থিক জরিমানাও তাদের কাছ থেকে আদায় করা যায় না। তাই আমরা শিশু আয়ানের মৃত্যুতে তার পরিবারকে যেন যথাযথ আর্থিক জরিমানাসহ চিকিৎসায় জড়িত ডাক্তারদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, শিশু আয়ানের সুন্নতে খতনায় যেন কষ্ট না হয় সেজন্য দেশের নাম করা একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর সুন্নতে খতনা করানোর আগে তার বেশ কিছু শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানো হয়েছিল। তখন তার কোনো ধরনের সমস্যা ছিল না। ডাক্তার তার রিপোর্ট দেখে বলেছিল, আয়ানের শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক। শিশু আয়ান তখন হেঁটে হাস্যোজ্জ্বল অবস্থায় অপারেশন থিয়েটারে ঢোকে।

আয়ানকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার পর ডা. সাব্বির তাকে অতিমাত্রায় অ্যানেসথেসিয়া প্রদান করে। ডাক্তার সাব্বির ১৯ বছরের অভিজ্ঞ অ্যানেসথেসিয়ান। এরপর সার্জারি ডাক্তার তাসনুভা মেহজাবিনসহ কয়েকজন ইন্টার্ন ডাক্তারকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্লাস করানো হয়। যার ফলে শিশু আয়ানের মৃত্যু হয়। এই ডাক্তারদের মানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র মায়া নেই।  
অভিযোগ ওঠে মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেয়ার জন্যই ৭ জানুয়ারি রাত ১২টায় শিশু আয়ানের মৃত্যুর ঘোষণা করা হয়। এরপর ডাক্তাররা শিশু আয়ানকে তড়িঘড়ি করে ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠায়। তারা চেয়েছিল অন্যসব ঘটনার মতন এই ঘটনা যেন ধামাচাপা পড়ে যায়। এজন্যই ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন শিশু আয়ানের মৃত্যুর খবর তারা ঘোষণা করে। যাতে করে নির্বাচনের কারণে এই খবরটা ধামাচাপা পড়ে যায়।
এর ৬ মাস আগে ঠিক একইভাবে চিকিৎসকের ভুলে রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালে প্রাণ যায় মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতকের। সন্তানপ্রত্যাশী মাহবুবা রহমান আঁখির প্রসব ব্যথা ওঠার পর পরই শরণাপন্ন হন রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের গাইনি চিকিৎসক ডা. সংযুক্তা সাহার। কিন্তু সময়মতো হাসপাতালে পৌঁছালেও কিছু দায়িত্বজ্ঞানহীন চিকিৎসকের অবহেলা আর ভুল চিকিৎসায় গত বছরের ১৮ জুন করুণ মৃত্যু বরণ করতে হয় আঁখিকে।

চিকিৎসকরা বাঁচাতে পারেননি তার নবজাতককেও। টানা ৯ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যু হয় আঁখির। স্বাভাবিকভাবে প্রসব করতে ব্যর্থ হয়ে চিকিৎসকরা সিজার করে সন্তানের প্রসব করালেও পুরো প্রক্রিয়া আঁখির জরায়ু, পায়ুপথ এমনভাবে ক্ষত হয় যে অত্যাধিক রক্তক্ষরণসহ শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ইডেন কলেজের শিক্ষার্থী ও কুমিল্লার দাউদকান্দির তিতাস থানার স্কুলশিক্ষক ইয়াকুব আলী সুমনের স্ত্রী আঁখি।

ভুল চিকিৎসা এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের প্রতারণার বলি হয়ে আঁখির নবজাতকটি পৃথিবীর আলো ভালো করে দেখার আগেই গত ১০ জুন মারা যায়। শুধু চিকিৎসকদের অবহেলা আর ভুল চিকিৎসায়ই আঁখি এবং তার নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে দাবি করে হাসপাতালটি বন্ধের দাবি জানায় তার স্বজন ও সহপাঠীরা। সেই সঙ্গে দোষী চিকিৎসকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানালেও তা দাবি আকারেই রয়ে যায়। কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হলেও চিকিৎসকদের প্রতিবাদের মুখে ছেড়ে দেওয়া হয় তাদের। ফলে শেষ পর্যন্ত কাউকেই উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা যায়নি।

এর ঠিক একদিন পরেই অর্থাৎ ১৯ জুন রাজধানীর ল্যাব এইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভুল চিকিৎসায় প্রাণ হারান হাসিনা নামের এক নারী। আঁখির মৃত্যু যেমন অত্যাধিক রক্তক্ষরণে হয়েছিল হাসিনা বেগমেরও তাই। কিন্তু তার মৃত্যুর বীভৎসতায় আঁতকে উঠতে হবে যে কোনো মানুষকে। টিউমারের অপারেশন করতে এসে শুধু চিকিৎসকের ভুল অপারেশনে হাসিনা বেগমের শরীরের এমন কোনো স্থান নেই যেখান থেকে রক্ত বের হচ্ছিল না মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

