ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্থল বা জলপথে আসতে পারে রূপপুর পরমাণু কেন্দ্রের সরঞ্জাম

রাশিয়ার সেই জাহাজের পণ্য এবার খালাস হতে পারে চীনে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:৪৭, ২৮ জানুয়ারি ২০২৩

রাশিয়ার সেই জাহাজের পণ্য এবার খালাস হতে পারে চীনে

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না পারা রাশিয়ার  সেই জাহাজটি এবার চীনের কোনো বন্দরে পণ্য খালাস করবে

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে বাংলাদেশের বন্দরে ভিড়তে না পারা রাশিয়ার  সেই জাহাজটি এবার চীনের কোনো বন্দরে পণ্য খালাস করবে। উরসা মেজর নামের এই জাহাজটি রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য যন্ত্রপাতি নিয়ে এসেছিল। এবার চীনে এসব পণ্য খালাসের পর তা স্থল বা জলপথে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে। জাহাজটির ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞাজনিত এই জটিলতায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ আরও পিছিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

করোনা মহামারির কারণে ধীরগতিতে কাজ চলায় এর উৎপাদন শুরুর সময় ২০২৩ সাল থেকে পিছিয়ে ২০২৪ করা হয়। ফিরে যাওয়া ওই জাহাজে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১ হাজার ৬৮৭ টন যন্ত্রপাতি ছিল জানিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র কর্তৃপক্ষ বলছে, এসব পণ্য বাংলাদেশে না পৌঁছানো পর্যন্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ ব্যাহত হবে। কবে নাগাদ এসব পণ্য আবার আসবে তাও জানেন না তারা। এতদিন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি তেলের ঊর্ধ্বমূল্য, ডলার সংকটসহ নানা ভোগান্তির পরোক্ষ খেসারত দিলেও এবার দেশের অন্যতম বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন কাজ ব্যাহত হওয়ায় এর সরাসরি খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদশকে। 
ডিজিটাল বাংলাদেশের পর এবার সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে কাজ শুরু করেছে। আর এই কাজের অন্যতম হাতিয়ার এই রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গত বছরের মাঝামাঝিতে এর ওপর বসে রিঅ্যাক্টর ভ্যাসেল (পারমাণবিক চুল্লির পাত্র)। পাশাপাশি পূর্ণোদ্যমে চলছে এর সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজও। তবে মহামারি করোনাসহ সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কাজে কিছুটা ধীরগতি আসে।

তাই ২০২৩ সাল এর উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা থাকলে সময় আরও পেছানো গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর কেন্দ্র পরিদর্শন করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ২০২৪ সালের শেষ নাগাদ এর বাণিজ্যিক উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসেবে ইউরেনিয়াম আসা শুরু করবে চলতি বছরের জুন মাস থেকেই। তখন তিনি জানান, প্রথম ইউনিটের কাজ ৮৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। দ্বিতীয় ইউনিটের কাজও এগিয়ে চলছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঙ্গে ক্রয় চুক্তির খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ ইউনিট প্রতি দর ৪ থেকে ৫ টাকার মতো হবে জানিয়ে তিনি বলেছিলেন, পরমাণু বিদ্যুতে সবচেয়ে সুবিধার দিক হচ্ছে ৬০ বছর এর দর কোন ওঠানামা করবে না। আমরা একই দরে ৬০ বছর বিদ্যুৎ পাব।
সবই চলছিল ঠিকঠাক। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা জোটের নিষেধাজ্ঞার সরাসরি খেসারত দিতে হচ্ছে এবার বাংলাদেশকে।

রাশিয়া থেকে কোনো পণ্য সরাসরি আমদানি-রপ্তানিতে জটিলতা তৈরি হলেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সাজসরঞ্জাম নিয়ে রাশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ গত ২৪ ডিসেম্বর মোংলা বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়, জাহাজটি আসলে ‘উরসা মেজর’ নয়। এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজ। জাহাজটির আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থার (আইএমও) সনদ নম্বর: ৯৫৩৮৮৯২, যা প্রকৃতপক্ষে ‘স্পার্টা-৩’ জাহাজের সনদ নম্বর।

বিষয়টি যাচাই করে বাংলাদেশ নিশ্চিত হয়ে জাহাজটিকে বন্দরে ভিড়তে নিষেধ করে দেয়। অবশ্য রাশিয়া দাবি করে, জাহাজটি ‘স্পার্টা-৩’ ওরফে ‘উরসা মেজর’। পরে প্রায় দুই সপ্তাহ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পণ্য খালাসের জন্য অপেক্ষা করেছিল জাহাজটি। কিন্তু পণ্য খালাসের জন্য জাহাজটি নয়াদিল্লির অনুমতি পেতে ব্যর্থ হয়। এ অবস্থায় গত ১৬ জানুয়ারি ভারতের জলসীমা ছেড়ে যায় জাহাজটি।

সেদিনই (১৬ জানুয়ারি) রাশিয়ার পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে জানানো হয়, উরসা মেজরের পরিবর্তে এখন অন্য জাহাজে করে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জাম বাংলাদেশে পাঠানো হবে। কিন্তু তা কবে নাগাদ এবং ঠিক কোন জাহাজে পাঠানো হবে তা জানেন না জানিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান প্রশাসনিক কর্মকর্তা অলক চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, রাশিয়া থেকে পাঠানো এসব পণ্যের প্রায় সবই কমিশনিং ইক্যুইপমেন্ট (উৎপাদন কাজের যন্ত্রপাতি)।

