ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

তিন বছর পর পর আয়োজনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কাউন্সিল হয় না সাত বছরের বেশি

ঝুঁকিতে বিএনপি নিবন্ধন হারানোর

শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০১:৩০, ৯ ডিসেম্বর ২০২৩

ঝুঁকিতে বিএনপি নিবন্ধন হারানোর

.

সোয়া সাত বছর ধরে জাতীয় কাউন্সিল করছে না বিএনপিগণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর তিন বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বিএনপি তার তোয়াক্কা করছে নাকরোনাকালে কাউন্সিলের জন্য সময় বৃদ্ধির আবেদন করলেও এখন দলটি নিবন্ধন ঝুঁকিতে থাকার পরও আন্দোলন ছাড়া তারা আর কিছু ভাবছে নাতাই ইসি যে কোনো সময় বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে

এদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে না আসায়ও বিএনপি কিছুটা নির্বাচন ঝুঁকিতেকারণ, কোনো কারণে আর একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেই আরপিও অনুসারে দলটির নিবন্ধন বাতিল হয়ে যাবেএ ছাড়া বিএনপির আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে যেভাবে নাশকতা হচ্ছে তার দায়ভার তাদেরই নিতে হচ্ছেএর আগে বিএনপির ডাকে ২০১৩ সালে টানা বেশ কদিন এবং ২০১৫ সালে লাগাতার ৯৩ দিন হরতাল ও অবরোধকর্মসূচি পালনকালে পেট্রোলবোমা নিক্ষেপসহ বিভিন্নভাবে জ্বালাওপোড়াও করায় জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়এসব নাশকতামূলক কর্মকান্ডসহ বিএনপির বিরুদ্ধে দেশবিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ডের অভিযোগ সরকার ও বিভিন্ন মহল থেকে করা হয়েছেতাই সরকার কোনো গ্রাউন্ডে বিএনপিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত করলে আরপিওর ১১ (খ) ধারা অনুসারে নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করতে পারবে

এ ছাড়া আরপিওর ১১ (গ) অনুসারে নির্বাচন কমিশনে প্রেরিতব্য কোনো তথ্য রাজনৈতিক দলগুলো পর পর ৩ বছর প্রেরণ করতে ব্যর্থ হলে নিবন্ধন বাতিল হয়নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, এ ক্ষেত্রেও বিএনপির ঝুঁকি রয়েছেকারণ, দলটি সব তথ্য ইসিতে নিয়মিত প্রেরণ করে নাআরপিওর ১১ (ঙ) পর পর দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হয়বিএনপি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলতবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না এর পরের নির্বাচনে অংশ না নিলে তাদের নিবন্ধন বাতিল হবেএ ক্ষেত্রেও বিএনপি কিছুটা ঝুঁকিতে আছেকোনো কারণে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপির নিবন্ধন বাতিল নিশ্চিত হয়ে যাবেআরপিওর ১১ (চ) অনুসারে ৩ বছর পর পর জাতীয় কাউন্সিল করে সংশোধিত গঠনতন্ত্র দাখিলে ব্যর্থ হলেও নিবন্ধন বাতিল হয়তাই এ ক্ষেত্রে বিএনপি নিবন্ধন ঝুঁকিতে রয়েছে

বিএনপির সর্বশেষ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১৯ মার্চএরপর প্রায় সোয়া ৭ বছর সময় অতিক্রম হয়ে গেলেও জাতীয় কাউন্সিলের আয়োজন করেনি দলীয় হাইকমান্ডতবে জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই তারা দলের মেয়াদোত্তীর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটিতে এখনো বিভিন্ন জনকে বিভিন্ন পদের দায়িত্ব দিচ্ছেনপ্রায় একই সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করার পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত অন্যান্য দল আরও দুইবার কাউন্সিল করে ফেললেও বিএনপি তা করেনি

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বেশ কদফা জাতীয় কাউন্সিল করার কথা দলীয় শীর্ষ পর্যায় থেকে তোলা হলেও শেষ পর্যন্ত আর তা করেনি বিএনপিঅবশ্য এরপর করোনাকালে নির্বাচন কমিশন থেকে জাতীয় কাউন্সিল করতে সময় বাড়িয়ে নেয় তারাতবে করোনা পরিস্থিতি ভালো হলে জাতীয় কাউন্সিল করবে বলে নির্বাচন কমিশনকে জানালেও পরে সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূলে থাকার পরও তারা  জাতীয় কাউন্সিল করছে নারাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিএনপি গণতন্ত্রের কথা বলে রাজনীতি করলেও তাদের দলেই গণতন্ত্র নেইতাই তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (আরপিও) তোয়াক্কা করে না