অপারেশনের পর থেকে (গত মাসের ১৮ মে) মৃত্যুর আগ (১৭ জুন) পর্যন্ত ১৩০ ব্যাগ রক্ত দিতে হয় তার শরীরে। তবুও প্রাণ বাঁচাতে পারেননি তার পরিবারের লোকজন। হাসিনা বেগমের স্বজনরা জানান, পাকস্থলীতে টিউমার অপারেশন করতে হাসিনা বেগমকে গত ১৭ মে ল্যাব এইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারে ভর্তি করা হয়। সেখানে ডা. আখতার আহমেদ শুভর তত্ত্বাবধানে তাকে ভর্তি করা হয়। তবে ওই চিকিৎসক নিজে রোগীকে দেখেননি। আগের করা পরীক্ষার রিপোর্ট  দেখে ১৮ মে হাসিনা বেগমকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে টিউমার অপসারণের ব্যবস্থা করেন।

অপারেশনের দুদিন না যেতেই রোগীর কাটা জায়গা থেকে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। এজন্য তাকে ১৩০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়। এতেও রোগীর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হওয়ায় ২৯ মে রোগীর দ্বিতীয় অপারেশন করেন ডা. আখতার আহমেদ শুভ। তবে হাসিনা বেগমের অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। এ অবস্থায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে রোগীকে রিলিজ করতে বলা হয়। স্বজনরা রাজি না হওয়ায় ওই চিকিৎসক নিজেই কেবিন ব্যবস্থা করে হাসিনা বেগমকে মুমূর্ষু অবস্থায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। সেখানে ১৭ জুন ভোরে তার মৃত্যু হয়।
আঁখি এবং হাসিনা বেগমের মৃত্যুর দুদিন পরই রাজধানীর শ্যামলীর ইবনে সিনা হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ আসে। গৃহিণী পূরবী ঘোষ নিজ ঘরে বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা মচকে আসেন হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিতে। পা ফেটে গিয়েছে জানিয়ে চিকিৎসক তাকে নিয়ে যায় অপারেশন থিয়েটারে। কিন্তু সেই অপারেশন থিয়েটার থেকে আর জীবিত ফিরে আসেননি তিনি। চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ করে মৃতের ছেলে সৌমিত্র ঘোষ ইমন বলেন, গত বছরের ১০ জুন বাসার বাথরুমে পড়ে গিয়ে আমার মায়ের পায়ে একাধিক ফাটল দেখা দেয়।

এরপর ১৩ জুন কল্যাণপুরের ইবনে সিনা হাসপাতালে মায়ের পায়ে অপারেশন হয়। অপারেশনের একদিন পর থেকে তিনি নিস্তেজ হয়ে পড়ছিলেন। ভালোভাবে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এমনকি আগেরদিন যখন তার অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছিল তখন ডিউটিরত চিকিৎসকরা আমাদের নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছিলেন। বারবার বলার পরও তারা গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না। বুধবার সকালে হাসপাতালে আমার মায়ের মৃত্যু হয়। ইমন বলেন, মায়ের অপারেশন করেছিলেন ডা. শাহিদুর রহমান।

তিনি হাসপাতালে অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক। অবস্থার অবনতি হলে ডা. শাহিদুর রহমান মাকে রেফার করেন মেডিসিন বিভাগে। সেখানে চিকিৎসকরা অবস্থার অবনতির বিষয়টি বুঝতে পেরে নিউরোসায়েন্স বিভাগে পাঠান। এরপর কোনো রকম চিকিৎসা না দিয়ে নাকে নল লাগিয়ে ফেলে রাখা হয়। 
শিশু আয়ান, আঁখি, হাসিনা, পূরবী একের পর এক ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুতে যখন চলছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সমালোচনা তখন এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে কোনো রোগীর মৃত্যু হলে অভিযুক্ত চিকিৎসক বা হাসপাতালের রেজিস্ট্রেশন বাতিলের চাইতে বেশি কোনো শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা বিদ্যমান বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) আইনে নেই। তবে মামলা হলে কোর্টের ওপর নির্ভর করবে শাস্তির বিষয়টি।

