ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ওয়েবিল ও চেকিংয়ের নামে চলছে ভাড়া নৈরাজ্য 

আজাদ সুলায়মান, জনকণ্ঠ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ১১:৫২, ৫ অক্টোবর ২০২২

ওয়েবিল ও চেকিংয়ের নামে চলছে ভাড়া নৈরাজ্য 

গণপরিবহন

রাজধানীতে চলাচল করা বাসগুলোতে ওয়েবিল ও ‘চেকিং পদ্ধতি বন্ধ করার ঘোষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর হয়নি। বিভিন্ন পরিবহন এখনও তাদের ওয়েবিল ও চেকিং চালু রেখেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পরিবহেন বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর কয়েকটি রুটে ভ্রমণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। 

বিজয় পরিবহন, মনজিল, মালঞ্চ, শিকড়, আয়াত, বাহন, লাব্বায়েক, অনাবিল, রাইদা, লাভলী, স্বাধীন নামের পরিবহনে দেখা গেছে- সরকারী নির্দেশাবলি অমান্য করেই বাড়তি ভাড়া ও ওয়েবিল নামের ঠক বাণিজ্য চলছে। বাসস্ট্যান্ডের বাইরে রাস্তায় দাঁড়ানো যাত্রী তোলা, কিলোমিটারকে টেম্পারিং করা ও ন্যূনতম ভাড়ার নীতিমালা অমান্য করার প্রবণতাও চোখে পড়ে। সবচেয়ে বেশি ‘ডাকাতি’ করছে- গুলশান বনানী বারিধারায় চলাচলকারী ঢাকা চাকা ও হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসগুলো। ঢাকা চাকার এসি বাসে আদায় করা হচ্ছে ২৫ টাকা। আবার হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে নেয়া হচ্ছে কিলোমিটার প্রতি ১০ টাকা। তবে কয়েকটি এলাকায় বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি থাকায় বাসগুলো নিয়ম মেনে চলার কৌশল অনুসরণ করে। যদিও বিশাল এই মহানগরে বিআরটিএ ছাড়া অন্য কোন সংস্থার টহল বা  ভ্রাম্যমাণ আদালতের উপস্থিতি চোখে পড়েনি। 

ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির মদদেই পরিবহন সেক্টরে এ ধরনের নৈরাজ্য চলছে। মূলত তাদের জন্যই কোন সিদ্ধান্তই সঠিকমতো বাস্তবায়ন করতে পারছে না বিআরটিএ। 

ডিজেলের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর পর গত নবেম্বরে কিলোমিটারে বাস ভাড়া ২ টাকা ১৫ পয়সা নির্ধারণ করার পর বিআরটিএর ঘোষণা ছিল, ওয়েবিল অবৈধ। সেটি থাকবে না। এমনকি আইন না মানলে বাস কোম্পানির রুট পারমিট বাতিলের হুমকিও দেয়া হয়। সে সময় খন্দকার এনায়েত সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণা দেন, ওয়েবিলে বাস চলবে না। ভাড়া কাটা হবে কিলোমিটার হিসেবে।

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মাদ মজুমদার দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। যদি সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগ কোন পরিবহনের বিরুদ্ধে পাওয়া যায়, তাহলে তদন্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আসলে ওরা দুষ্টুচক্র। ওদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন। তবুও আমাদের লেভেলে চেষ্টা করে যাচ্ছি। বিজয় পরিবহনের বিষয়ে অভিযোগ আসলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

মঙ্গলবার সরজমিনে নগরীর কয়েকটি রুটে দেখা যায়, সর্বশেষ বিআরটিএর নির্দেশ অমান্য করেই চলছে অধিকাংশ সার্ভিস। সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২ টাকা ৪৫ পয়সা করে কিলোমিটার প্রতি যে ভাড়া আসে- তার চেয়ে অনেক বেশি আদায় করা হচ্ছে জোর করে। সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা- এই নিয়মও অমান্য করছে বাসগুলো। কেউ সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে ১৫ টাকা, কেউ বা ২০ টাকা বা তার চেয়ে বেশি। আবার চার কিলোমিটারের ভাড়া ২০ বা ২৫ টাকা- এভাবেও আদায় চলছে। চার কিলোমিটারের জন্য ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা। কিন্তু বিভিন্ন কোম্পানির বাসে এই পথে ২৫ টাকা, কেউ ২০ টাকা, কেউ এমনকি ৩০ টাকাও আদায় করছে। আর ওয়েবিলের নাটক তো চলছেই। এদিন সকালে চিড়িয়াখানা মিরপুর-১ কালশী গুলিস্তান যাত্রাবাড়ী রুটের বিজয় এক্সপ্রেসের প্রতিটি বাসেই ভাড়া ও ওয়েবিল নিয়ে চলে তুঘলকি কাণ্ড। 