বিএনপির গঠনতন্ত্রেও ৩ বছর পরপর জাতীয় কাউন্সিল করার কথা উল্লেখ রয়েছেসে হিসেবে ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ আগের কাউন্সিল হওয়ায় পরবর্তী কাউন্সিল ২০১৯ সালের ১৯ মার্চের মধ্যে হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা তা করেনিদলের গঠনতন্ত্র এবং আরপিও কোনোটারই তোয়াক্কা করছে না দলটিযদিও দলের একটি অংশ জাতীয় কাউন্সিল করার জন্য বারবারই চাপ প্রয়োগ করেছেকিন্তু বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি থাকায় লন্ডন প্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান  রাজি না থাকায় যতবারই দলের কাউন্সিলের চেষ্টা হয়েছে ততবারই সে চেষ্টা ব্যাহত হয়েছে

সূত্রমতে, লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল করতে নারাজতারেক রহমানের এ অবস্থানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত দলের কিছু নেতাতারা দলের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদ প্রত্যাশীতারা মনে করছেন, তারেক রহমানের অনুপস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি হলে খুব বেশি সুবিধা করতে পারবেন নাসুবিধাজনক সময়ে কাউন্সিল ছাড়া কমিটি হলে সে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবেন তারেক রহমানতাই তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে সহজ হবে এবং নিজেদের পছন্দ মতো অন্যদেরও পদ দেওয়া যাবেএর ফলে তারা দলে প্রভাব ও আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেন

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগসহ যেসব ২০১৬ সালে বিএনপির কাছাকাছি সময়ে জাতীয় কাউন্সিল করেছে সেইসব দল ২০১৯ সালেই পরবর্তী কাউন্সিল করেছেতারপর আবারও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দল ২০২২ সালে জাতীয় কাউন্সিল করে ফেলেছেঅথচ বিএনপির এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ নেইএ নিয়ে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছেযদিও দলে অবস্থান খর্ব হওয়ার ভয়ে তারা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছুই বলছেন নাতবে দলের সর্বস্তরের অধিকাংশ নেতাই চান জাতীয় কাউন্সিল করে বিএনপির নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করতে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতা জানান, সোয়া ৭ বছর হলেও আমরা জাতীয় কাউন্সিল করতে পারিনিএ জন্য দলের ভেতরে জাতীয় কাউন্সিল করার চাপ রয়েছেবিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দি ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিদেশে থাকাসহ বিভিন্ন কারণে জাতীয় কাউন্সিল করা হয়নিঅনুকূল পরিবেশ ফিরে এলে অবশ্যই জাতীয় কাউন্সিল ও নতুন নির্বাহী কমিটি গঠন করা হবে

বিএনপি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, সোয়া ৭ বছর ধরে জাতীয় কাউন্সিল না হওয়ায় দলের একটি অংশ চরম ক্ষুব্ধবিশেষ করে যারা দলের পরবর্তী নির্বাহী কমিটিতে পদ প্রত্যাশী তারা ক্রমেই সিনিয়র নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেনএ ছাড়া সংস্কারপন্থি যেসব নেতাকে আগের কমিটিতে রাখা হয়নি, তারা এখন দলে সক্রিয় থাকলেও আবার কবে কমিটিতে আসতে পারবে সে চিন্তায় অস্থিরএ কারণে অনেকে দলে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কারাবন্দি হওয়ার আগে দলের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সর্বস্তরে দল গুছিয়ে জাতীয় কাউন্সিল করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেনএরপর তার অনুপস্থিতিতে গণফেরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে বিএনপি২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলকে ঢেলে সাজাতে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা জাতীয় কাউন্সিলের দাবি তুললেও এ বিষয়ে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানতারেক রহমান রাজি না থাকায় তখন জাতীয় কাউন্সিল করতে পারেনি বিএনপিএর পর আরও কয়েক দফা দলের সিনিয়র নেতারা জাতীয় কাউন্সিলের দাবিতে সোচ্চার হনকিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি

বিএনপি সূত্র জানায়, এক সময় বিএনপির অধিকাংশ নেতা জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের পক্ষে সোচ্চার থাকলেও হাইকমান্ডের বিরাগভাজন না হতে এখন অনেকেই সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেনতবে এখন আন্দোলন সফল না হওয়া এবং বিএনপি ছাড়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়ে গেলে দলটির ভবিষ্য কি হবে এ নিয়ে ভাবনার শেষ নেই বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের

×