যেগুলোর মধ্যে রয়েছে টারবাইনের কিছু যন্ত্রাংশ, রিঅ্যাক্টর ভেসেলের কিছু যন্ত্রাংশ। সবই এমবেডেড পার্টস। এগুলোর একটি না হলেও উৎপাদন কাজ ব্যাহত হতে পারে। যা হচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সব কাজই একটার সঙ্গে আরেকটা সম্পর্কিত। রিঅ্যাক্টর ভেসেলের একটি যন্ত্রাংশের কারণেও পুরো কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। তাই এখনো হচ্ছে। তাহলে কি উৎপাদন কার্যক্রম আবারও পেছানো হতে পারে এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটা একটা স্বাভাবিক বিষয়। একটা যন্ত্র যদি আমরা এক মাস আগে পেতাম তাহলে ওই কাজ এক মাস আগে শুরু হতো।

এখন যেহেতু পাওয়া যায়নি, সেই মোতাবেক তা তো পেছাবেই। যদি পেছাবে না বলি তাহলে এটা ভুল বলা হবে। কবে নাগাদ আবারও রাশিয়া এসব পণ্য পাঠাবে এ বিষয়ে আপনাদের কিছু জানিয়েছে কিনা বা আপনারা কিছু জানেন কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, মোংলা বন্দরে পণ্য নিয়ে জাহাজ না ভেড়া পর্যন্ত আমরা এখন কিছুই বলতে পারব না। রাশিয়া থেকেও আমাদের কিছু বলা হয়নি। এবার চীনে পণ্য খালাস হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরাও খবর পাচ্ছি।

কিন্তু এটা আমাদের মাথাব্যথার বিষয় নয়। রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের চুক্তি মোতাবেক তারা পণ্য আমাদের বন্দরে পৌঁছে দেবে। আমরা তারপর যত ধরনের ‘লজিস্টিক সাপোর্ট’ লাগে তা দেব। কিভাবে তারা আমাদের বন্দরে পণ্য পৌঁছাবে তা আমাদের না জানলেও হবে। 
তবে সোমবার ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়েছেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সরঞ্জাম বহনকারী রুশ জাহাজটির পণ্য চীনে খালাস করার ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা নেই। গণমাধ্যমে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, আইনসিদ্ধ সহযোগিতায় মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কোনো প্রভাব ফেলবে না। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা রুশ জাহাজের সরঞ্জাম চীনে খালাসের বিষয়ে জানতে চাইলে দেশটির রাষ্ট্রদূত বলেন, আমি আশা করি, কোনো ধরনের নিষেধাজ্ঞা সাধারণ আইনসিদ্ধ সহযোগিতায় প্রভাব ফেলতে পারবে না। এ জাহাজটি নিষেধাজ্ঞার আওতায় আসা উচিৎ ছিল না। নিষেধাজ্ঞাটি বহুপক্ষীয় নয়। জাতিসংঘেরও নয়।
এদিকে রাশিয়ার উরসা মেজর তথা স্পার্টা-৩ জাহাজটি রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবেই বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে দাবি করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। রবিবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক রয়েছে। এটা আশ্চর্যজনক যে, রাশিয়া তাদের নিষেধাজ্ঞার তালিকায় থাকা একটি জাহাজের নাম পরিবর্তন করে আমাদের কাছে পাঠিয়েছে। আমরা এটা আশা করি না। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়নে কীভাবে আরও ভালো সমন্বয় করা যায় সে বিষয়ে মস্কোর সঙ্গে কাজ করছে ঢাকা।
রূপপুর প্রকল্পের প্রশাসনিক প্রধান অলোক চক্রবর্তী জনকণ্ঠকে বলেন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ভিভিইআর ১২০০ মডেলের। এই মডেলের কেন্দ্র রাশিয়ার বাইরে বাংলাদেশেই প্রথম নির্মাণ করা হচ্ছে। ভিভিইআর ১২০০ মডেলের দুটি ইউনিটে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এর মধ্যে ১২০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিটটি চলতি বছরের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা ছিল। দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৩ সালে উৎপাদনে আসার কথা।

কিন্তু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ৪০০ কেভি ও ২৩০ কেভির বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রটির কাজ পেয়েছিল জার্মানির সিমেন্স এজি। বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণের কাজও প্রায় শেষের দিকে ছিল। এমন সময় ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানোয় রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক অবরোধে কাজে কিছুটা প্রভাব তো পড়বেই। আর তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময়ও পেছানো হয়েছে এক বছর।
প্রসঙ্গত, ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচের এই প্রকল্পে নব্বই ভাগ টাকা ঋণ দিয়েছে রাশিয়া। একই সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কয়েকটি চুক্তির মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মাণ করছে রুশ ঠিকাদার এটমস্ট্রয় এক্সপোর্ট। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট এবং একই পরিমাণ বিদ্যুৎ দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসার কথা। কিন্তু এখন উৎপাদন শুরুর সময় পেছানো হবে যে বিষয়টি স্পষ্ট। 
এসব জটিলতায় সময়মতো উৎপাদনে আসাতে না পারার বিষয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমানে পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলছে।

এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নির্মাণ করা হবে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশসমূহে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। কিন্তু প্রকল্পের কাজ যদি সময়মতো শেষ না হয় তাহলে সব দিক দিয়েই ক্ষতি। যেমন বাড়তি অর্থ ব্যয় হওয়ার আশঙ্কা থাকে তেমনি জনগণের প্রত্যাশাও বাস্তবায়িত হয় না। তাই আমরা আশা করব প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে তৎপর হবে।

×