এক্ষেত্রে আইনের পরিবর্তন প্রয়োজন জানিয়ে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) এর সভাপতি ডা. জামাল উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে রোগী মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশেই নয়, পুরো বিশ্বেই হয়। উন্নত দেশগুলোতে এ সংখ্যা আরও বেশি। তবে তাদের আইনও রয়েছে শক্ত। আমাদের আমাদের এখানে চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল বা সাময়িক স্থগিত করা ছাড়া তেমন কোনো সুযোগ থাকে না।

ডা. সংযুক্তা সাহার রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ ২০১০ সালেই শেষ হয়েছে বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। প্রতি পাঁচ বছর পরপর আমাদের চিকিৎসকদের রেজিস্ট্রেশন নবায়ন করতে হয়। এখন কেউ যদি অবহেলায় এটি নবায়ন না করে তাহলে তার দায়ভার বা সাজা তো তাকে পেতেই হবে। কিন্তু বিদ্যমান আইনে খুব কঠিন কোনো সাজা দেওয়ার সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে আইনের পরিবর্ধন প্রয়োজন। তবে মনে রাখতে হবে চিকিৎসকও মানুষ। আর সব মানুষেরই ভুল হয়।

এক্ষেত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুললেই হবে না। বিনা চিকিৎসা বা ভুল চিকিৎসায় যেমন একটি রোগীর মৃত্যুও আমাদের কাম্য না তেমনি বিনাদোষে কেউ সাজা পাবে তাও আমরা চাই না। 
তবে নিবন্ধন ছাড়া কোনো চিকিৎসক যদি চিকিৎসাসেবা দেন তাহলে তা সম্পূর্ণ অনৈতিক জানিয়ে বিএমডিসির রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) ডা. মো. লিয়াকত হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের আইন মোতাবেক নিবন্ধন ছাড়া কেউ যদি একদিনও চিকিৎসাসেবা দেন, তাহলে সেটি হবে অনৈতিক এবং সম্পূর্ণ বেআইনি। আমরা প্রতি বছরই ফিজিশিয়ানস ও রেজিস্টার্ড চিকিৎসক যারা আছেন, আমাদের আইটি বিভাগের মাধ্যমে প্রত্যেককেই নিবন্ধন করার জন্য একটি এসএমএস পাঠাই। যখন আমরা এসএমএস দিই, তখন দেখা যায় কিছুদিন নিবন্ধনের চাপ থাকে। যাদের নিবন্ধনের মেয়াদ শেষ হয়েছে, তারা এসে নিবন্ধন নবায়ন করে নিয়ে যান।
লিয়াকত হোসেন বলেন, আমি যখনই চিকিৎসকদের বিভিন্ন সমাবেশ, সেমিনারে যাই তখনই তাদের নিবন্ধনের  খোঁজখবর নিয়ে থাকি। কারও যদি নিবন্ধন না থাকে, তাহলে তাদের কী বিপদ হতে পারে সেগুলো বুঝানোর চেষ্টা করি। সবমিলিয়ে আমাদের প্রচেষ্টা থাকে নিবন্ধন রিনিউ করার প্রবণতা এখন আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। চিকিৎসকদের মধ্যে এখন অনেক সচেতনতা তৈরি হয়েছে।
ভুল-ভ্রান্তি মিলিয়েই মানুষ উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা সম্প্রতি কয়েকটি ঘটনা দেখছি যে রোগীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা অভিযোগ করছেন তাদের ভুল চিকিৎসায় মৃত্যু হয়েছে। এক্ষেত্রে হাসপাতাল বন্ধেরও দাবি উঠেছে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির ভুলের জন্য পুরো হাসপাতাল বন্ধের কোনো যুক্তিকতা নেই। হাসপাতালে কত শত রোগী প্রতিদিন আসে।

হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেলে চিকিৎসা নিতে তারা কোথায় যাবে? এক্ষেত্রে যদি কারো ভুল থাকে তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে নির্দিষ্ট করে তাকেই সাজার আওতায় আনা যেতে পারে। হাসপাতালেরও যদি গাফিলতি থাকে তাহলে হাসপাতালের বিরুদ্ধেও তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তবে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর এসব অভিযোগে এখনই কোনো স্পষ্ট কিছু না বলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনে বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, শিশু আয়ানের মৃত্যুর বিষয়ে একটি মামলা হাইকোর্টে চলমান রয়েছে। তাই এ নিয়ে মন্তব্য করছি না। তবে অন্যান্য অভিযোগে সত্যি কোনো চিকিৎসকের গাফিলতি থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক্ষেত্রে লাইসেন্স বাতিল ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইন হচ্ছে। সেহেতু এ ব্যাপারে পরিবর্তন আনা যায় কি না আমি নিশ্চয়ই দেখবো।

×