নাবিস্কো থেকে বিজয়ের ঢাকা মেট্রো-ব ১১-৮০০০ নম্বর বাসে ওঠার পর হামিদুজ্জামান নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে বিজয়নগর পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয় ২০ টাকা। এ নিয়ে চলে কন্ডাক্টরের সঙ্গে তুমুল বাগবিতণ্ডা। শেষ পর্যন্ত তিনি বিআরটিএর নেয়া সর্বশেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নাবিস্কো থেকে মগবাজার হয়ে পল্টন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৬ কিলোমিটার দূরত্বে ভাড়া হওয়ার কথা পনের টাকারও কম। অথচ তার কাছ থেকে কেন ২০ টাকা আদায় করা হলো জানতে চাইলে কন্ডাক্টর জবাব দেন- শুধু বিআরটিএর কথা বলেন কেন। পুলিশকে চাঁদা দিতে হয়, ঢাকা সড়ককে দিতে হয়। এগুলো কি মালিক বাড়ি থেকে এনে দেবে। নিতে হবে তো যাত্রীর কাছ থেকেই। 

ওয়েবিল তো বন্ধ রাখার সিদ্বান্ত হয়েছে তারপরও কেন আদায় করা হচ্ছে এমন  প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন- এটাও ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সম্মতি নিয়েই এখনও চালু রাখা হয়েছে। আমাদের করার কিছুই নেই। 

বিজয়ের মতোই স্বাধীন পরিবহনেও ওয়েবিল অনুযায়ী যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। একইভাবে উত্তরা থেকে কুড়িল হয়ে মালিবাগ রুটে চলাচলকারী রাইদা পরিবহনেও দেখা গেছে ওয়েবিল বাণিজ্যের নামে রীতিমতো জুলুমবাজি। যাত্রীদের করার কিছু নেই। নর্দা থেকে মালিবাগ আবুল হোটেল পর্যন্ত মাত্র ৭ কিলোমিটার পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয় ৩০ টাকা। অথচ এর ভাড়া কিছুতেই ১৮ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ রুটে প্রতিদিন চলাচলকারী শরিফুল ইসলাম জানান, অন্যান্য পরিবহন ওয়েবিল বন্ধ করে দিলেও রাইদা পরিবহন এখনও জোর জবরদস্তি করে সে হিসেবেই ভাড়া নিচেছ। এটুকু রাস্তার জন্য দুটো ওয়েবিল করা হচ্ছে। এ সব দেখারও কেউ নেই। এ রুটে বিআরটিএর কোন ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রমও চোখে পড়েনি। 

বেসরকারী বাস কোম্পানির পাশাপাশি হাতিরঝিলে সরকারী সংস্থা রাজউক পরিচালিত চক্রাকার বাসও এই অনিয়মের বাইরে নয়। এক কিলোমিটারের ভাড়াও ২০ টাকা। আবার দুই কিলোমিটারে ২০ টাকা, চার কিলোমিটারে ২৫ টাকা আদায় চলছে। অথচ সরকারী নিয়ম অনুযায়ী এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত সর্বোচ্চ ভাড়া হওয়ার কথা ১০ টাকা। কিন্তু কেউ দেখার নেই। 

বনানী গুলশান বারিধারা এলাকার ঢাকা চাকার অবস্থা আরও জুলুমের। এক কিলোমিটারের ভাড়া ন্যূনতম ২৫ টাকা। কাকলী থেকে মঙ্গলবার হোসাইন নামের এক যাত্রী গুলশান ২ নম্বর যেতে ভাড়া পরিশোধ করতে হয়েছে ২৫ টাকা। কেন এত ভাড়া জানতে চাইলে কাউন্টার থেকে বলা হয়- এটার সিটি কর্পোরেশন থেকেই নিধারিত করে দেয়া হয়েছে। এখানে বিআরটিএর করার কিছু নেই। ভ্রাম্যমাণ আদালতেও করার কিছু নেই। এটা চলবে সিটি কর্পোরেশনের নিজস্ব আইনে। অন্য কোন আইন এখানে চলে না। বললেন ঢাকা চাকার এক চালক। 

এ সব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিআরটিএ-চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, কোন ধরনের অনিয়ম অরাজকতা সহ্য করা হবে না। এখনও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের পরিচালনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত সড়কে শৃঙ্খলা নজরদারি করেছে। এ সময় বাড়তি ভাড়া আদায়ের দায়ে টাকাও জরিমানা করা হচ্ছে। রুট পারমিট বাতিলের মতো কঠোর ব্যবস্থাও নেয়া হচেছ। যেখানেই যাত্রীদের অভিযোগ ছিল সেখানেই হানা দিয়েছে। কাউকেই খাতির করা হয়নি। ওয়েবিল নিয়েও কোন বাহানা চলবে না। এছাড়া রুট ভায়োলেশন, পারমিটবিহীন বাস চালানো, হাইড্রলিক হর্ন বাাজানো, ফিটনেস বিহীনও অন্যান্য অপরাধের দরুনও জরিমানা আদায় করা হচ্ছে। 

ঢাকার চাকা ও চক্রাকার বাস সম্পর্কে নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ওগুলো সিটি কর্পোরেশন ও রাজউক নিয়ন্ত্রিত। তবে যদি ভাড়া অস্বাভাবিক হয় সেটা খতিয়ে দেখা যেতে পারে। 

এদিকে ওয়েবিল নিয়ে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ওয়েবিল নিয়ে বাস মালিকদের ঘোষণা লোক দেখানো। ওয়েবিল বন্ধ করতে এত মাস লাগবে কেন। সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল বন্ধের জন্য ঢাকা সড়ক সমিতি বারবার ঘোষণা দেয়। কিন্তু তারা তা কার্যকর করে না। আসলে মাঠ পর্যায়ে প্রকৃত বাস মালিকদের সঙ্গে তাদের কোন সমন্বয় নেই। কারণ ঢাকা সড়কের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের অধিকাংশেরই গাড়ি নেই। আমরা এসব নিয়ে মুখ খুললেই তারা আমাকে হুমকি দেয়। 

উল্লেখ্য, গত আগস্টের প্রথম সপ্তাহে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে সমালোচনার মুখে ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার ঘোষণা দেয় ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। তারা বলেছিল, ঢাকা ও এর আশপাশের শহরতলীর বাসে রাস্তায় কোন পরিদর্শক (চেকার) থাকবে না। এক বাসস্ট্যান্ড থেকে অন্য বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত চলাচলের সময় বাসের দরজা বন্ধ রাখতে হবে। অর্থাৎ রুট পারমিট অনুযায়ী বাসস্ট্যান্ডের বাইরে থামিয়ে যাত্রী তোলা যাবে না। ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পরদিনই তা কার্যকর করার কথা থাকলে তা আর হয়নি। আগের মতোই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি অর্থাৎ চালক ও হেলপাররা তাদের মতো গায়ের জোরে আদায় করছে বাড়তি ভাড়া। এখনও চেকাররা বাস থামিয়ে যাত্রী গুনছেন। এজন্য তাদের বাসপ্রতি ১০ টাকা করে আদায় করতেও দেখা গেছে।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সাভার থেকে যাত্রাবাড়ী রুটে চলা এমএম লাভলী ও লাব্বাইক পরিবহন, মোহাম্মদপুর থেকে বনশ্রী পর্যন্ত চলা স্বাধীন পরিবহন, ঘাটারচর থেকে উত্তরা রুটে চলা প্রজাপতি ও পরিস্থান পরিবহন, গাবতলী থেকে উত্তরা পর্যন্ত চলা বসুমতি, মোহাম্মদপুর থেকে শাহবাগ হয়ে বনশ্রী পর্যন্ত চলা তরঙ্গ প্লাস, মোহাম্মদপুরের জাপান গার্ডেন সিটি থেকে বনশ্রী ও মিরপুর-১ থেকে বনশ্রী রুটে চলা আলিফ পরিবহন, গাবতলী থেকে বাড্ডা লিংক রোড রুটে চলা রবরব পরিবহন, গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটে চলা আছিম পরিবহন, গাবতলী থেকে ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রুটের রাজধানী পরিবহন, মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরি হয়ে বনশ্রী রুটের রমজান পরিবহন, রায়েরবাগ থেকে গুলিস্তান রুটের শ্রাবণ পরিবহন, মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে কেরানীগঞ্জ রুটের দিশারী পরিবহনসহ অসংখ্য কোম্পানি এখনও ওয়েবিলে ভাড়া নিচ্ছে।
 

এমএইচ

×